নামটা সাপ্তাহিক ঠিকানার প্রধান সম্পাদক প্রিয় মুহম্মদ ফজলুর রহমানের পরামর্শেই বেছে নিলাম। ঠিকানা পত্রিকার সম্পাদক লাবলু আনসার, বার্তা সম্পাদক মিজানুর রহমানও বলছিল ঠিকানার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে একটা লেখা দিতে। বলেছিলাম আপনাদের পত্রিকাতে প্রতি সপ্তাহেই আমার লেখা কিছু না কিছু তো যাচ্ছেই, আলাদাভাবে বর্ষপূর্তি নিয়ে কী লিখি। তখনই ফজলু ভাই পত্রিকার সম্পাদকমÐলীর সভাপতি অনুজপ্রতিম এম এম শাহীনের কক্ষ থেকে বেরিয়ে উল্লিখিত শিরোনামে একটা লেখা দিতে বলেন।
সাপ্তাহিক ঠিকানা যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীদের জীবনে আরেক ঠিকানা, নিঃসংকোচে বলা যায়। এই প্রবাসে নিউইয়র্কে কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকা ঠিকানার আগেও প্রকাশিত হতো, এখনো হচ্ছে। বলতে গেলে প্রতি সপ্তাহে নিউইয়র্ক থেকে দশের অধিক বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়। এসবের মধ্যে ‘ঠিকানা’ একটি বিশেষ জায়গা দখল করে নিতে পেরেছে বাংলাদেশি অভিবাসীদের যাপিত জীবনে। খবরের পরিবেশনা, ধরন ও নানান বিচিত্রতার কারণেও। পাশাপাশি ঠিকানার সঙ্গে যারা আগে জড়িত ছিলেন এবং এখনো যারা আছেন তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, পেশাগত মান ও দক্ষতাকেও অগ্রাহ্য করা যাবে না।
সাপ্তাহিক ঠিকানা তার ২৮ বছর অতিক্রম করে ২৯-এ পা দিল। ঠিকানা ২১ ফেব্রæয়ারি ২০১৮-তে একেবারে টগবগে যৌবনে, ঠিকানা তাই যেকোনো যুদ্ধেও যেতে পারে। আপাতত একটা যুদ্ধ তো ঠিকানা করছে। এই শহরের প্রতিটা সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা সম্প্রতি বিনা মূল্যেই পাঠকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। সেখানে একমাত্র সাপ্তাহিক ঠিকানাই বিনা পয়সায় পাঠকের কাছে যাচ্ছে না। এটা একরকমের যুদ্ধ চলতি চাহিদার বাজার এবং এর প্রতিযোগিতায়। ১ ডলার দিয়ে কিনতে হয় সাপ্তাহিক ঠিকানা। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ঠিকানার এই সিদ্ধান্ত সঠিক এবং এটাই অক্ষুণœ থাকুক। পয়সা দিয়ে পাঠক যখন ঠিকানা পত্রিকা কিনে পড়ছেন, নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে বৈকি এর ইতিবাচক ভ‚মিকা আছে অভিবাসী পাঠকের কাছে। ঠিকানা কোনো প্রকার গড্ডালিকা স্রোতে না চলুক। এই যুদ্ধ বা লড়াইয়ে প্রমাণিত হবে অভিবাসীদের যাপিত জীবনে সাপ্তাহিক ঠিকানার ভ‚মিকা এবং আবেদনের গুরুত্ব। আজ থেকে ২৮ বছর আগে উত্তর আমেরিকায় সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে ঠিকানার যাত্রা শুরু। এর আগে ১৯৮৮ সালে সম্ভবত ২১ ফেব্রæয়ারিতে সাপ্তাহিক ঠিকানার অন্যতম অধিকর্তা ও মালিক এবং সম্পাদকমÐলীর সভাপতি এম এম শাহীনের সম্পাদনায় প্রকাশিত একটি সংকলনের নামও ছিল ‘ঠিকানা’। সাপ্তাহিক ঠিকানা নামটি এম এম শাহীনের ব্রেইন চাইল্ড বলা যায়। আমার সুযোগ হয়েছিল সেদিন এম এম শাহীনের সঙ্গে বসে সাপ্তাহিক ঠিকানার শুরু নিয়ে কিছু কথা শোনা ও জানার।
