ভোলা : যেসব জীবন অন্ধকারে মিলিয়ে যেত পারত, সেসব জীবন এখন সূর্যের আলোর মতো ঝলমল করছে। একসময় যারা অনিশ্চিত এক জীবনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল আজ তারাই একেকটি সফল জীবনের উদাহরণ। মা-বাবা হারানো শিশুগুলোর মুখের হাসি মন ভরিয়ে দেয়। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অঞ্চল চরফ্যাশনে গড়ে ওঠা একটি এতিমখানা বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটি অনন্য উদাহরণ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেছে। শুধু এলাকাতেই নয় সারা বিশ্বেই মানবসেবার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে ‘চরফ্যাশন এতিমখানা’।
সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজে পড়ছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, ২০০৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি চরফ্যাশন এতিমখানায় থেকে উপজেলা সদরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছেন। বর্তমানে তিনি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের ২০১৭-১৮ শিক্ষা বর্ষের এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ছাত্র। ২০০১ সালে নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে তার বাবা ইউনুছ মারা যান। তার পড়ালেখাসহ যাবতীয় খরচ এতিমখানা বহন করছে।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর মা-বাবা হারানো অনাথ শিশুদের আশ্রয়ের প্রয়োজনে জাতিসংঘের অর্থায়নে গড়ে উঠেছিল চরফ্যাশন এতিমখানা। গত ৪৮ বছরে সেটি বন্ধ হয়ে যায়নি বরং দিনে দিনে তার দক্ষতা আরো বেড়েছে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৮০০ এতিম শিশু প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।
৭০ এর সেই জলোচ্ছ্বাসের কথায় এখনো আঁতকে উঠেন সমুদ্রপাড়ের মানুষ। সেই জলোচ্ছ্বাসে মা-বাবা হারিয়ে অনাথ হয়েছিল অনেক সন্তান। ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া অনাথ শিশুদের আশ্রয়ের প্রয়োজনে জলোচ্ছ্বাসের পরপরই জাতিসংঘের অর্থায়নে সরকারিভাবে চরফ্যাশন আলিয়া মাদ্রাসার পাশে তাঁবু টাঙিয়ে চরফ্যাশন এতিমখানার যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে সরকারি সহায়তায় পরে বিদেশি দাতাসংস্থার অনুদানে চলে এই এতিমখানা। বর্তমানে সরকারি অনুদান এবং নিজস্ব আয়ে এতিমখানাটি পরিচালিত হচ্ছে।
অনাথ জীবনে আলোর দিশা
এই এতিমখানায় থাকা প্রতিটি শিশু, কিশোর এবং যুবকের জীবনই যেন অন্ধকার থেকে আলোর মুখে যাত্রার কাহিনী। বাবা হারানো আবুল কালামকে ২০০৯ সালে তার মা ৭ বছর বয়সে এতিমখানায় রেখে যায়। তখন থেকে এটাই বাড়িঘর। এখন সে চরফ্যাশন টাউন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে পড়ছে। নাইমও এসেছে বাবা মারা যাওয়ার পর ২০১৬ সালে। এখন উত্তর মাদ্রাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস থ্রিতে পড়ে সে।
তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়নের মৃত আব্দুল মালেকের দুই ছেলে তাহির ও তানজিদ এতিমখানায় থাকছে। তারা এসেছে গত বছর। অভাবের কারণে মা জাহানারা বেগম তাদের এতিমখানায় ভর্তি করেন। সেই থেকে তারা এখানে থেকে লেখাপড়া করছে। মাঝে মধ্যে অবশ্য বাড়ি যায় তারা।
নূরে আলম জানান, তার জন্মের চার দিন পর মা রিজিয়া বেগম মারা যান। ১৯৭৮ সালে মারা যান তার বাবা বেলায়েত হোসেন মাতব্বর। পরে স্থানীয়রা তাকে এতিমখানায় ভর্তি করে দেয়। এখানে আশ্রিত থেকে পড়ালেখা শেষ করে তিনি ফ্রেড হাইড পরিচালিত কো-ইড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩-৪ বছর শিক্ষকতা করেন। পরে চাকরি ছেড়ে সৌদি আরব চলে যান। ৯ বছর সেখানে থাকার পর বর্তমানে তিনি দেশে এসে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই কন্যা এবং এক পুত্র সন্তানের জনক। তার মেয়েরা বিবাহিত। ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র।
যেভাবে শুরু
সেদিনের জলোচ্ছ্বাসের পরবর্তী পরিস্থিতি দেখতে বাংলাদেশে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সংসদ সদস্য লেন এস রিড। তিনি উপকূলীয় দ্বীপ চরফ্যাশনে এসে অনাথ শিশুদের দেখে ব্যথিত হন। তাদের অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করে তিনি তাদের দায়িত্ব নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আলোচান করেন সরকারের সঙ্গে। প্রায় দেড় বছর সরকারিভাবে পরিচালিত হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ‘ফর দোজ হু হ্যাভ লেস’ নামক একটি সংস্থার মাধ্যমে লেন রিড চরফ্যাশন এতিমখানা পরিচালনার দায়িত্ব নেন। আর লেন রিড’র সঙ্গে আসেন চর ফ্যাশনের আরেক বন্ধু ফ্রেড হাইড। তিনি ওই এতিমখানার পরিচালকের দায়িত্ব নেন। এ সময় ইউনিসেফের অর্থায়নে এতিমখানার পাকা ভবন তৈরি হয়। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনার পর সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিলে লেন রিড ব্যথিত মনে ফিরে যান নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। অনাথ শিশুদের রেখে গিয়ে লেন রিড বেশিদিন থাকতে পারেননি নিজ দেশে। ‘হিউম্যান রাইটস ফাস্ট দ্য চাইল্ড’ নামক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে সংস্থাটির চেয়ারম্যান হয়ে এক বছর পরই ১৯৮৬ সালে তিনি চরফ্যাশনে রেখে যাওয়া অনাথ শিশুদের মাঝে ফিরে আসেন এবং ফের এতিমখানার কার্যক্রম শুরু করেন। এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এতিমখানাটি পরিচালনা করেন। ফ্রেড হাইড দ্বিতীয়বার ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত এতিমখানার পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ৯২ সালের পর বয়সের ভারে লেন রিডের পক্ষে তহবিল সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়লে তিনি এতিমখানার জমিদাতা মরহুম আব্দুল মতিন মিয়া গংদের উত্তরাধিকারী এইচ এম মাইনুদ্দিন জাহাঙ্গীরের নিকট প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব হস্তান্তর করে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। সেই থেকে মাইনুদ্দীন জাহাঙ্গীর প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে সরকারি অনুদান এবং নিজস্ব আয়ে এতিমখানাটি পরিচালিত হচ্ছে।
বর্তমান অবস্থা
১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানেরই ছাত্র ছিলেন মো. সিরাজুল ইসলাম। এখন তিনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানান, অরফেন ট্রাস্ট নামক ইংল্যান্ডের একটি দাতা সংস্থা কর্মচারীদের বেতনের কিছু অংশ (যার পরিমাণ বছরে ৫০ হাজার টাকা) অনুদান হিসেবে দিচ্ছে। এ ছাড়া সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে প্রতিবছর পাওয়া যায় ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ ছাড়া রয়েছে প্রতিষ্ঠানের খামারের মাছ ও গরুর দুধ বিক্রি, লিজকৃত জমির আয় এবং মার্কেটের দোকান ভাড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ। যার পরিমাণ বছরে প্রায় ২৫ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে ১১ জন কাজ করেছেন বিভিন্ন পদে। তাদের বেতন বছরে ১১ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। বাকি অর্থ ছাত্রদের স্টেশনারি, পোশাক, খাওয়া খরচসহ অন্যান্য কাজে ব্যয় হয়। ১৯৭২ সালে তৈরি হওয়া ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে দুটি পাকা ভবন তৈরি করা হয়।
এতিম খানার জমিদাতা মরহুম আব্দুল মতিন মিয়া গংদের উত্তরাধিকারী এইচ এম মাইনুদ্দিন জাহাঙ্গীর জানান, সরকারি এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন দাতাদের কাছ থেকে বছরে যে অর্থ পাওয়া যায় তা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কোনো রকম চলে। তবে প্রতিষ্ঠানের যে জমি আছে তাতে ভবন নির্মাণ করে মার্কেট করে ভাড়া দিতে পারলে আয় আরো বাড়ত, তবে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন অর্থ সহায়তা।
এতিম খানায় কর্মরত যারা : পরিচালক সিরাজুল ইসলাম, শিক্ষক কাম হিসাব রক্ষক ছালাউদ্দিন, শিক্ষক নজরুল ইসলাম, সুপার ভাইজার সাজাহান, ধর্মীয় শিক্ষক নেজাম্মল হক, মাঠ কর্মী আব্দুস সালাম ও সাজ্জাদ, নৈশপ্রহরী মুজাম্মেল হক, বাবুর্চি ছানা উল্যাহ, আয়া রহিমা ও জুবাইদা।