অবশেষে ‘ট্রাম্প শো’র অবসান

জুডিথ বাটলার : ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌজন্য বজায় রাখতে পারবেন না এবং দ্রুতই তার প্রস্থান ঘটবে- এ বিষয়ে কখনোই কোনো সংশয় ছিল না। শুধু একটি প্রশ্ন আমাদের মাঝে ছিল, তা হলো পতনের সময় ট্রাম্প কতটা আগ্রাসী হয়ে উঠবেন?

আমরা জানি, ক্ষমতায় থাকার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প যেকোনো কিছুই করতে পারেন, কারণ এটা তার চূড়ান্ত পরাজয়। ট্রাম্প দেখিয়েছেন যে, তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রভাবিত এবং ধ্বংস করতে চান। তিনি যে হুমকি দিয়েছেন তা মূলত নিজের ভিত্তি মজবুত করার জন্যই। আইনজীবীদের একটি দল এমনকি সরকারের পক্ষে কাজ করা আইনজীবীরাও তার পক্ষে কাজ করছেন, যা গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি গণতন্ত্রের ক্ষতি করার চিন্তা করতে পারেন। কিন্তু আমেরিকার গণতন্ত্রের কাঠামোয় আঘাত করে ভোট দেওয়ার অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদানকারী নির্বাচনী নীতিমালা ও আইনগুলো ভেঙে ফেলার চিন্তা করা আর সেটিকে বাস্তবে পরিণত করা একেবারেই ভিন্ন বিষয়।

আমরা যখন নির্বাচনে গিয়েছিলাম, আমরা জো বাইডেন/কামালা হ্যারিসকে ভোট দিচ্ছিলাম না, আমরা ভোট দিয়েছিলাম সম্ভাবনার পক্ষে, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্বাচনী গণতন্ত্রের পক্ষে। আইনের ধারণা হলোÑ আইন আমাদের অধিকারকে সুরক্ষিত করে এবং আমাদের পদক্ষেপকে নির্দেশ করে; কিন্তু তা এখন মামলা-মোকদ্দমার ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়েছে।

ট্রাম্প তার ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য করার জন্য আদালতে যান। তিনি ভোট গণনা শেষ করার আহ্বান জানান (অনেকটা তার কোভিড পরীক্ষার সমাপ্তির আহ্বানের মতো), বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন এবং সত্য বা মিথ্যা হিসেবে বিবেচিত সব বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পেছনে তিনি একমাত্র কারণ হিসেবে বলেন, এখানে বেশি পরীক্ষা হওয়ায় আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি। পরীক্ষা কম হলে অবস্থা খারাপ মনে হবে না।

নিশ্চিত পরাজয়ের ভয়ে গত ৩ নভেম্বর সকালে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে ভোট গণনা বন্ধ করতে বলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভোট গণনা অব্যাহত থাকলে বাইডেন সেগুলোতে অনায়াসেই জয়ী হবেন। পরাজয়ের বিষয়টি চিন্তা করে তিনি নাগরিকদের ভোটাধিকারের বিষয়টি অবজ্ঞা করেন এবং ভোট গণনা বন্ধ করতে চান। আমেরিকার নির্বাচনে ভোট গণনার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লেগে যায়, এটাই স্বীকৃত। তাহলে তাড়া কিসের? দ্রুত ভোট গণনা বন্ধ হয়ে গেলে জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন ট্রাম্প। আমরা সকলে জানি তিনি কেন ভোট গণনা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। নির্বাচনে কোনো জালিয়াতি হয়নি, তাহলে তিনি কেন তা বন্ধ করবেন? যদি জালিয়াতির অভিযোগে মামলা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ভোট গণনা স্থগিত হয়, তাহলে তিনি নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে এক ধরনের অবিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে পারেন। তবে, সে সিদ্ধান্তও নির্ভর করে আদালতের ওপর। অবশ্য ট্রাম্প কল্পনা করেছিলেন আদালত তাকে আবার ক্ষমতায় বসাবেন।

ফ্যাসিবাদ ও অত্যাচার অনেক রূপ ধারণ করে, বিশেষজ্ঞরা যেমনটি পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে আমি তাদের সঙ্গে একমত হতে চাই না, যারা দাবি করেন যে, জাতীয় সমাজতন্ত্র এমন মডেলে রয়েছে যার দ্বারা সমস্ত ফ্যাসিবাদীর রূপ চিহ্নিত করা উচিত। ট্রাম্প হিটলার নন এবং নির্বাচনী গণতন্ত্র কোনো সামরিক যুদ্ধও নয়। ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে, যখন মিত্রবাহিনী এবং রেড আর্মি নাৎসিদের প্রতিরক্ষা দুর্গ জয় করেছিল, হিটলার তখন পরিবহন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্প এবং জনসাধারণের অন্যান্য সুবিধা ধ্বংস করার আদেশ দিয়ে জাতিকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার সঙ্গে তার জাতিও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল।
ট্রাম্প বর্ণবাদী সহিংসতায় উচ্ছ্বসিত জনতার সামনে প্রচার চালানোর সময় তিনি তাদের একটি সাম্যবাদী শাসনের (বাইডেন) হুমকির হাত থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেষে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কামালা হ্যারিসকে মারাত্মকভাবে কটাক্ষ করে বলেন, কেউ ওকে পছন্দ করে না। ও কখনোই আমেরিকার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হতে পারবে না। যদি তা হয় তাহলে সেটি আমেরিকার জন্য অপমানজনক।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যে নিজেকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করেছেন; কিন্তু প্রত্যেকেই জানেন তিনি নির্বাচিত হননি, অন্তত এখন পর্যন্ত নির্বাচিত হননি। ফক্স তার এমন দাবি মেনে নেয়নি এবং রিচার্ড পেনস বলেছেন, প্রতিটি ভোট গণনা হবে। যদি তিনি পরাজিত হন, তিনি চেষ্টা করবেন নিজের মতো করে আমেরিকার গণতন্ত্রকেও ডুবিয়ে দিতে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করলে অনেকেই হাসাহাসি করেন, এমনকি তার অনেক বন্ধু তাকে ‘ট্যাক্সি’ বলে সম্বোধন করেন। এরপর তিনি নিজেকে একজন শক্তিশালী ধ্বংসকারী হিসেবে আচ্ছন্ন রেখেছেন। তিনি যত ইচ্ছা মামলা করতে পারেন। কিন্তু আইনজীবীরা যদি ছড়িয়ে থাকেন, তাহলে আদালত ক্লান্ত হয়ে পড়বে এবং তখন ট্রাম্প নিজেকে ট্রাম্প নামক দ্বীপের শাসক হিসেবে আবিষ্কার করবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ইতিহাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে উদাহরণ হয়ে থাকবেন, যিনি গণতন্ত্র সমর্থনকারী আইনগুলো ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে হয়তো তার বিশ্রামের ব্যবস্থাও হলো।

লেখক : অধ্যাপক, কম্পারেটিভ লিটারেচার অ্যান্ড দ্য প্রোগ্রাম অব ক্রিটিক্যাল থিওরি, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া।