অভিনন্দন সাফ ফুটবল বিজয়ী বাংলার বীর কন্যারা

অভিনন্দন! অভিনন্দন!! অভিনন্দন!!! দেশজুড়ে অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসছেন সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২-এর বিজয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সদস্যরা। বাংলাদেশের মানুষকে আনন্দের উপলক্ষের চেয়ে বিষাদের মধ্যেই বসবাস করতে হয় অধিক। পুরুষদের ফুটবল বা ক্রিকেটে কোনো আনন্দ সংবাদ নেই। সেখানে নারী ফুটবল দলের দক্ষিণ এশিয়া জয় অবশ্যই এক তুলনাহীন আনন্দ সংবাদ জাতির জন্য।
সব প্রবাসীর হয়ে ঠিকানাও জানায় বিজয়ী বীর নারী ফুটবলারদের অভিনন্দন। শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা। প্রবাসীরাও এই বিজয়ে গভীরভাবে আনন্দিত। দেশবাসীর সঙ্গে প্রবাসীরাও আনন্দের জোয়ারে ভাসছেন। নিউইয়র্ক প্রবাসীদের আরো আনন্দের উপলক্ষ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭৭তম সাধারণ অধিবেশন যোগ দিতে নিউইয়র্কে এসেছিলেন।

এবার প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে সম্পাদকীয় লিখলে একটুও অপ্রাসঙ্গিক হতো না। তিনি সাধারণ অধিবেশনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। বলেছেন বিশ্ব শান্তি নিয়ে। সভ্যতার-বিশ্বমানবতার সংকট নিয়ে। সংকটের ধরন ও তার সমাধান নিয়ে। বলেছেন বাংলাদেশের মানুষ শান্তিতে বিশ্বাসী, যুদ্ধে নয়। তাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী কুপ্রভাব এবং বর্তমান সৃষ্ট সংকট নিয়ে কথা বলেছেন। বলেছেন বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ানো রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের কথা। বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নিপীড়ন এবং গণহত্যার আতঙ্কের মধ্যে দেশ ছেড়ে, সহায়-সম্বল ও প্রিয়জন হারিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য যা এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক নানাবিধ সমস্যা তৈরি করছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতিও ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এসব কিছু নিয়েই সম্পাদকীয় লেখা যেতে পারত। সবগুলোই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকতার দাবি রাখে।

এর বাইরে দেশে রাজনৈতিক উত্তাপও দিন দিন বেড়েই চলেছে। দুই দল-আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যেভাবে রাজনৈতিক বাহাসে মেতে উঠছে, তাতে যেকোনো সময় সে উত্তাপ আগুন লাগিয়ে না দেয়-সেই আশঙ্কা। এ ছাড়া বৈশ্বিক সংকটের কারণে হোক কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে হোক, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির জন্য সাধারণ মানুষের জীবনে যে নাভিশ্বাস উঠেছে, এসব বিষয় নিয়েও সম্পাদকীয় লেখা যেত সহজেই। লেখা যেত হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা নিয়েও।

কিন্তু সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ঠিকানার সম্পাদকীয় বোর্ড নারী ফুটবলারদের সাফ জয়কেই নির্বাচন করেছে এ সপ্তাহের সম্পাদকীয় বিষয়। ঠিকানা মনে করে, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন সংবাৎসরিক বিষয়। প্রতিবছরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই অধিবেশনে যোগ দিতে আসেন। ভবিষ্যতেও আসবেন। দুর্গাপূজাতেও আমরা প্রতিবছর উৎসবে মেতে উঠব। এ নিয়ে অতীতেও সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, ভবিষ্যতেও লেখা হবে। দেশের রাজনীতি, দ্রব্যমূল্য বা অন্য যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও ঠিকানা সব সময় লেখালেখি করে যাচ্ছে। কিন্তু সাফ ফুটবলে যে জয় বাংলার নারীরা এনে দিলেন, তা তো সহজে মেলে না। এবারই প্রথম। আবার কবে এ জয় দেখা দেবে-কে জানে!