এম এম শাহীন বাংলাদেশের একজন প্রাক্তন সাংসদও ছিলেন। সিলেটে তার এলাকা কুলাউড়াতে বেশ জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব শাহীন। অত্যন্ত বিনয়ী ও ভদ্র এম এম শাহীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে ছিলেন জার্মানিতে। দেশ ছেড়ে প্রবাসী হয়েছেন ১৯৭৮-এ। একসময় জাসদ রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন, পরে সাপ্তাহিক ঠিকানার আত্মপ্রকাশ ঘটান। ১৯৮১-তে চলে আসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। শুরু থেকেই নানা সংগঠন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে যুক্ত ছিলেন। একসময় তারা কয়েকজন মিলে গঠন করেন বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা। উল্লেখ্য, এই লীগ অব আমেরিকার একটি অনুষ্ঠানে প্রকাশিত সংকলনের নাম ছিল ‘ঠিকানা’।
শাহীনের কথামতো সব সময় তার ইচ্ছা ছিল অভিবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে স্থানীয় যোগাযোগ বা একটা ঠিকানা হয়ে কাজ করার এবং নিজস্ব কমিউনিটির প্রবাসে বিকাশে এর সহায়ক এবং বন্ধু হিসেবে থাকার। এই মনোভাব থেকেই তার নেতৃত্বে এবং পরিকল্পনায় সাপ্তাহিক ঠিকানার আত্মপ্রকাশ। বিনয়ের সঙ্গেই এম এম শাহীন স্মরণ করেন ঠিকানা পত্রিকার যাত্রাকালে যাদের চিন্তা, পরিশ্রম, পরিকল্পনা এবং সুনেতৃত্বে ঠিকানা তার পথচলা শুরু করে। এদের মধ্যে অন্যতম সাপ্তাহিক বাঙালী পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক কৌশিক আহমেদ এবং একসময়ের বাংলা পত্রিকারও মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক মাহবুবুর রহমানকে। এই পত্রিকার গুণগত মান গঠনে কৌশিক আহমেদের তৎকালীন ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে মনে করেন এম এম শাহীন।
’৯০-এর শুরুতে এম এম শাহীন বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে বিএনপি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর দীর্ঘ একটানা লম্বা সময় ঠিকানাকে নেতৃত্ব দেন ও পরিচালনা করেন এম এম শাহীনের ইমিডিয়েট বড় ভাই অনুজপ্রতিম সাঈদ-উর-রব। প্রবাসীদের কাছে ঠিকানাকে আরো ব্যাপক ভ‚মিকা পালনে এবং বিকাশে সাঈদ-উর-রবের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং দৃঢ় নেতৃত্ব বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে ঠিকানার জনপ্রিয়তাকে আরো বেশি গ্রহণীয় করে গড়েছেন সাঈদ-উর-রব নিজেও। ঠিকানার গুরুত্ব ও ভ‚মিকা অভিবাসীদের কাছে আজ যে সফলতার চ‚ড়ায় এর পেছনের নেতৃত্ব বিগত এক যুগ পালন করেছে সাঈদ-উর রব।
সময়ের পরিক্রমায় ঠিকানায় যোগ দেন আরেক বিনয়ী, গুণী ও প্রবাসের অনেকের কাছে ভীষণ শ্রদ্ধার মানুষ মুহাম্মদ ফজলুর রহমান। ফজলু ভাই দীর্ঘ একটানা কয়েক বছর এই পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। বর্তমানে এর প্রধান সম্পাদকের আসনে বসে কাজ করছেন। ফজলু ভাইয়ের জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে নিউইয়র্কের অভিবাসীদের কাছে সাপ্তাহিক ঠিকানার গুরুত্বকে আরেক মাত্রায় সহযোগিতা করছে বলা যায়।
এই অভিবাসে আমাদের সংখ্যা বাড়ছে, সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে সংগঠন। নানান কর্মকাÐ, ব্যবসা-বাণিজ্য। রাজনৈতিক উৎসব অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এর কোনোটাতেই অভিবাসী বাংলাদেশিরা অন্য কোনো গোষ্ঠী বা কমিউনিটি থেকে পিছিয়ে নেই। আমাদের নিজেদের দুটি টিভি চ্যানেলও আছে। এগুলোর যত রকম ইতিবাচক বিকাশ ও বৃদ্ধি এর সবকিছুর সঙ্গে সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল, যুক্ত আছে। এখানে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচার ও প্রসারে মালিক বা কর্তৃপক্ষ তাদের প্রচারে সাপ্তাহিক ঠিকানাকে একধরনের স্ট্যাটাস কোর মধ্যেই বিবেচনা করেন। প্রবাসে এখন অভিবাসীদের নানা ব্যক্তিগত প্রতিভার, দক্ষতার বিকাশে ঠিকানা সবার একরকম ডানা যেন। ঠিকানা এদের পাশে থাকে, ছিলও সব সময়। ঠিকানায় বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপনের চাহিদাও বেশি। কারণ পত্রিকাটার পাঠক কমেনি, বাড়ছেই। এটাও তো এক নিদর্শন, ইতিবাচক নিদর্শনই অভিবাসীদের কাছে ঠিকানার জনপ্রিয়তা মেপে দেখার এবং ঠিকানার ভ‚মিকা কতটা ব্যাপক, তা বুঝে নেওয়ায়।
লেখক, কবি, গল্পকার, প্রবন্ধকারÑএই প্রবাসে বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেকেই আছেন। বলতে গেলে তাদের সবার জনপ্রিয়তা এবং পরিচিতির প্রচারে ঠিকানার কাছে এই গোষ্ঠীর ঋণ অপরিসীম। পত্রপত্রিকা মূলত একটি সমাজ এবং সেই সমাজব্যবস্থার অবকাঠামোর দর্পণ। সাপ্তাহিক ঠিকানাও এই যুক্তরাষ্ট্রে তেমনি অভিবাসীদের যাপিত জীবনের দর্পণ। যুক্তরাষ্ট্রের কেবল একটি রাজ্য নিউইয়র্কেই এর বাজার বা চাহিদা এবং সরবরাহ অন্যান্য সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকার মতো সীমিত নয়। শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম প্রান্ত, মধ্য রাজ্য ও উত্তরের অনেক অঙ্গরাজ্যেও ঠিকানা যাচ্ছে। এসব রাজ্যের বাঙালি পাঠকরাও ঠিকানা পড়েন।
অভিবাসীদের যাপিত জীবনে এর ভ‚মিকা না থাকলে এতটা পথ ও সময় সাপ্তাহিক ঠিকানা সফলতার সঙ্গে অতিক্রম করতে পারত না।
সব পাঠকের চাওয়া বা সন্তুষ্টি কোনো প্রচারমাধ্যম বা পত্রিকা পূরণ করতে পারে না, ঠিকানাও এই না পারার ঊর্ধ্বে নয়। কোনো কোনো পাঠক বলেন আমি ঠিকানা পড়ি না, কেউ বলেন ঠিকানাতেও ইয়েলো জার্নালিজম চলে! হয়তোবা কখনো কখনো এই কথা সত্যিও হয়। পাঠকের প্রত্যাশা পূরণে ঠিকানাকে আরেকটু পরিচ্ছন্ন বা চুজি হলে ভালো হবে। যেমন কারো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিজ্ঞাপন বা কোনো শুভেচ্ছাবাণী বা দলীয় রাজনীতির খবরাখবর পরিবেশনে আরেকটু চিন্তাশীল ও ক‚টনীতিক হওয়া। হ্যাঁ এটা ঠিক, প্রচারে অন্যকে সতর্ক বা নিজেকেও শুধরানোরও সুযোগ থাকতে পারে; কিন্তু পাশাপাশি এতে নিজেদের কমিউনিটির নেতিবাচক চিত্রটাও কখনো কখনো ব্যক্তির একেবারে ব্যক্তিগত ইমেজকেও ক্ষুণœ করে। আমরা মানুষ, ফেরেশতা তো নই। তাই সবার দোষ-ত্রæটিকে অভিবাসী সমাজে প্রকটভাবে প্রকাশ করে দেওয়ার ব্যাপারে আরেকটু কৌশলী হলে ভালো। আরেকটি বিষয় কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতেও পারে। এখানে কবিতা, প্রবন্ধ, বিশ্লেষণ বা আলোচনায় প্রবাসীদের লেখাকে সব সময় অগ্রাধিকারে রাখা।
পত্রিকার চিঠিপত্রের পাতাকে আরেকটু বৃদ্ধি এবং আকর্ষণীয় করা যায় কি না, এটাও ভাবা যেতে পারে।
পত্রিকার ছাপার মান এবং এর গুরুত্বে সাপ্তাহিক ঠিকানায় একধরনের উপেক্ষা বা কম যতœবান বলে মনে হয়।
এসবের মানোন্নয়নে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এবং এর জোগানের একটা ঝুঁকি ও চাহিদা তো অবশ্যই আছে। তাই আমরা যারা ঠিকানার আরো প্রসার ও বিকাশে আশাবাদী, তারা যেন ঠিকানার পৃষ্ঠপোষকতায় কার্পণ্য না করি, দ্বিধা না করি। ঠিকানা এখন ঠিকানার ভেতরে যে আট-দশ জন পরিশ্রম করেন তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
ঠিকানা এই প্রবাসে অভিবাসীদের আরেক ঘর। এর যতœ নিতে আমরা সবাই যেন আরেকটু যতœবান হই।
অভিবাসীদের যাপিত জীবনের মহাসড়কে সাপ্তাহিক ঠিকানা আমাদের জীবনবোধের উইন্টারে কমফোর্টার, সামারে টি-শার্ট।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক