অবরুদ্ধ নজরে দেখি বাংলার মানচিত্র

উইলি সুলতানা

আমিও তো দেখেছি, ঊষা লগ্নে ঘুম ঘুম চোখে শিউলি গাছের তলায় শুভ্র ফুলের চাদর বিছানো।
আমিও তো দেখেছি, কচুপাতার উপর
এক পায়ে দাঁড়িয়ে টলমলে বৃষ্টিজলের আকুলতা।
আমিও তো শুনেছি আঁধারের মাঝে রাতের পাখির কিচিরমিচির কথোপকথন।
ঝোপঝাড় হতে ভেসে আসা ভীরু ডাহুকের ডাক।

আমিও তো দেখেছি, গাছের ছায়াতলে ক্লান্ত চরণে উদ্ভ্রান্ত চোখে ঘামে ভেজা অবস্রান্ত ঝিমিয়ে পড়া পথিকের শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু।
আমিও তো দেখেছি, লাঠির ভরে পথ চলতে চলতে অন্ধ বৃদ্ধা ভিখারির জীর্ণশীর্ণ দেহে বেঁচে থাকার হাহাকার।
আমিও তো দেখেছি, দুঃস্বপ্নের মতো কুকুরের গা ঘেঁষে অনাহারি বৃদ্ধকে তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে খাচ্ছে ত্তঁচলাকুড়ের উচ্ছিষ্ট খাবার।

আমিও তো দেখেছি, ট্রাফিক সিগন্যালে অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে, নগ্ন পায়ে তপ্ত রোদ্দুরে, গাড়ির শার্শি ছুঁয়ে পিছু ছুটে চলেছে মূর্ছে যাওয়া ফুলের তোড়া হাতে কাঙাল বালক-বালিকা।
আমিও তো দেখেছি, ছিন্ন বস্ত্রে সদ্য ফোঁটা যৌবন উঁকি দেওয়া কিশোরীর আতঙ্ক,
শকুনের লোলুপ চাহনির কাছে অবনত নিজেকে ঢেকে রাখার অপ্রাণ চেষ্টা।
আমিও তো দেখেছি, রেললাইনের ধারে কঙ্কালসার দেহে পথকলির কাঁধে কুড়ানো কাগজের ভারী চটের বোঝা।

আমিও তো দেখেছি, অবৈধ সম্পর্কের পরিণতি, ঘাতক প্রেমিকের কাছে পরাজিত প্রেমিকার বুক ভাঙার বিকট
শব্দ, ক্রোধে দিশাহারা উন্মাদ প্রায় যুবতীকে অন্ধকার পথে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ইতিহাস।
আমিও তো দেখেছি, কল্পনার রাজ্যে ভাসমান
স্বপ্নে বিভোর তরুণীর গলায় শুকিয়ে যাওয়া
বকুল ফুলের মালা।
আমিও তো দেখেছি, সংসার ভাঙার মানুষিক পীড়ন আর দুর্ভাগ্যের লজ্জায় নুয়ে পড়া রমনীর জীবনের কাছে আত্মসমর্পণ।

আমিও তো দেখেছি, বৃষ্টিজলে কাকভেজা নিরীহ মায়ের ছেঁড়া আঁচলের আবরণে ক্ষুধার্ত কোলের শিশুর চিৎকার।
আমিও তো দেখেছি, জ্যোৎস্না ধৌত ম্লান আকাশের নিচে ফুটপাথে অচেতন প্রায় হতদরিদ্র মানুষের শান্তিপূর্ণ নিদ্রা।
আমিও তো দেখেছি, গৃহকর্তার লালসার নিষ্পেষণে সম্ভ্রম হারিয়ে লাঞ্ছিত কাজের মেয়েটির ওষ্ঠে কাঁপন, অসহায় দৃষ্টির নীরব কান্না।

আমিও তো দেখেছি, অভাবের সংসারে বইয়ের ভেতর ডুবে থাকা তরুণীকে রাতের আঁধারে গলির মোড়ে বিড়ি হাতে রঙিন সাজে অঙ্গরাগে ছিনাল হতে।
আমিও তো দেখেছি, বস্তির সেই ঘুপচি ঘরটিতে চটের বস্তায় মোড়ানো সাত বছরের ধর্ষিতা শিশুর পচে যাওয়া গলিত লাশ।
আমিও তো দেখেছি, উলঙ্গ দেহে নিজেকে আত্মরক্ষার নিরুপায় চেষ্টা, ধর্ষকদের কাছে আর্তনাদে ভেঙে পড়া নির্যাতিত নিপীড়িত এক গৃহবধূ।

সমগ্র সম্প্রদায় উন্মুক্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত!
আজও তো আমি দেখি প্রাঞ্জল আকাশে কত শত তারাদের জীবনের মূল্যবোধ থেকে অভিমানে খসে পড়তে।
আগুনের মতোই নির্মম সমাজ প্রতিবাদে গনগনিয়ে ওঠে।
বিচারের অসঙ্গতির কারণে আবার নিভেও যায়।
নপুংসক সমাজের মিথ্যে প্রসব বেদনার কঠিন যবনিকা উন্মোচন কবে হবে তা কেউ জানে না।
অবরুদ্ধ নজরে বাংলার এই দুর্বোধ্য আহাজারির পেছনে দায়ভার কার?
শুধুই কী আমার?
না আমাদের সবার?
-নিউইয়র্ক।