অভিনেতা মোশাররফ করিম বিতর্ক ও ধর্ষণের পেছনের কিছু কথা

মাহবুব মানিক

বর্তমানে বাংলাদেশে আলোচনার অন্যতম বিষয় হচ্ছে ধর্ষণের পেছনে কী দায়ী? অভিনেতা মোশাররফ করিমও এ বিষয়ে একটি মন্তব্য করে ফেঁসে গেছেন, আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু বিতর্কের বাইরে গিয়েও যদি খুঁজতে চেষ্টা করি, সত্যিকার অর্থেই ধর্ষণের পেছনে দায়ী কী? মেয়েদের পোশাক নাকি পুরুষের মানসিকতা।

প্রথমেই যদি বলি অবশ্যই পুরুষের মানসিকতা দায়ী তাহলে এক শ্রেণির পুরুষ আমাকে নাস্তিক বানিয়ে গালি দেবে। সুতরাং একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে লিখতেও খুব সংকোচ বোধ করছিÑ সাধারণ মানুষদের গালি সহ্য করার ক্ষমতা অনেক কম হয়।

অবাক লাগে এই জন্য যে, যারা নোংরা গালি দিলো তারা আবার নিজেকে জাহির করবে ইসলামের ঝা-াধারী হিসেবে। যদিও গালি ইসলাম ধর্ম কখনোই অনুমোদন করে না। তাদেরকে অনুরোধ করছি, গালি দেওয়ার আগেই সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ুন। মতপার্থক্য হলে যুক্তি দিয়ে আপনার মত প্রতিষ্ঠিত করবেন। আর যদি কেউ গালি দেন তবে বুঝতে হবে, সেটাও আপনার নৈতিকতার অবক্ষয়ের মধ্যেই পড়ে।

একটা পুরুষ কিন্তু হঠাৎ করে পুরুষ হয় না। একটা নিষ্পাপ শিশু থেকে ধীরে ধীরে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হয়ে ওঠে। যে ধর্ষণ করছে সেও কোনো এককালে নিষ্পাপ শিশু ছিল। ধর্ষণের প্রতিবাদে শামিল যে ব্যক্তি সেও ওই নিষ্পাপ শিশুই ছিল, লুতুপুতু টাইপের শিশু। আবার যে নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বা ধর্ষণের প্রতিবাদ করছে সেও নিষ্পাপ শিশু থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েছে।

শিশু থেকে ধীরে ধীরে প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার পেছনেই সব রহস্য লুকিয়ে। কয়েকটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের মাঝেই সব লুকিয়ে। একটা নিষ্পাপ শিশু পরিবার থেকে কতটুকু নৈতিকতা শিখছে? ভালো-খারাপ কাজ আলাদা করতে কতটুকু পারছে? বাবা-মা খারাপ কাজ করছে নাকি ভালো কাজ করছে? স্কুলের সহপাঠীরা কেমন আচরণ করছে? পাড়া-প্রতিবেশী বা খেলার সাথী কী ধরনের ব্যবহার করছে? গৃহ শিক্ষক কেমন আচরণ করছে? তার উপরে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব কতটুকু পড়েছে ইত্যাদি।

এখানে শিশু বলতে শুধু ছেলে শিশুর কথা বলা হয়নি। মেয়ে শিশুও আছে। আমাদের দেশে ডিজিটাল ছেলেমেয়ের মিউচুয়াল সেক্সের পরেও কিন্তু তাদের মতপার্থক্য থেকে ধর্ষণের অভিযোগ রূপ নেয়। কাজেই সব ক্ষেত্রেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করাটাই মূখ্য।

আগেই বলেছি, প্রতিটি শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশের উপরে নির্ভর করে সে কেমন হবে। একটা শিশু ইউরোপ-আমেরিকাতে বড় হওয়া আর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা কিন্তু এক বিষয় নয়। পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে যেটা সুস্থ সমাজ আপনার দৃষ্টিতে সেটা নোংরা। আবার আপনার দৃষ্টিতে যেটা সুস্থ সমাজ ইউরোপিয়ানরা বলবে গো-ামিÑ এটাই স্বাভাবিক। সবকিছুই দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল।

দৃষ্টিভঙ্গি জিনিসটা হঠাৎ করে তৈরি হয় না, আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে। প্রতিটা অপরাধের পেছনেই হিউম্যান সাইকোলজি কাজ করে। একটা জিনিস কী ভেবে দেখেছেন? যারা ধর্ষণ করে তারা কোন শ্রেণির মানুষ? তারা হয়তো, অল্পশিক্ষিত, গরিব, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদী বা এলাকার প্রভাবশালী। এর মানে এটা বলছি না যে, শিক্ষিত ধনীদের মধ্যে ধর্ষণের প্রবণতা কম। তারাও ধর্ষণ করে তবে সেটা মিউচুয়াল সেক্স এর আড়ালে। তবে সেটা যখন দরকষাকষিতে মতপার্থক্য দেখা দেয়, সেটা হয় তখন ধনীদের ধর্ষণ।

এইচএসসি পড়ার সময় প্রাণিবিজ্ঞানে একটা অধ্যায় ছিল মানব প্রজননতন্ত্র। সেখানে পড়েছিলাম যে, নারী ও পুরুষ যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখন একে অপরের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ তৈরি হয়। এই যে একটা পয়েন্ট ‘আকর্ষণ তৈরি হয়’ এটাই মূলত সবকিছুর মূলে দায়ী। আবার আকর্ষণ না তৈরি হলেও পৃথিবী থেকে মানবজাতি বিলীন হয়ে যেত। তাহলে আপনি যদি আস্তিক হন, তাহলে বলবেন এটা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত, নাস্তিক হলে প্রকৃতি প্রদত্ত।

এখন কথা হচ্ছে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হলেও সেটা কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দুটি উপায়ে এই আকর্ষণ জিনিসটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রথমত, ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা, দ্বিতীয়ত, সামাজিক আইন-কানুন বা বিধি-নিষেধ। যখন মানুষ দুটো জায়গা থেকেই বিমুখ হয় তখন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যার ফলাফল ধর্ষণ।

ধর্মীয় শিক্ষা বা সামাজিক শিক্ষা কেউ হঠাৎ করে আয়ত্ব করতে পারে না। একটা কোমলমতি শিশু বড় হতে হতে ধীরে ধীরে আয়ত্ব করতে থাকে। কেউ যদি প্রকৃত ধার্মিক হয় তার দ্বারা এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আবার দেশে যদি ধর্ষণের প্রকৃত বিচার ও শাস্তি কঠোর হয় সেক্ষেত্রেও ধর্ষণ বন্ধ হয় বা বড় জনসংখ্যার বিচারে বলা যায় অনেক কমে যায়। কারণ বড় জনগোষ্ঠীতে স্যাডিস্ট পিপলেরও অভাব নেই।

অনেকে যুক্তি দিয়ে বলতে পারে, তাহলে মাদ্রাসার হুজুর বা ধর্মীয় লেবাসের মানুষও তো অনেক সময় ধর্ষণ করে, তাহলে? এখানে যুক্তি হচ্ছে, ধরন যে আপনি পুলিশের পোশাক পড়েছেন, আপনি কি পুলিশ হয়ে যাবেন? আপনাকে সরকারের খাতায় নিবন্ধিত থাকতে হবে, প্রকৃত ট্রেনিং থাকতে হবে। আমরা পোশাক দিয়ে একজন মানুষকে বিচার করতে পারি না- এটা সমাজের একটা ভুল ধারণা, ভুল শিক্ষা।

একজন মানুষের নৈতিকতার মাপকাঠি কিভাবে বিচার করবেন? ধরা যাক, একটা মেয়ে ছোট পোশাক পড়ে আপনার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। তাকে ধর্ষণ করলে দেশে আপনার কোনো বিচার হবে না। আপনাকে কেউ কিছু বলবে না। তার থেকে আপনার শরীরে শক্তিও অনেক বেশি। এখন আপনি কি করবেন? আগে পিছে কি হবে এসব না ভেবে ধর্ষণ করবেন? নাকি এটা ভাববেন যে, আপনি যদি ধর্ষণ করেন তাহলে নিজের বিবেক এর কাছে দায়ী থাকবেন। এটা অন্যায়! সৃষ্টিকর্তার কাছে দায়ী থাকবেন! কাজটি ঘৃণিত! এসব ভেবে বিরত থাকবেন? যদি বিরত থাকেন, চোখ নামিয়ে সেখান থেকে চলে আসতে পারেন তাহলে আপনি নৈতিক শিক্ষা লাভ করেছেন।

ধর্ষণ হয় মূলত নিজের উপর নিয়ন্ত্রণহীনতার জন্য। যার নিয়ামক নৈতিক শিক্ষা লাভ। মেয়েদের পোশাক কেমন হবে সেটা পরের আলোচনা।

আগেই বলেছি, দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপারটা এলাকাকেন্দ্রিক এবং সমাজের উপর নির্ভর করে। মেয়েদের পোশাক যদি ধর্ষণের অন্যতম কারণ হতো তাহলে ইউরোপ আমেরিকার রাস্তায় অহরহ ধর্ষণের ঘটনা ঘটত। নিজেও ইউরোপে থাকি, রাস্তাঘাটে বাস্তবে এমন কিছু আমার চোখে পড়েনি। বহু পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রেও বেড়াতে গিয়েছি, গাছে চিপায় বা ঝোঁপ জঙ্গলের মধ্যে কাউকে বিকৃত যৌনাচার করতেও দেখিনি।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এটা বাংলাদেশে দেখা যায়। কারণ, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি একটু অন্য রকম। অনেকেই পরিসংখ্যান টেনে বলবেন, ওইসব দেশে ধর্ষণের হার মুসলিম দেশ থেকে অনেকগুণ বেশি। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, এসব দেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো। দরকষাকষিতে টান পড়লে সেটা ধর্ষণ, নয়তো মিউচুয়াল সেক্স। যেমন বলা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বর্তমানে যেসব নারী ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে আসছে, তার প্রায় সবগুলাই ছিল মিউচুয়াল সেক্স।

তবে হ্যাঁ, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মেয়েদের লম্বা পোশাক পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আসলে সৃষ্টিকর্তা কোনো কিছু না বুঝে তো আর নির্ধারণ করেন না। অবশ্যই মানতে হবে, এটা ধর্ষণ কমানোর একটা অন্তরায়। আবার ওই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অথবা প্রকৃতিগত দিক দিয়ে নারী-পুরুষের নৈতিকতায় পাশ করাটাও ধর্ষণ কমানোর অন্তরায়। ব্যাপারটা এমন যে, সমাজ সংস্কৃতি বুঝে আমি পোশাক পড়াব আবার নৈতিক দিক দিয়েও আমি স্বচ্ছ থাকব।

আপনি যদি দেখেন, কোনো একটা জিনিস সমাজে অপরাধ বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাহলে অবশ্যই সেটা আইন করে দমিয়ে রাখতে হবে। ছোট পোশাক একটা ইউরোপিয়ান সমাজে যতটা প্রভাব ফেলবে তার থেকে শতগুণ বেশি প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায়। কারণ দৃষ্টিভঙ্গি এভাবেই গড়ে উঠেছে। ইউরোপিয়ান লোকজন সমাজে ছোট পোশাক পড়া মেয়ে দেখছে, তাদের সাথে মিশেছে, গল্প করেছে, সেক্স করছে কারণ, সবকিছু একটা ব্যালেন্সড অবস্থায় আছে। আমাদের মতো দেশে এটা অসম্ভব, কারণ আমাদের ধর্ম এটা কোনোভাবেই অনুমোদন করে না।

ইউরোপিয়ান কালচার আমাদের ধর্ম অনুমোদন করছে না; কিন্তু আকাশ পথে বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই কালচার দেশে ঢুকছে। ব্যাপারটা দ্বিমুখী হয়ে যাচ্ছে। ফলাফল দাঁড়াচ্ছে, যে বিপথগামী মানুষ ছোট কাপড় পরা মেয়ে দেখছে টিভি সিনেমায়, অথচ সমাজে এমন ছোট কাপড় পড়া মেয়ে নাই। আবার পতিতালয়ে ও যাওয়ার মতো সাহস বা ইচ্ছা নাই অথচ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। তখন এসব মানুষগুলোর অনিয়ন্ত্রিত আকর্ষণের বলি হচ্ছে অবুঝ মেয়ে শিশু থেকে শুরু করে বোরকা পড়া বৃদ্ধা নারীও! এরা এক কথায় স্যাডিস্ট এ পরিণত হচ্ছে, এরা সমাজের অপরাধী মানুষ।

উপরের আলোচিত বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল। নানা মতের মানুষের নানা মত তৈরি হবে। তবুও বলতে হয় সুস্থ পরিবেশ সমাজে প্রয়োগ করার জন্য আমাদের দুটি পথ উন্মক্ত আছে। বিজাতি কালচার দেশে আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে, অথবা বিজাতি কালচার যা আমদানি হচ্ছে তা সমাজে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ তুলে নিতে হবে যা কি না অসম্ভব।

দেশে যদি কোনো মানুষ যদি গার্লফ্রেন্ডসহ হোটেল বা বাসা বাড়িতে ধরা খায় তার এবং তার জাতগোষ্ঠী জনসাধারণ ধুয়ে দেয়। তাকে বলা হয় দুঃশ্চরিত্র, লম্পট। এটাকে ধরা হয় নৈতিক অবক্ষয়। অথচ ইউরোপিয়ানরা বাবা মায়ের পাশের ঘরে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুমায়, অথচ সে নৈতিকতার পরীক্ষায় পাস। ওই যে বললাম, দৃষ্টিভঙ্গি। এখানেই এপারে-ওপারে আকাশ-পাতাল ব্যবধান।

আবার যেহেতু ধর্ম আমাদের নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি সংকীর্ণ জীবনযাপনের শিক্ষা দেয়, সুতরাং পশ্চিমা সংস্কৃতি বন্ধ করে নিজেদের সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে শিশুদের বিকশিত করতে হবে। পরিবেশটাও সেভাবে সাজাতে হবে। নতুন প্রজন্মকে ধর্মীয় কালচারেই বড় করতে হবে।