ড. এবিএম এনায়েত হোসেন :
পৃথিবীতে মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষারা প্রতি মানুষের শ্বাশতঃ ও অকৃত্রিম অনুরাগ। মানব শিশু, যেকোন ভাষা-ভাষীর হোক না কেনোÑ মা ডাকটিই প্রথম মুখে ফোটে। মায়ের যত্ন, সেবা এবং প্রয়োজন মাফিক স্তন্যদান এক অবিস্মরণীয় মায়া-মমতারই পরিচায়ক। এজন্য সব সম্প্রদায়েই মায়ের অবদান ও অবস্থান বিশেষভাবে পূজনীয়। অবশ্য পরিবেশ-প্রতিবেশ কিংবা পরিস্থিতি বা অর্থনৈতিক কারণে এসব ক্ষেত্রে কোনরূপ ব্যত্যয় যে ঘটে না, এ কথা বলা চলে না। সন্তান কর্তৃক মায়ের প্রতি অসম্মান, অনাদর বা অত্যাচারের চিত্রও দেখা যায় সমাজে।
উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে আমাদের সর্বংসহা মা-জননী মোসাম্মৎ মেহেরুন্নেছা খাতুন একজন মহিয়সী নারী। যাঁর গর্ভে আমরা মোট আট ভাই ও তিন বোন জন্মলাভ করেছি। হয়েছি তাঁরই আদরে লালিত-পালিত। প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে ‘অধিক সন্তান-দারিদ্র্যের লক্ষণ’ হলেও আমরা সেই অর্থে কখনো দরিদ্র ছিলাম বলে মনে হয় না। তবে হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান হয় না, তেমনি শিক্ষা-দীক্ষা ও জীবনে প্রতিষ্ঠালাভে আমরা সবাই সমক্ষক হইনি! আমরা চার ভাই স্নাতক বা স্নাতকোত্তর হলেও অন্য চার ভাই ডিগ্রি লাভ করতে সক্ষম হননি। অথচ, সবারই বর্ণমালা বা অক্ষর পরিচিতি ও প্রাথমিক শিক্ষালাভ ঘটেছে মায়েরই কাছ থেকে। তাছাড়া আমাদের সেজ ভাই (এস এস এম বদিউজ্জামানÑ ওরফে ‘বুদো’) ছিলেন আসলে বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী।
বাবা-মায়ের অনেক চেষ্টা ও তৎপরতা সত্ত্বেও সেজ ভাই লেখাপড়া শিখতে পারেননি! না সাধারণ শিক্ষা, কিংবা মাদ্রাসার লাইনে। ফলে দৈনন্দিন বাজারের হিসেবটাও সেজ ভাই ঠিকমত মেলাতে পারতেন না। কিন্তু মাদ্রাসা লাইনে ক্বারি সাহেবের কাছে পড়াশুনা করার সুবাদে গ্রামবাসীরা তাকে ‘মৌলভী সাব’ বলেই সম্বোধন করতো। মায়ের মুখে শুনেছি, সেজ ভাই নাকি একদিন কলুর ঘানিতে চড়েছিলেন। আর সেদিনই নাকি একটা দুর্ঘটনা ঘটে! ঘানি থেকে সেজ ভাই (বুদো) চিৎপটাং হয়ে পড়ে যান। মাথায় বেশ চোট লাগে। সেই থেকেই মৌলভী সাহেবের মাথায় মাঝে-মধ্যে ব্যথা করতো। মায়ের ভাষ্য মোতাবেক, ঘানি থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পাওয়াতেই সেজ ভাইয়ের বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কী ব্যাপারটা তাই? কারণ, সেজ ভাই ঘানি থেকে পড়ে গিয়েছিলেন বলতে গেলে তাঁর যৌবনকালে! শৈশবে এবং কৈশরে লেখাপড়া শিখতে না পারাটা কোনক্রমেই যৌবনের আঘাত পাওয়ার সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে না।