ঠিকানা তাই সাফ ফুটবলে নারীদের এ বিজয়কেই যথার্থ বিষয় বলে নির্বাচন করেছে সম্পাদকীয়র জন্য। রাজনীতি যেমন জাতিকে বিভক্ত করে, দেখা গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেকোনো খেলাধুলায় বিজয় বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দেয়। তারা একসঙ্গে সবাই রাস্তায় নেমে আসে আনন্দ করতে। আগুন দিয়ে জ্বালাও-পোড়াও করতে নয়। তাই নির্বাচনের বিজয় দলীয় বা ব্যক্তিগত হলেও ক্রীড়াঙ্গনের বিজয় জাতীয়। সব মানুষের, দলমত নির্বিশেষে। বাংলার মেয়েদের সাফ ফুটবল বিজয়কে ঘিরেও তাই বাংলার মানুষের মনে, আকাশ-বাতাসে কেবলই আনন্দ আর আনন্দ। দলের ক্যাপ্টেন সাবিনা, কৃষ্ণা, সানজিদা, ঋতু, মণিকা, রূপা, ইয়াসমিন, শিউলিরা যে বিজয় জাতিকে উপহার দিয়েছেন; তাতে ভেসে গেছে সব বিভক্তি, বিষাদ, মালিন্য, হিংসা-বিদ্বেষ। বাংলার ১৭ কোটি মানুষ এ আনন্দে শরিক। তারা আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিভেদ ভুলে গেছে। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে কি না-তা নিয়ে কোনো বিবাদ নেই। শুধু বিজয়ের আনন্দ। বীর কন্যাদের অভিনন্দন আর অভিনন্দন।
সবার প্রার্থনা, সাবিনাদের এ বিজয় যেন অব্যাহত থাকে। বিজয়ের এই হাসি মানুষের মুখে অটুট থাকুক। বিজয়ের এই আনন্দকে ধারণ করে কয়েকটি আশঙ্কার কথাও বলে নেওয়া জরুরি। যারা আজ এ রকম একটি জয় জাতিকে এনে দিয়েছেন, তারা যেন হারিয়ে না যান অযত্নে, পরিচর্যার অভাবে, কূট-ক্যাচালে। পরিচর্যা, সেবা, যত্ন না পেলে কোনো কিছুই সতেজ থাকে না। বিকশিত হয় না। অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার দম পায় না। আনন্দ না থাকলে মনও উদ্দীপনা খুঁজে পায় না। এ কথাও দায়িত্বপ্রাপ্তদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সব মানুষই বর্তমানের অর্জনের পাশাপাশি ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কথাও ভাবতে থাকেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো দেশে যেকোনো মানুষকে তার বর্তমানের কর্মের ফসল দিয়েই ভবিষ্যৎ পাড়ি দিতে হয়। রাষ্ট্রের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা মানুষকে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা দেয় না। আজকের বিজয়ী বীরদের একদিন এই বয়স থাকবে না। বিজয় ছিনিয়ে আনার শারীরিক সক্ষমতাও থাকবে না। খোলা ছাদ সংবর্ধনাও থাকবে না। যা আজ তাদের জাতীয় পর্যায়ে এবং নিজ নিজ অঞ্চল পর্যায়ে দেওয়া হচ্ছে, তাও হারিয়ে যাবে। তখন কি আজকের বিজয়ীরা ভবিষ্যতে দুস্থ খেলোয়াড় হিসেবে জীবন কাটাবেন?
ওরা যত বেশি ভবিষ্যতের ভাবনামুক্ত হবেন, জাতিকে ওরা তত বেশি দিতে পারবেন। সবচেয়ে বেশি জরুরি আর্থিক প্রণোদনা দানের বিষয়টি। দেখা যায়, ক্রিকেটে অভিজাত এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান যত আসে, ফুটবলে ঠিক উল্টো চিত্র। ওদের অনেক লড়াই-সংগ্রাম, সামাজিক-আর্থিক প্রতিকূলতা পার হয়ে আসতে হয়। ফুটবলার এবং অন্যান্য ক্রীড়াক্ষেত্রে মেয়েদের বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিছু মোড়ল, টাউট-বাটপার, বখাটে শ্রেণির মানুষ। গ্রাম্য ফতোয়াও ওদের পথে প্রাচীর রচনা করে। তাদের প্রতিপত্তির কাছে স্থানীয় কোনো কোনো রাজনীতিবিদ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষতিপয় সদস্যও বিরোধিতায় নেমে পড়েন।

বিষয়গুলো উপর মহলের মানুষ, যারা ক্ষমতা নিয়ে বসে আছেন, তাদের খুব বেশি করে ভেবে দেখা দরকার। মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুও অনেককে এগিয়ে আসার পথে ভয়ংকর বাধা সৃষ্টি করে। তারা যেন মেয়েদের উঠে আসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে, এ জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ ছাড়াও প্রগতিশীল শক্তিকেও তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। উঠে আসার পথে সব দুয়ার উন্মুক্ত রাখতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আরো একটি কথা বলা জরুরি, আজ মেয়েরা পারছে, ছেলেরা পারছে না কেন? সব দিক থেকে মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি সুযোগ পেয়েও ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে কেন? বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের খুব করে ভেবে দেখার সময় এসেছে। ছেলেরা যদি শতবার দেখেও না পারে, তবে কিন্তু মেয়েদের বিজয়, মেয়েদের সাফল্য জাতিকে শতভাগ আনন্দ দিতে পারবে না। জাতি শতভাগ বিজয় দেখতে চায়।

নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২২-এ বাংলাদেশের মেয়েদের এ বিজয় নিয়ে সর্বশ্রেণির মানুষের এত উচ্ছ্বাস, এত আনন্দের কারণ গত ১৯ সেপ্টেম্বর সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন ২০২২ এর ফাইনালে নেপালের দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে স্বাগতিক মেয়েদের শুধু পরাজিত করা নয়, সবগুলো খেলায় সব দলকেই তারা পরাজিত করেছে। নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়েছে। ওই একটি মাত্র গোলই বাংলাদেশের জাল স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছে। ভারতের মতো দলকেও বাংলার মেয়েরা ৩-০ গোলে হারিয়েছে। এ বিজয়ের আনন্দই আলাদা। তাই তো ২১ সেপ্টেম্বর বাংলার বিজয়ী মেয়েরা বিজয়মালা পরে দেশের মাটিতে ফিরে এলে তাদের ছাদখোলা বর্ণাঢ্য বাসে বর্ণিল এক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আর সেই সংবর্ধনায় নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ এবং ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই বিজয় মিছিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। জয়তু বাংলার বিজয়ী মেয়েরা।