অন্তহীন সমস্যা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বাংলাদেশে সমস্যার অন্ত নেই; অনেক সমস্যাই গুরুতর। দুটি সমস্যা অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে- একটি প্রাকৃতিক অপরটি মানবিক। বন্যা, প্রচণ্ড দাবদাহ-খরা, নদীভাঙন ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে আজ আমরা অত্যন্ত বিপন্ন। মানবিক সমস্যাগুলোর ভেতর একটি হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনবিস্ফোরণ এখন অগ্নিবিস্ফোরণের মতোই ভয়াবহ। সেই সঙ্গে প্রতিদিন বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। গ্রামাঞ্চলে কাজ নেই তাই কাজের সন্ধানে বন্যার স্রোতের মতো মানুষ যেমন শহরমুখী হচ্ছে, তেমনি দেশ ছেড়ে বিদেশে অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমাচ্ছে। ভাসছে সমুদ্রে, শিকার হচ্ছে বিদেশের গভীর জঙ্গলের বন্দী শিবিরে নির্মম নির্যাতনের। অন্যত্র যেমন এখানেও তেমনি রাষ্ট্র চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। দোষ চাপাচ্ছে বিপদগ্রস্তদের কাঁধেই।
কোটি কোটি মানুষ আজ বেকারত্বের অভিশাপে মুহ্যমান। এরা আধুনিক শিক্ষা প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। এ দেশে যেখানে খুব বেশি হলে দুই কোটি মানুষ ভালোভাবে বসবাস করতে পারে, সেখানে এখনই আছে ১৬ কোটিরও বেশি, ২০২৫ সালে এর সংখ্যা কত দাঁড়াবে কে জানে। তখন ঘর-বাড়ি তৈরির জন্য ভূমি নিয়ে মানুষে মানুষে কাড়াকাড়ি লেগে যাবে।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ এবং সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে প্রতি বর্গমাইলে জনবসতি ১,৯৯০ জন এবং মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমি মাত্র ০০.১৪ শতাংশ। এই ভূমি আবার সব মানুষের হাতে নেই। অধিকাংশ জমির মালিক ধনিক শ্রেণি এবং দরিদ্রের ক্ষুদ্র জমিটুকু ক্রমাগত চলে যাচ্ছে দখলবাজ নব্য ধনী ভূমিদস্যু-লুটেরাদের হাতে।
ষাটের দশকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য তৎকালীন সরকার পরিবার-পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ করে। একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই কর্মসূচি চালু ছিল। কিন্তু নব্বই দশকে এসে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলে এই কর্মসূচি আর সচল থাকেনি, মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে।
আসলে শাসকশ্রেণি চাইছে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হোক। এর পেছনে রয়েছে তাদের দুরভিসন্ধি। তারা মনে করে এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, তাদের লক্ষ্য যত দ্রুত পারা যায় দেশের যা কিছু অর্থ-সম্পদ আছে তা লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করা। তাদের স্থায়ী নিবাস অন্য দেশে, ভিন্ন গোলার্ধে। ফলে অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা লুটেরা রাজনীতিকদের প্রধান তৎপরতা হলো লুণ্ঠনের। এ লক্ষ্যে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শ্রমদাস বানানোর সহজ উপায় খোঁজে।
আর এই কাজে তাদের জন্য দুটি প্রশস্ত পথ খোলা আছে। প্রথমত, পোশাকশিল্পে সস্তায় শ্রমিক জোগান দেওয়া এবং এই খাতের রপ্তানি থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পুনঃবিনিয়োগ না করে উল্টোপথে বিদেশে পাচার করা বা জালিয়াতির মাধ্যমে একটা বৃহৎ অংশ বিদেশেই রেখে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, বিদেশের বাজারে শ্রমিক রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার নামে আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার করা।
শাসকশ্রেণি কখনই বৃহৎ বিনিয়োগে উৎসাহী নয়। তাদের উৎসাহ ফটকাবাজারিতে। শ্রম-শোষণভিত্তিক পোশাক রপ্তানিতে বিদেশ থেকে যে কাঁচা পয়সা আসে তা সহজেই লুণ্ঠন করা যায়। অন্য দিকে জনগণের অর্থে পরিচালিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দিলেও চলে। আর এ জন্যই দেশের বাজারে পোশাকশিল্পের জন্য সস্তায় শ্রমিক প্রয়োজন এবং বৈদেশিক মুদ্রার জন্য প্রয়োজন বিদেশে শ্রমদাস প্রেরণ।
জনসংখ্যার আধিক্য ও দারিদ্র্যের কারণে এখানে সস্তায় শ্রম-শোষণ সহজ বলে পোশাকশিল্পের এই রমরমা বাণিজ্য, যার পুরোটাই শ্রমিক শোষণের ওপর নির্ভরশীল। এটা বিদেশি ক্রেতারাও ভালো বোঝে। অন্যদিকে জনশক্তি আমদানিকারক দেশগুলোতে সস্তায় শ্রম কে দেবে? বাংলাদেশের দরিদ্র জনশক্তিই তাদের ভরসা। বাংলাদেশি অদক্ষ শ্রমিকরা বিদেশে নিম্নমানের, বিপজ্জনক ও অমানবিক কাজ করেÑ যা অন্য দেশের শ্রমিকরা করতে সম্মত হয় না। তারা রক্ত-ঘামে ঝরা বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠায়। কিন্তু সে মুদ্রা আত্মসাৎ করে ধনীরা।
বর্তমান সরকারকে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে উৎসাহী বলেই মনে হচ্ছে। ইতোমধ্যে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ১৬ এবং ছেলেদের বয়স ২১ থেকে ১৮-তে নামিয়ে আনা হয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম বাল্যবিবাহের দেশ এই বাংলাদেশ। উষ্ণম-লীয় আবহাওয়ার কারণে এমনিতেই বাংলাদেশে জন্মহার অধিক। তার ওপর কম বয়সে বিয়ে ও বাল্যবিবাহ মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। পৃথিবী যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এ দেশের সরকার শ্রেণিস্বার্থে তখন পেছনের দিকে লগি ঠেলছে।
চীনের সরকার যদি এক সন্তান নীতি গ্রহণ না করত তাহলে তাদের জনসংখ্যা ইতোমধ্যে দ্বিগুণের অধিক হতো। তারা কঠোরতার সঙ্গে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করে। ফলে জন্মহারে এক পর্যায়ে স্থিতি আসে। আজ চীন বিশ্বের সবচেয়ে আর্থিক ও সামাজিকভাবে সচ্ছল দেশে পরিণত। এই সাফল্যের পেছনে প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আগামীতে বিপুল মানুষের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যবস্থা কিভাবে হবে সেই মূল প্রশ্লে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করার বিকল্প নেই। এ অবস্থায় বিশেষ করে বিবেকবান মানুষ ও তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় সামনে এক অশুভ সময় আসছে। সে সময় পুরো দেশটাই মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। তখন এই ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে এ দেশকে আর উদ্ধারের উপায় ও সময় থাকবে না।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়