অজস্র সাফল্যের স্মারক : মুরারিচাঁদ কলেজ

ম আমিনুল হক চুন্নু :

সিলেট বা শ্রীহট্টের ইতিহাস গতানুগতিক প্রাচীন বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ হতে ভিন্ন। কারণ, বঙ্গীয় বদ্বীপের ভৌগোলিক ভিন্নতার কারণে পাহাড়, টিলা, বিশাল হাওর ও অসংখ্য নদ-নদী এই ভূ-ভাগকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। দুর্গমতার কারণে এই বিভাগটা ছিল শাসকশ্রেণির মাথাব্যথার কারণ।

সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতি সুপ্রাচীন পাশ্চাত্য শিক্ষার সূচনালগ্ন থেকে এ দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তনের যে অভিঘাত, তার সঙ্গেও সিলেট সম্পৃক্ততার ইতিহাস প্রাচীন। ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজি শিক্ষার যে বিস্তার ঘটেছিল, তার সুফল সিলেট অঞ্চলে কিছুটা দেরিতে পৌঁছায়। প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ব্যক্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে ইংরেজি শিক্ষার ভিত গড়ে ওঠে।

তাই দার্শনিক প্লেটো বিশ্বাস করতেন, একটি সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিক্ষা অপরিহার্য। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, The True aim of Education is the Attainment of happiness through Perfection. এ জন্যই জন ফ্রেডারিক হারবার্ট বলেছেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধন।’ তবে মানবসন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেই যথার্থ মানুষ হওয়া যায় না। মানুষকে যথার্থ মানুষ হতে হলে জ্ঞানার্জন করতে হয়, আর এই জ্ঞান অর্জিত হয় মূলত শিক্ষার মাধ্যমে। তাই শিক্ষা মানুষের অমূল্য সম্পদ।

ভারতবর্ষে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির প্রবর্তন করা হয়। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা শিক্ষা সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলার বিভিন্ন জেলায় একটি করে উচ্চ ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৪০-৪১ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট জেলায়ও সরকার একটি ইংরেজি হাইস্কুল স্থাপন করে।
ছাত্রস্বল্পতার কারণে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে স্কুলটি উঠে যায়। সংকটে হাল ধরেন রেভারেন্ড উইলিয়াম প্রাইজ (১৮৩১-১৮৯০)। তিনি একটি মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর পরই রেভারেন্ড প্রাইজ দুটি এমই স্কুল স্থাপন করেন। ‘শেখঘাট মধ্য ইংরেজি মিশন স্কুল’ ও ‘নয়াসড়ক মধ্য ইংরেজি মিশন স্কুল’। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট গভর্নমেন্ট স্কুল। স্কুলটির অবস্থান ছিল মনারায়ের টিলা (বর্তমানে চৌহাট্টা জজ সাহেবের বাংলো)। একাধিকবার স্থান পরিবর্তনের পর সরকারি স্কুলটি বর্তমানে সুরমা নদীর তীরে কিন ব্রিজের পূর্ব পাশে স্থায়ী ভবনে। তা ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে রাসবিহারী দত্তের ‘রাসবিহারী’ স্কুলের (১৮৬৭) নাম উল্লেখযোগ্য। মুফতি জালালউদ্দিন ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন দরগা মহল্লা মুফতি স্কুল। এভাবেই ব্যক্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াসে সিলেটে আধুনিক শিক্ষা, বিশেষত ইংরেজি শিক্ষার বিকাশ ঘটে।

সিলেটে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের নবোদ্যমকে এগিয়ে নিতে দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেওয়া উত্তম পুরুষ রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় (১৮৪৫-১৯০৮)। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুন মাতামহ মুরারিচাঁদের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুরারিচাঁদ স্কুল’। গিরিশ চন্দ্র রায় মুরারিচাঁদ স্কুলে একটি কলেজ বিভাগ চালু করেন ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এফএ (First Arts Standard) ক্লাসের অনুমোদন লাভ করে। ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে একটি দ্বিতীয় শ্রেণির কলাবিষয়ক কলেজ হিসেবে মুরারিচাঁদ কলেজের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
নবগঠিত আসামের প্রথম এবং পূর্ববঙ্গের সপ্তম কলেজ মুরারিচাঁদ কলেজ। মুরারিচাঁদ কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান বাবু সতীশচন্দ্র রায়। তখন কলেজের শিক্ষকসংখ্যা ছিল ৪। অধ্যক্ষ ছাড়া আরও তিনজন অধ্যাপক ছিলেন। প্রথমত, কলেজের অবস্থান ছিল শহরের কেন্দ্রস্থল গোবিন্দচরণ পার্কের দক্ষিণ পশ্চিম কোনায়। পরবর্তীকালে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে মুরারিচাঁদ কলেজকে ডিগ্রি কলেজে রূপান্তরের পূর্বশর্ত হিসেবে সিলেটের নয়জন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি সরকারকে ১৮ হাজার টাকা প্রদানে প্রতিশ্রুত হন। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন সিলেট তথা আসামের শিক্ষা প্রসারে যাঁর অবদান অনস্বীকার্য, তিনি সিলেটের বিদ্বান পুরুষ, আসামের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ সিআইই (কাপ্তান মিয়া)। প্রতিশ্রুতিদান সভা জনাব কাপ্তান মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার মান উন্নয়নে এবং মুরারিচাঁদ কলেজের ইতিহাসের সঙ্গে যে নয়জন শিক্ষানুরাগীর নাম যুক্ত হয়ে আছে, স্মরণযোগ্য নামগুলো যথাক্রমে-
১. খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ, ২. রায়বাহাদুর নলিনীকান্ত দস্তীদার, ৩. রায়বাহাদুর বৈকুণ্ঠনাথ শর্মা, ৪. খানবাহাদুর মোহাম্মদ বক্ত মজুমদার, ৫. বাবু সারদাচরণ শ্যাম, ৬. বাবু রাধাবিনোদ দাস, ৭. রায়বাহাদুর সুখময় চৌধুরী, ৮. রায়বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্ত, ৯. বাবু হরেন্দ্রচন্দ্র সিনহা। (আজিজ, ২০১৪: ৩৫)।

মুরারিচাঁদ কলেজকে সরকারীকরণের মূলে সৈয়দ আব্দুল মজিদের প্রশংসনীয় ভূমিকার কথা উল্লেখ করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির সেতু লিখেছেন :

‘তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে মুরারিচাঁদ কলেজকে শহরের মধ্যবর্তী গোবিন্দচরণ পার্ক থেকে টিলাগড়ে স্থানান্তরিত করা হয়। সিলেটের প্রথম রেমিডেন্ট উইলিয়াম থ্যাকারে নামের টিলার চারপাশে শতাধিক একর জমিও অধিগ্রহণ করেন তিনি একটি নতুন স্বপ্নে। (সেতু, ২০১৮ ঃ ৪৮)।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ আগস্ট টিলাগড় থ্যাকারে টিলায় কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম মরিস, ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই সেশন থেকে থ্যাকারে টিলার ক্যাম্পাসে কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম রিড ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জুলাই কলেজ লাইব্রেরি হলে এক দরবারের মাধ্যমে নতুন ক্যাম্পাস কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। সে সময়ে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন সিডিই রবার্টস। তবে সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের ইতিহাসে মুরারিচাঁদ কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নাম অগ্রগণ্য।

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে মুরারিচাঁদ কলেজ থ্যাকারের টিলায় মূল ক্যাম্পাসে চালু হওয়ার পর শিক্ষাক্রম-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের ওপর জোর দেওয়া হয়। এ সময়কার অধ্যক্ষ ড. ডি টমসন কলেজ সংগীত রচনার জন্য ৫০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্র অমূল্য ভূষণ চৌধুরী রচিত-

ধন্য মোদের কলেজ!
শাবাশ মোদের কলেজ!
মুরারিচাঁদ কলেজ!
সুরমা তীরের আমরা মরাল
কলেজ মোদের রংমহল
অন্ধ ধরার বন্ধ কোঠায়
বন্যা আলোর আনব চল।