যা হোক, তাই বলে মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা বা যত্ন-আত্তির কমতি ছিলো না তাঁর কোন সন্তানের জন্যই। কারণ, মা কখনো আমাদের সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজে কিছুই মুখে দিতেন না। সে নাস্তা, দুপুরের ভোজন কিংবা রাতের আহার হোক না কেন! প্রচলিত প্রবচন মোতাবেক ‘পিছিয়ে পড়া বা হতচ্ছাড়া বাউন্ডেলে সন্তানের প্রতিই মায়ের চিন্তা হয় বেশি’ অনুযায়ী মায়ের আদর ও স্নেহ-ভালোবাসার তারতম্যও কোনদিন দেখিনি। আমার অগ্রজ একেএম জাহিদ হোসেন (ওরফে নন্টু) যদিও বয়সে আমার থেকে ছয় বছরের বড়, কিন্তু খাওয়া-দাওয়া ও জামা-কাপড়সহ নানা বিষয়েই আমাকে ঈর্ষার চোখে দেখতো। খাওয়া-দাওয়া এবং বিশেষ করে মিষ্টান্নের প্রতি আমার শৈশব থেকেই অধিকতর লোভ। অথচ, নন্টু ভাই ঠিক আমার বিপরীত মেরুর লোক। বিল থেকে মাছ মেরে এনে নন্টু ভাই একটা ভাঁজা কিংবা একটা তরকারির মাছ পেলেই খুশি। কিন্তু আমার ভাঁজা মাছও চাই, আবার তরকারির মাছও পাওয়া চাই! ফলে প্রায়ই নন্টু ভাই রাগে গর-গর করতে করতে বলতোÑ
-‘দাও, দাও! তোমার আদরের ছোট ছেলেকেই খাওয়াও। অন্যরা কেউ পাক বা না পাক, তাতে কিছুই আসে যায় না! তোমার হা-ভাতে ছেলেকে পেট ভরে খাওয়াও’।
মা সচরাচর মুখে কিছুই উচ্চবাচ্য করতেন না। কোনদিন হয়তো বা একটু স্মিত হেসে বলতেন
-‘থাক, না বাবা, নন্টু! ও তো ছেলে মানুষ। বেশি কিছু বোঝে না! বড় হলে আর এমনটা করবে না, দেখিস’।
মায়ের অসীম ধৈর্য্য, কম কথা বলা আর সহনশীল শক্তির কাছে এসব ছোট-খাটো অভিযোগ খুবই তুচ্ছ। খাওয়ার ব্যাপারে মায়ের মিতাচার এবং দরিদ্র পাড়া-পড়শি কিংবা ফকির-মিসকিনদের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম দয়া, মাকে সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা বললেও অত্যুক্তি হবে না! কারণ, আমার জানা মতে মায়ের কাছে কেউ কোনদিন অভূক্ত থেকে খাদ্যের জন্য হাত পেতে নিরাশ হতে হয়নি।
অন্যদিকে মায়ের ভালোবাসা ও আদর-যত্ন কখনো একপেশে বা পক্ষপাতমূলক ছিলো বলে মনে হয়নি। মায়ের আন্তরিক সেবা আমাদের সবগুলো ভাই-বোনদের জন্যই ছিলো অবারিত ও স্বতঃস্ফূর্ত। আর এর প্রমাণও আমরা পেয়েছি অজস্র।
একদিন সেজ ভাই হঠাৎ করেই আমাদের ভিতর বাড়ির উঠানে কাঁপতে কাঁপতে ফিট হয়ে পড়ে যান। মা রান্নাঘর থেকে ত্বরিৎ বেরিয়ে এসেই সেজ বাইয়ের সেবা শুশ্রুষায় লেগে গেলেন। কাকে যেনো অনুরোধ করলেন
-‘জলদি একটা চা-চামচ নিয়ে আসো’।
সম্ভবত সেজ ভাবিই (গুলবাহার বেগম) রান্নাঘর থেকে একটা চায়ের চামচ এনে মায়ের হাতে দিলেন। সেজ ভাইয়ের সারা শরীরে তখন চলছে অবিরাম খিঁচুনি। দাঁতে দাঁত লেগে আছে। মুখ দিয়ে থুথু উঠছে ফেনা হয়ে। পড়শিরা উৎসুক হয়ে ভিড় জমিয়েছে উঠোনে। নানাজনের নানারকম মন্তব্যের মধ্যে কেউ কেউ বলছে যে, ‘তাড়াতাড়ি মৌলভী সাবকে একটা চামড়ার জুতা বা স্যান্ডেল আনে নাকের সামনে ধরেন’। আবার অনেকেই বলাবলি করছে যে, ‘মৌলভী সাবকেহ মৃগী রোগে ধরিছে’।
এসব মন্তব্যের কোন উত্তর না দিয়ে মা যখন চামচটা জোর করে সেজ ভাইয়ের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন, এর কিছুক্ষণ পর থেকেই আস্তে আস্তে সেজ ভাইয়ের খিঁচুনিটা কমতে থাকলো। পরে সম্পূর্ণরূপেই বন্ধ হয়ে গেলো। সেজ ভাই সুস্থ হয়ে উঠোনের মধ্যে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু তখন কে জানতো যে, একদিন এই মৃগী রোগই সেজ ভাইয়ের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে! তার অন্তিম নিঃশ্বাস নিতে হবে আমাদের পুকুর ঘাটে পানি আনতে গিয়ে?
