বিশ্বচরাচর ডেস্ক : অবশেষে অনাস্থা ভোটে টিকে গেল ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার। কংগ্রেসের ডাকা ‘অনাস্থাতে’ সরকার টলবে বা পড়ে যাবে, সে শঙ্কা ছিল না। এমন চিন্তাও কারও মাথায় আসেনি। তবে ক্ষমতাসীন এনডিএ জোটের দেয়ালে যে মোটেই বাতাস লাগবে না, একেবারেই ফাটল ধরবে না- এতটা নিশ্চিন্ত ছিল না খোদ বিজেপিও (ভারতীয় জনতা পার্টি)।
গত ২০ জুলাই টানা ১২ ঘণ্টার তর্ক-বিতর্ক শেষে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটাভুটি হয়। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেন ৩২৫ সংসদ সদস্য। পক্ষে ভোট পড়ে ১২৬টি।
স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় লোকসভায় অনাস্থা ভোট নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। স্পিকার সুমিত্রা মহাজন বিকেল ৬টায় ভোটগ্রহণ শুরু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু বিতর্কে বিরোধী বাম দলের ‘টানাহেঁচড়াতে’ নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যায়।
টানা ১২ ঘণ্টার বিতর্ক শেষে রাত ১১টা ১৫ মিনিটে অনাস্থা ভোট হয়। এর আগে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ভাষণ দেন নরেন্দ্র মোদি। সে সময় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীকে টার্গেট করে তোপ দাগেন তিনি।
এ নিয়ে ২৭ বার অনাস্থা ভোটের মুখে পড়ল ভারত; যার মধ্যে ২২টিতে জয়লাভ করেছে সরকার। তিনটিতে সরকারের বিপক্ষে রায় যাওয়ায় সরকারের পতন ঘটে। একটিতে ভোটাভুটি হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেন সরকারপ্রধান। দীর্ঘ ১৫ বছর পর ভারতের ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তোলে তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি)।
গত ১৮ জুলাই লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন তা গ্রহণ করেন। গত ১৮ জুলাই বিতর্ক ও ভোটাভুটির দিন ধার্য করেন তিনি। গত মার্চে ক্ষমতাসীন এনডিএ জোট থেকে বেরিয়ে যায় টিডিপি।
অনাস্থা ভোটে বিজেপিই জিতবে, এ নিয়ে কারও দ্বিধা ছিল না। সরকারের এই জয় প্রত্যাশিতই ছিল। তবে বিরোধীরা কতটা জোটবদ্ধ ছিল তা বুঝে নেয়ার পরীক্ষাই যেন ছিল এ অনাস্থা প্রস্তাব।
বিরোধী শক্তি যে এখনও ততটা মজবুত নয়, তা স্পষ্ট হলো। কারণ ভোটের সকালে এনডিএ সরকারের শরিক দল শিবসেনা ও বিজেডি জানিয়ে দেয় তারা মোদির পাশে নেই। আর এটাই ছিল কংগ্রেসের কৌশল। হয়তো এখানেই কংগ্রেসের জয়।
লোকসভায় মোট আসন ৫৪৫টি। নির্বাচিত ৫৪৩টি আসনের মধ্যে এ মুহূর্তে ৯টি ফাঁকা। ৫৩৪ আসনবিশিষ্ট লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ছিল ২৬৮টি আসন। বিজেডি-শিবসেনা ভোটদানে বিরত থাকায় ভোটার সংখ্যা কমে এখন ৪৯৭। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে তাই ২৪৯ ভোট দরকার ছিল। সংসদে বিজেপির সংসদ সদস্য সংখ্যা ২৭৪। জোটের অন্যান্য শরিক মিলিয়ে মোট ৩৩১ জন।
অধিবেশনের শুরুতে ভোটদানে বিরত থাকার ঘোষণা দেন এনডিএর শরিক শিবসেনার ১৮ সদস্য। ওয়াকআউট করেন বিজেডির ১৯ এমপি। আর বিরোধী জোট ইউপিএর ৬৩, এ ছাড়া টিডিপি ১৬, টিআরএস ১১, অন্যান্য ৩০। সব মিলিয়ে ১৫৯।
অনাস্থা প্রস্তাবের বিতর্কে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী কড়া ভাষায় বিজেপির সমালোচনা করেন। এরপরই সবাইকে চমকে দিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। এতে হকচকিয়ে যান মোদিও।
লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় ঝড় তুলেছিলেন রাহুল। বিরোধীরাও হইচই করে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছিল। এরপর আচমকাই রাহুল আসন ছেড়ে নেমে হেঁটে মোদির কাছে যান। গিয়েই তাকে উঠে দাঁড়াতে বললে মোদি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত নিজেই ঝুঁকে মোদিকে জড়িয়ে ধরেন রাহুল।
৪০ মিনিটের ভাষণে রাহুল বলেন, সবাই যত হিংসা-বিদ্বেষ করুক, ভালোবাসাই ভারতীয় সংস্কৃতি। আপনাদের প্রতি আমার কোনো ঘৃণা নেই। আপনারা আমাকে হিংসা করতে পারেন, আমাকে ঘৃণা করতে পারেন। আমাকে টিটকারি মেরে পাপ্পু বলতে পারেন। কিন্তু আপনাদের প্রতি আমার কোনো রাগ নেই, ঘৃণা নেই। আমি সবাইকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। কারণ আমি কংগ্রেস।
শুরুতে প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে কংগ্রেস সভাপতি বলেন, তিনি আমার চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না। তিনি নার্ভাস। মোদি তখন হেসে উঠে রাহুলের চোখের দিকে তাকান।
রাহুলের ভাষণের পর স্পিকারকে ধন্যবাদ দিয়ে বক্তব্য শুরু করেন মোদি। তখনই শুরু হয় সংসদের ভেতরে বিরোধীদের মিছিল। সেøাগান-শোরগোলে বারবার বাধা দেন মোদিকে। এর মাঝে মোদি বলেন, কিছু মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করছে, কেন আজকের এ দিনটি এলো। আমি মনে করি, বিরোধী দলের কিছু ব্যক্তির কারণে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আজকের এ বিতর্ক এটাই প্রমাণ করে, কিছু লোক ইতিবাচক রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন।
তার বক্তব্যের সময় ‘মোদি হঠাও, মোদি হঠাও’ সেøাগান তোলেন বিরোধীরা। মিছিল-শোরগোলে মুহূর্তে ‘মাছের বাজার’ হয়ে যায় লোকসভা। হট্টগোলে মøান মুখে মাঝে মধ্যে চুপ হয়ে যান মোদি। ভাবটা এমন যে, কথার খেই হারিয়ে ফেলেছেন। কিছুক্ষণ থেমে আবার বক্তব্য শুরু করেন মোদি।
‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ বলে মুখ খুলেন তিনি। বললেন, গত ৪ বছরে ২০ বছরের দারিদ্র্যতা থেকে বেরিয়ে এসেছে ভারত। একেক করে মুগ্ধতার অস্ত্র বের করতে থাকেন তার ঝুলি থেকে। কথার জাদু, বাচনভঙ্গি, সবাইকে তাক লাগানোর চৌকস মুখভঙ্গি। কখনও হাসতে হাসতে, কখনও অভিনয় করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করেন মোদি। মিষ্টি কথা আর হাসি-ঠাট্টার মাঝেই চড়াকণ্ঠে দেশবাসীকে দৃঢ়তাও দেখিয়েছেন তিনি।
প্রায় ১ ঘণ্টার ভাষণে অনাস্থা প্রস্তাবের সমালোচনা করে মোদি বলেন, আমার সঙ্গে বিতর্ক করার প্রয়োজন হলে কেন আপনারা অনাস্থা প্রস্তাব আনলেন।
তিনি জোরগলায় বলেন, কংগ্রেস যদি ২০১৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়, তবুও আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবো। সার্জিক্যাল স্টাইক নিয়ে রাহুলের বক্তব্যের জবাবে মোদি বলেন, ‘আমাকে যত পার অপমান কর, হেনস্তা কর। কিন্তু জওয়ানদের নিয়ে কিছু বল না। তাদের অপমান কর না।’
আগ বাড়িয়ে রাহুল গান্ধীর জড়িয়ে ধরা নিয়ে কথা বলতে ছাড়েননি মোদি। তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তি এ আসনে বসার জন্য উৎসুক। আমাকে আসন থেকে সরাতে চায়। এত তড়িঘড়ি করার কিছু নেই। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে- কে বসবে ওই আসনে।’