(The Murarichand College Magazine, 1927-28, Vol-xi. No-1, Page-24)

অন্তরায় সংগীতটি কলেজ সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়। কলেজ সংগীত ছাত্র সংসদের সভা-সমিতিতে গাওয়া হতো। এই সংগীতের সঙ্গে মিল রেখেই ছাত্র সংসদের প্রতীক স্মারক হিসেবে নির্বাচিত হয় রাজহাঁস মরাল।

‘The College Union’ নামে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে মুরারিচাঁদ কলেজ ছাত্র সংসদের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্র সংসদের জন্য একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয় এবং সংসদ কার্যক্রমে একটি গণতান্ত্রিক ধারার প্রবর্তন ঘটে। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে কলেজের পুকুরের উত্তর পাশে একটি ছাত্র মিলনায়তন তৈরি করা হয়। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে কলেজ গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা ছিল ৫০০০ এবং অধিকাংশই ছিল বাংলা সাহিত্য বিষয়ের বই। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা ২৫ হাজার ৯৫০ কপি এবং মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে বইয়ের সংখ্যা ১৬৫ কপি। পুরোনো জৌলুশ হারালেও মুরারিচাঁদ কলেজ গ্রন্থাগার স্বমহিমায় আজও জ্ঞানচর্চার ভান্ডার হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। (তথ্যসূত্র : কলেজ গ্রন্থাগার)।
১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটে এসেছিলেন। ৭ নভেম্বর মুরারিচাঁদ কলেজে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, কলেজটি সিলেটে উচ্চশিক্ষার জন্য বিরাট এক গুরুত্ববহ প্রেক্ষাপট তৈরি করবে এবং কলেজটিকে কেন্দ্র করে উচ্চ বিদ্যায়তনিক স্বপ্ন দেখবে সিলেটবাসী। তা ছাড়া সিলেটের শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভূত প্রশংসাও করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শ্রীহট্টকে ‘শ্রীভূমি’ হিসেবেই অভিহিত করেছিলেন একটি কবিতায়। কবিতাটিতে শ্রীহট্টের প্রতি কবির সুগভীর সংবেদনও প্রতিফলিত হয়েছে :

মমতাবিহীন কালস্রোতে
বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হতে
নির্বাসিতা তুমি
সুন্দরী শ্রীভূমি
ভারতী আপন পুণ্য হাতে
বাঙালির হৃদয়ের সাথে
বাণী মাল্য দিয়া
বাঁধে তব হিয়া
সে বাঁধনে চিরদিন তরে তব কাছে
বাঙলার আশীর্বাদ হয়ে আছে।
(কার্তিক, ১৩২৬ বঙ্গাব্দ)

১৯২৪ সালে শ্রীমতী সরোজিনী নাইডু সিলেট এমসি কলেজ পরিদর্শন করে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি সেই সময় মন্তব্য করেছিলেন, Every Student of The College should be a poet.
উপমহাদেশের অন্যতম রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এমসি কলেজের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে একে বলেছিলেন, The Flower of the East.

অমিত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে এক অনুপম বিদ্যাপীঠ। আমাদের শতাব্দীকালের অগ্রজ এবং অনুজদের স্মৃতির ভান্ডার। কেবল শিক্ষার সুব্যবস্থা ও আয়োজনের জন্য নয়, শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, হৃদ্যিক পরিবেশের পাশাপাশি অজস্র সাফল্যের স্মারক এক কিংবদন্তি এই কলেজ। কোন কলেজ মুরারিচাঁদ কলেজ, তা বড় কথা নয়। ভৌগোলিক ও শিক্ষা ব্যবস্থাজনিত সুসম্পর্কের জন্য পূর্বের ও পরের মুরারিচাঁদ দুটোই প্রকৃতপক্ষে এক কলেজ, কেবল প্রশাসনিক বিন্যাসটুকু পৃথক।

১৯৮১ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করার পর উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার জন্য আমাকে জগন্নাথপুর উপজেলার বাইরে যেতে হয়। জগন্নাথপুর উপজেলায় তখন কোনো কলেজ ছিল না। আমাদের গ্রাম থেকে সিলেট যেতে ৮-১০ ঘণ্টা সময় লেগে যেত। রৌয়াইল থেকে লঞ্চে শেরপুর, শেরপুর কুশিয়ারা ও সাদিপুর ফেরি পার হতে অনেক সময় লাগত। রিটেন ও ভাইভা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় ভর্তি হলাম এমসি কলেজ সিলেটে।

তখন সিলেট এমসি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন গোলাম কিবরিয়া স্যার। বাংলা পড়াতেন মনোহর আলী স্যার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (বিএ অনার্স) এমএ পাস করেছিলেন। তিনি খুবই হাস্যরসিক ছিলেন, রসাত্মক গল্প বলে ক্লাসের সবার কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি চমৎকার শিক্ষক ছিলেন। ইংরেজি বিভাগে দুজন অধ্যাপক ছিলেন। একজন শফিকুল আমিন ও আরেকজন অনীল বাবু। অনীল স্যার Gift of the Magi পড়ানোর সময় মজার মজার সব প্রেমের গল্প বলতেন। তখন আমরা অনেকেই অন্যদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য বাঁকা চোখে সামনের সারির দিকে তাকাতাম। গিয়াস উদ্দিন স্যার অত্যন্ত সহজভাবে পৌরনীতি পড়াতেন। শফিকুল আমিন স্যার যখন পড়াতেন, তখন তার চোখ-মুখ লাল হয়ে যেত।

যুক্তিবিদ্যা পড়াতেন তাজুল ইসলাম ও তাঁর সহধর্মিণী সৈয়দা শামসুন নাহার। দুজনই ভালো পড়াতেন। যুক্তিবিদ্যার অনেকগুলো পদ্ধতি যে অন্যান্য শাস্ত্রেও ব্যবহৃত হতো, তাই যুক্তিবিদ্যা পড়ে আমি আনন্দ পাই। স্যার ও ম্যাডাম পরবর্তীকালে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ইসলামের ইতিহাস পড়াতেন আবু তৈয়ব স্যার। স্যার আমাকে নিজের ছেলের মতো স্নেহ করতেন। স্যারের ক্লাস স্নেহ-রসে ভরপুর ছিল। পরবর্তীকালে তিনি সিলেট সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। অর্থনীতি পড়াতেন আব্দুল আহাদ স্যার। তাঁর লেকচার দেওয়ার ধরন ছিল আকর্ষণীয়। স্যার আমাকে অতি আদর করতেন। স্যার যখন অর্থনীতি বিভাগের প্রধান, তখন আমি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের (এমসি কলেজ) খণ্ডকালীন শিক্ষক। স্যারের সঙ্গে প্রতিদিনই দেখা হতো তাঁর কার্যালয়ে। আমি প্রায় ১২ বছর শিক্ষকতা করেছি এমসি কলেজ সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। একদিকে ছাত্র, অন্যদিকে শিক্ষক, কী আনন্দ! আমাদের ইসলামী শিক্ষা পড়াতেন রইছ উদ্দিন স্যার। অতি চমৎকার পড়াতেন। ইসলাম ধর্মের ওপর তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ছিল। তিনি ছাত্রছাত্রীদের নিকট খুব জনপ্রিয় ছিলেন। প্রায় ৪২ বছর পর এখনো মনে পড়ে এমসি কলেজের খ্যাতিমান স্যারদের আকর্ষণীয় লেকচারের হাজারো টুকিটাকি। সবশেষে বলব, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরা ছিলেন অতি অভিজ্ঞ ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন।

ঐতিহ্যে লালিত পুণ্যভূমি সিলেটের গৌরবান্বিত বিদ্যাপীঠ সিলেট এমসি অ্যান্ড সরকারি কলেজের যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ছাত্রছাত্রী ও আগত সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে একে অপরের সঙ্গে একতা, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন যাতে অটুট থাকে, সেই লক্ষ্যে ২০১০ সালে সিলেট এমসি অ্যান্ড সরকারি কলেজ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠনকল্পে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির সংবিধান সাধারণ সভার সিদ্ধান্তক্রমে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলে ৩১ অক্টোবর ২০১১ সালে সিলেট এমসি অ্যান্ড গভ. কলেজ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অব ইউএসএ ইন্ক আত্মপ্রকাশ করে। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠনের লক্ষ্যে যে পাঁচজন কৃতী ছাত্র উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন আব্দুল মুকিত চৌধুরী, হাসান চৌধুরী (মাসুম), ইয়ামিন রশিদ, সুফিয়ান আহমদ খান ও নিজাম উদ্দিন আহমদ। ২৫ জুন ২০১১ অ্যাসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্র রচনার জন্য গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রতিষ্ঠাতা পাঁচজনসহ সর্বজনাব সাহাবুদ্দিন, জিয়াউর রহমান মুর্শেদ, আব্দুল আহাদ ও কাজী ওয়াদুদ আহমদকে। তা ছাড়া ২৫ জুলাই ২০১১ আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আহ্বায়ক আব্দুল মুকিত চৌধুরী, যুগ্ম আহ্বায়ক সুফিয়ান এ খান ও হাসান চৌধুরী, সদস্যসচিব এএসএম গোলাম রব্বানী চৌধুরী, যুগ্ম সচিব মঞ্জুর আহমদ চৌধুরী ও সাখাওয়াত আলী।

৩১ অক্টোবর ২০১১ পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি আব্দুল মুকিত চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক এএসএম গোলাম রব্বানী চৌধুরী সাখাওয়াত আলী (২০১১-২০১৩)। সভাপতি সুফিয়ান এ খান ও সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত আলী (২০১৩-২০১৬)। সভাপতি বেলাল উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক জামাল সুয়েজ আহমদ (২০১৬-২০১৮)। সভাপতি বেলাল উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুর রহমান সাচ্চু (২০১৮-২০২১)। সভাপতি সফিক উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রেজাউল করিম রেজু (২০২১-২০২৩)।

পুণ্যভূমি সিলেট, পুণ্যভূমি জালালাবাদ। বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক এই গৌরবজনক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মূল উৎস হচ্ছেন হজরত শাহজালাল (রহ.)। তাঁর সিলেট এবং শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সিলেট জেলার এমসি কলেজের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন প্রবাসে নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরার নিমিত্তে সিলেট এমসি অ্যান্ড গভ. কলেজ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অব ইউএসএ প্রবাসের অন্যতম সুসংগঠিত সামাজিক সংগঠন। সময়ের বিবর্তনে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অ্যাসোসিয়েশন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো’। মানুষের জীবনের জন্যই শিক্ষা। যেসব মৃত শব্দ জীবনের অনির্বান, সেসব সত্য বইয়ের পাতায় নীরব, তাকে সরব করে কর্মের মাঝে মুক্তি দেওয়াতেই রয়েছে শিক্ষার সফলতা। অ্যালামনাই বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যাগাজিন শিক্ষার একটি অঙ্গ, যাকে ছেড়ে সে সোসাইটি বা প্রতিষ্ঠানের প্রাণ থাকতে পারে না। শিক্ষকের মননশীল সৃষ্টি, এমসি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও শিক্ষার্থীর সৃষ্টিশীল প্রয়াসের সমন্বয়ে প্রকাশিত হয় কলেজ বা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ম্যাগাজিন। যেখানে আটকে থাকে ইতিহাস, থাকে জীবনচিত্র। কলেজ ম্যাগাজিন, বার্ষিকী অথবা অ্যালামনাইয়ের স্মারকগ্রন্থ বিলীন হলেও এর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। ১৩০ বছরের ঐতিহ্যে লালিত মুরারিচাঁদ কলেজ। এই ১৩০ বছরের স্বপ্নকে লালন করে এবং প্রবাসের যান্ত্রিক জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝে আমাদের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা দেশের ও প্রবাসের সমাজকল্যাণমূলক কাজকে স্মরণীয় করতে দ্বিতীয়বারের মতো অ্যালামনাই নাইট-২০২৩ উদ্যাপন ও মুরারিচাঁদ কলেজের ১৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘স্মৃতিতে-শ্রুতিতে’ একটি স্মারক সংকলন প্রকাশ করতে যাচ্ছি। সম্পাদনা পরিষদে যারা রয়েছেন-মামুনুর রশিদ শিপু, অধ্যাপক ম. আমিনুল হক চুন্নু ও গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী। ২০১৮ সালে সম্পাদনা পরিষদে যারা ছিলেন-অধ্যাপক ম. আমিনুল হক চুন্নু ও মো. হোসেন সরওয়ার।

সিলেট এমসি অ্যান্ড গভ. কলেজ অ্যালামনাই নাইট-২০২৩ সংকলনটি ‘স্মৃতিতে-শ্রুতিতে’ প্রকাশ করতে পারাটা খুবই আনন্দের বিষয়। বিশেষত করোনাকালীন অতিমারির আবহের ও সিলেট বিভাগসহ বাংলাদেশের আরো প্রায় ১৪টি জেলায় শতাব্দীর সর্বনাশী বন্যার মধ্যেও সম্পাদনা ও প্রকাশনা নিঃসন্দেহে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রমে একটি তাৎপর্যময় প্রয়াস। আমরা বিশ্বাস করি, গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার ভিত্তি গড়ে না উঠলে দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তি গড়ে তোলা যায় না; সম্ভব হয় না রাষ্ট্রের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন। এমসি অ্যান্ড গভ. কলেজ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের স্মারক সংকলনের মূল উদ্দেশ্য হলো একতা, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ববন্ধন, শিক্ষকদের সহযোগিতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধ্যমতো সহযোগিতা, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান এবং গবেষণার ক্ষেত্রে অনুসন্ধিৎসাকে অনুপ্রেরণা প্রদান করা, গবেষকদের পেশাগত জ্ঞান, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং গবেষণার দ্বারা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে সক্ষমতা অর্জন। সুতরাং সিলেট এমসি অ্যান্ড গভ. কলেজ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অব ইউএসএ ইন্ক ‘স্মৃতিতে-শ্রুতিতে’ স্মারক সংকলন প্রকাশনাকে এদিক থেকে অ্যালামনাই নাইট-২০২৩ ও মুরারিচাঁদ কলেজের ১৩০ বছর পূর্তির কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন বলা যায়।

মুরারিচাঁদ কলেজের ইতিহাস বিনির্মাণ নয়, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের স্মারক সংকলনে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে অতীতকে সামনে তুলে ধরা নিবন্ধের মূল লক্ষ্য। তা ছাড়া সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের অধিকারী এমসি কলেজটি সিলেট বিভাগের গৌরবের বস্তু। বিগত ১৩০ বছরে কলেজটি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অনন্য কেন্দ্রস্থল হিসেবে এতদঞ্চলে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করছে। কলেজে অগণিত জ্ঞানী-গুণী বিজ্ঞজন যারা দেশে-বিদেশে তাদের মেধা ও মননের উৎকর্ষের কারণে নন্দিত হয়েছেন। অতীত যার গৌরবময়, ভবিষ্যৎ তার উজ্জ্বল না হয়ে পারে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রাণপ্রিয় এমসি কলেজের কল্যাণে কাজ করবেন। তাই নির্দ্বিধায় বলা চলে, আগামী দিনগুলোতেও এর নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রী, অ্যালামনাইয়ের সাধারণ সদস্য, কার্যকরী পরিষদের সদস্য, উপদেষ্টামণ্ডলী ও শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে কলেজের সুমহান ঐতিহ্যের সাফল্য স্মারক অব্যাহত থাকবে-এ প্রত্যাশা।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, নুরজাহান মেমোরিয়াল মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সিলেট। পিএইচডি ফেলো, নিউইয়র্ক।