যা হোক, গ্রামীণ অনেক বসতবাড়ির মতোই আমাদের উত্তর ও পশ্চিম পাশে অনেকগুলো কলাগাছের ঝাড় শোভিত। রুম্ভি (স্থানীয়ভাবে রুম্বি) বা রম্ভা, চাঁপা, সবরি, কাঁচকলা ও দয়া কলার জাত। এদের মধ্যে সবচাইতে মোটাসোটা আর লম্বা হলো দয়া কলার জাতটা। এসব কলাগাছ নানাভাবে উপকারী। কাঁচকলা সবজি হিসেবে গ্রামবাংলায় সারা বছর পাওয়া যায়। তাছাড়া কাঁচকলা পেটের পীড়ার মহৌষধ। অন্যান্য কলা ফল হিসেবে বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত উপাদেয় ফল। আর পাকা দয়া কলা যদিও বীজবহুল, তথাপি খেতে খুবই মিষ্টি, শীতল এবং আমাশয়ের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। ভাটি অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে অনেকেই কলাগাছের ভেলায় চড়ে ওদিক-ওদিক যাতায়াত করতে পারে। তাছাড়া কলার মোচা ও থোড় গ্রামবাংলার এক সুস্বাদু ব্যঞ্জন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কলাগাছের ঝাঁড়গুলো বসতবাড়ির জন্য এক ধরনের প্রাকৃতিক আব্রু হিসেবে কাজ করে থাকে। এ বিষয়টি হয়তো অনেকের কাছেই অজানা। কারণ, বসতবাড়ির পিছন দিকটায় সচরাচর থাকে পায়খানা, পেসাবখানা ও মহিলাদের স্নানাগার। সুতরাং, মহিলাদের আব্রু রক্ষা করার লক্ষ্যে প্রাকৃতিক পর্দা হিসেবে কলাগাছের কোন বিকল্প আছে বলে আমার মনে হয় না।
পাঠকদের হয়তো মনে হতে পারে, আমি ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাইছি। আসলে মায়ের অকৃত্রিম স্নেহের বাস্তব দৃশ্য দেখবার মতো সৌভাগ্য হয়েছিলো এই কলাগাছেরই কল্যাণে। এবার তারই বর্ণনা দেবার প্রচেষ্টা। একদিন দপুর গড়িয়ে যাবার কালে আমি মাকে খাবার দিতে বলবো বলে রান্নাঘরের দিকে যাই। কিন্তু তখন রান্নাঘরের পেছনে চীৎকার, কান্না ও ঝাঁপটানোর শব্দ শুনতে পাই! আমাদের পাতকুয়াটার পশ্চিম দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া! কারণ, তখন দেখি সেজ ভাই (মৌলভী সাহেব) মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়িতে ব্যস্ত। গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর পরণে উল্টো ভাঁজ করা লুঙ্গিটা খাটো করে কোমরে গুঁজে রাখা। মায়ের হাতে একটা খালি চটের বস্তা। আর ঐ বস্তা দিয়েই মা অক্লান্তভাবে সেজ ভাইকে ঝাঁপটা মেরে যাচ্ছেন। সেজ ভাই কান্নাজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে যাচ্ছেন
-‘মা! ও মাগো! আমারে তো কামড়ায়ে মারে (মেরে) ফেলালো!’
-‘কী আর করবি, বাবা? মৌমাছির চাকের উপর কলাগাছটা কেটে ফেলেছিস! একটু সহ্য কর’।
সেজ ভাইয়ের করুণ অবস্থা দেখে আমি এগিয়ে গিয়ে মাকে সাহায্য করতে উদ্যত হলাম। কিন্তু মা বারণ করলেন কাছে যেতে। বললেন
-‘ছোটকা! এদিকে আর এগোস না। মৌমাছিরা যেভাবে বেড়ে ধরেছে, শেষে তুইও আমার মতো কামড় খাবি’।
মায়ের বারণ শুনে আমি থমকে গিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে চারদিকটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। দেখলাম যে, এক কান্দি কাঁচা-পাকা, দু’একটা অর্ধেক বাঁদুর খাওয়া অবস্থায় দয়াকলাসহ সেজ ভাইয়ের কাঁটা গাছটি দক্ষিণ দিকের ঝোঁপালো লতাপাতা দিয়ে ঘেরা হিজল গাছটার উপর গিয়ে পড়েছে। হিজল গাছের হেলানো কান্ডেই ছিলো একখানা বন্য মৌমাছির বড় চাক! সেজ ভাই হয়তো মৌচাকখানা দেখতে পাননি, কিংবা বুদ্ধি করে কলাগাছটাকে এমনভাবে দা দিয়ে কুপিয়ে কাঁটা উচিৎ ছিলো, যাতে করে এটি হিজল গাছের দিকে না পড়ে!
যাই হোক না কেন, কলাগাছটি হিজল গাছের উপর আঁছড়ে পড়ায় ঝঁাঁকে ঝাঁকে ক্ষুব্ধ মৌমাছি উড়ে এসে সেজ ভাইকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। তার হাত-পা, গায়ে এবং মুখমন্ডলে হুঁল ফুটিয়েছে দেদারছে। মা প্রাথমিকভাবে সেজ ভাইয়ের চিৎকার ও কান্নাকাটি শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে দু’হাত দিয়ে মৌমাছিদেরকে তাড়াতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে তেমন একটা ফল না পেয়ে উপায়ন্তর না দেখে রান্নাঘরের বারান্দায় পড়ে থাকা একটা খালি চটের বস্তা নিয়ে ঝাঁপটানো শুরু করেন। এতে কিছুটা সফল হয়ে শেষ পর্যন্ত মা ঐ চটের বস্তাটা দিয়েই সেজ ভাইকে ঢেকে দিলেন। এতে কাজ হলো! কিন্তু সেজ ভাইকে বাগে না পেয়ে মাকেও বেশ কয়েকটা হুঁল ফুটিয়ে মৌমাছিরা তাদের চাকের দিকে ফিরে যেতে লাগলো।
মা সেজ ভাইকে মাটির উপর থেকে হাত ধরে উঠিয়ে এনে সেজ ভাইয়ের ঘরের বারান্দায় বসালেন। তারপর তাঁর শরীর থেকে এক এক করে মৌমাছির হুঁলগুলোকে তুলে ফেললেন। কিন্তু শেষ রক্ষা তাতেও হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেজ ভাইয়ের শরীরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো। মাকে দু’চারটে হুঁল ফুটিয়েছিল বিধায় তার ক্ষেত্রে তেমন কিছু হলো না। কিন্তু সবচাইতে অবাক করার মতো বিষয়টা ছিলো যে, সেজ ভাইয়ের এমন বিপদেও সেজ ভাবির পক্ষ থেকে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না! না সাহায্যের হাত বাড়ানো, না সহানুভূতি প্রকাশ! দিব্বি তিনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পাতকুয়াটার কাছে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকেই অবাক বিস্ময়ে সন্তানের প্রতি মায়ের অকৃত্রিম, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রমাণ দেখলেন!