
নিজস্ব প্রতিনিধি : অবিশ্বাস্য, অভাবনীয় এক নিয়ম করেছে চীন। চরম অসম্মানজনক, অমর্যাদাকর এই ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের ওপর। চীন সরকারের প্রবর্তিত ব্যবস্থা অনুযায়ী চীনের ঋণে চীনের কোনো কোম্পানি, নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান কোনো অপরাধ বা ভুলত্রুটির কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ ব্যাহত হলে এবং আর্থিকভাবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের কোনো থানায়, কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে মামলা, নালিশ দায়ের করলেও বাংলাদেশের কোনো আদালত, কোনো কর্তৃপক্ষ তার বিচার করতে পারবে না। বিচার হবে চীনে। গত জানুয়ারিতে চীনা কর্তৃপক্ষ এ-সংক্রান্ত খসড়া প্রস্তাব বাংলাদেশে পাঠায়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা এর বিপক্ষে মত দেয়। এ মাসে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে বিভিন্ন দিক বিবেচনায় চীনের প্রস্তাব সংশোধিত আকারে মেনে নেওয়ার পক্ষে মত দেওয়া হয়। তবে তার আগে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের শর্তাদি নমনীয় পর্যায়ে আনার চেষ্টা করতে বলা হয়।
বাংলাদেশের অবকাঠামো, অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। রেল, সড়ক, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কয়লা আমদানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু চীনা নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান কোম্পানিগুলোর বেনিয়া, অতি মুনাফাখোরি আচরণ ও অসৎ কার্যকলাপ বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্তও করছে। জোট সরকারের সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করার কাজ নেওয়া হয় চীনের অর্থায়নে। চীনের নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানকে কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। চীন কর্তৃপক্ষের শর্ত অনুযায়ী সরকারকে তা মেনে নিতে হয়। অথচ দেখা গেল, চীনা ঠিকাদার মাটি ভরাট কাজই করেনি। কাজ না করে প্রকল্প ব্যয়ের বড় অংশ তুলে নেয়। এর আগে বিএনপি সরকারের সময় সিলেটে দুটি ডাই-অ্যামোনিয়া ফসফেট কারখানা নির্মাণ করা হয় চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায়। নির্মাণকাজ শেষ করে সমস্ত পাওনা পরিশোধের ছয় মাসের মধ্যেই একটি ফ্যাক্টরি অচল হয়ে যায়। অপরটিতে ব্যাপক যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। বর্তমান সরকারের সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের আখাউড়া-আশুগঞ্জ অংশের নির্মাণকাজে ব্যাপক ত্রুটি ধরা পড়ে। বাংলাদেশ রেলওয়ে তাদের সরবরাহ করা নিম্নমানের মালামাল গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। শেষ পর্যন্ত চীন সরকারের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশকে চীনা কোম্পানির অনৈতিক কাজ মেনে নিতে হয়। আরো বেশ কয়েকটি প্রকল্পে প্রচলিত আর্থিক রীতিনীতির বিরুদ্ধ অনেক কিছুই বাংলাদেশ মেনে নিতে বাধ্য হয়। চীন কর্তৃপক্ষ সর্বশেষ শর্ত জুড়েছে, তাদের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন কোনো প্রকল্প একতরফাভাবে ঋণদান স্থগিত ও বাতিল করতে পারবে চীন। চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নকালে কোনো ত্রুটি, বিচ্যুতি, আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির জন্য বাংলাদেশে কোনো কর্তৃপক্ষ, আদালতে নালিশ, মামলা দায়ের করতে পারবে না। মামলা হলে তা হবে চীনে। সেখানেই বিচার, সালিস হবে। বাংলাদেশ ও চীনা কর্র্তৃপক্ষকে তা মেনে নিতে হবে। চীন নতুন শর্ত দিয়েছে যে তাদের ঋণের জন্য ২ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। এ ছাড়া শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে ম্যানেজমেন্ট ফি এবং সমহারে কমিটমেন্ট ফি দিতে হবে। কোনো দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এই হারে ম্যানেজমেন্ট ফি ও কমিটমেন্ট ফি নেয় না। ভারত ও চীন ছাড়া জাপান, কোরিয়াসহ কোনো দেশই এ হারে ফি নেয় না। বিশ্বের বৃহৎ ঋণদানকারী বিশ্বব্যাংকও কমিটমেন্ট ফি ও ম্যানেজমেন্ট ফি নেয় না। অন্যদিকে জাপান, কোরিয়া, ভারত যেখানে ৩০ বছরের মরিটরিয়াম দিচ্ছে, সেখানে চীন মাত্র ২০ বছরের মরিটরিয়াম দিচ্ছে।
বাংলাদেশ চীনে মামলা দায়ের, নিষ্পত্তির শর্ত মেনে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। চীন ও বাংলাদেশের স্থলে তৃতীয় কোনো দেশ ও সংস্থায় মামলা, সালিস দায়ের ও নিষ্পত্তির প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। চীনের ঋণদানের অপরাপর শর্ত মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ।