অভিবাসীর যাপিত জীবন (২৮)

মাহমুদ রেজা চৌধুরী

শপ্-লিফটিং বলতে কোন জিনিস কেনার ছলে দোকান থেকে জিনিসপত্র চুরি করাকে বোঝায়। দেশে থাকতেও কথাটা শুনেছি, যারা বিদেশ থেকে যেতেন, তাদের কারো মুখে। তখন এটা নিয়ে ভাবনা হতো না। এ দেশে আসার পর বিষয়টাকে খুবই মজার বলে মনে হতো, এখনও হয়। মনে হবার একটা বিশেষ কারণ- বিলেত এবং এই যুক্তরাষ্ট্রেও এই শপ্-লিফটিং আচরণ বা স্বভাবটা ধনিক শ্রেণি এবং কোন কোন সেলিব্রিটির মধ্যেও আছে। এটা এক রকম অসুখও বটে। মানুষ বা বিশেষ করে উচ্চবিত্ত শ্রেণির কেউ কেনো শপ্-লিফটিং করে, মাঝে মধ্যে ভাবায়। অনেক বছর আগে আমার এক কলিগ বলেছিলো, সে নাকি এক পরিবারকে চেনে, যারা তিন পুরুষ ধরে শপ-লিফটিং ব্যবসায় জড়িত! ধরা পড়লে কিছুদিন জেলে থাকে, ফিরে এসে আবার ঐ রকম ঘটনা ঘটিয়ে জেলে যায়। বুড়ি দাদি বা নানি তাদের নাতি-নাতনিদের দোকানে নিয়ে এ কাজ শেখায়! তখন হয়তো ওদের মা অন্য কোন দোকানে শপ্-লিফটিংয়ে ব্যস্ত! এসব পরিবার যে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল তাও কিন্তু সবক্ষেত্রে নয়। মানুষ অভাবেই চুরি করে না, স্বভাবেও করে। শপ লিফটিং এক ধরনের অভ্যাস-কারোর।
এ দেশে আসার পর শপ্-লিফটিং বিষয়টাতে কারণে-অকারণে দৃষ্টি পড়ে। প্রথম প্রথম যখন এখানকার নামকরা কোনো দোকানে ঢুকতাম, দোকানের ভেতরেই কোথাও লাল রংয়ের জ্যাকেট, কোথাও বা কালো স্যুট পড়া অনেককে দোকানের ফ্লোরে হাঁটাহাঁটি করতে দেখতাম। বুঝতাম না এরা কারা বা কেনো?
পরে জেনেছিলাম, এদের কাজ শপ্-লিফটারদের ধরা। এক সময় এখানকার নামকরা দোকান ‘ম্যাসি’তে একটা শাখায় ব্যবস্থাপকের দায়িত্বেও কিছুদিন কাজ করেছি। ঐ সময় এই শপ্-লিফটিং বিষয়টাকে আরো ভালোভাবে জানি। প্রতিবছর বাৎসরিক ইনভেনটরিতে দেখতাম লক্ষ, লক্ষ ডলারের মাল মিসিং, এর ৭০ ভাগই পড়তো শপ্-লিফটিংয়ের আওতায়! এ কারণে নিজেও দোকানের অনেক সিকিউরিটি কোম্পনিকে ‘ফায়ার’ করেছি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। কারণ শপ্-লিফটিংকে ধরতে এবং এটাকে কমাতেই দোকানের সিকিউরিটি টিমের কাজ। লক্ষ লক্ষ ডলারে এদের বাৎসরিক কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়। সেখানে এটা নিয়ন্ত্রণে তারা আশানুরূপ সফল না হলে, সংস্থাকে ফায়ার করা হতো।
কি এক আশ্চর্য সমাজ ও সভ্যতা এখানকার। এখানে প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই ‘লস্ট প্রোপারটি’ অফিস আছে। যেখানে অজস্র জিনিস অনেকে পেয়ে এই স্থানে এনে জমা দিয়ে যায়। মানুষ পরে সেটা এখান থেকে নিয়েও যায়। এ এক সভ্যতা। অপর দিকে নানা ধরণের চোর, ডাকাত, এবং প্রতারকের দৌরাত্মও কম নয়। এ ধরনের অপরাধ অনেকটাই একরকম পারভারশন বা বিকৃত রুচি।
শপ্-লিফটিংয়ে পুরুষদের তুলনায় টিনএজ মেয়ে থেকে শুরু করে পঞ্চাশোর্ধ্বে মহিলাদের সংখ্যাই বেশি। টিনএজ মেয়ে এবং বয়স্ক মহিলারাও সাধারণত তাদের ছোট ছোট প্রসাধনী যেমন- লিপস্টিক, চোখের কোনো পেন্সিল বা আন্ডার গার্মেন্টস চুরিতে বেশ পাকা হয়। এসব বিষয়ে তাদের সবসময় ধরা বা চ্যালেঞ্জ করাও কঠিন। সম্প্রতি বাংলাদেশি কয়েকটি মেয়ে এ রকম ঘটনাতে ধরা পড়েছে, খুবই কম বয়সের। সাধারণত এরা স্কুলের সহপাঠীদের দ্বারা প্রভাবিত হয় বলে জানা যায়। শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। পুরুষরাও আছে দলে। পুরুষরা যারা আছে, এদের অনেকেই বেশ মারাত্মক ডাকাত প্রকৃতির হয়। প্রশ্ন আসতেই পারে, আমি শুরুতে এটাকে ব্যবসা বলেছি কেন? কারণ যারা এই পেশাতে জড়িত, তারা বিভিন্ন দোকান থেকে ভালো ভালো ডিজাইন এবং ব্রান্ডের জিনিসপত্র বাইরে এনে তা স্বল্প মূল্যে বিক্রি করে। বিশেষভাবে ক্রিসমাসে এ রকম ব্যবসা যত্রতত্রই দেখা যায়। এমনও দেখেছি যে, ম্যাসির জিনিসপত্র চুরি হওয়া ম্যাসির পাশে বসেই বিক্রি হচ্ছে, পুলিশের চোখে সামনেই। কিছু করার নেই। কারণ কথায় আছে না- চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা, না পড়িলে ধরা! ক্রিসমাসের সময়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বিক্রি হয় গুচি, আরমেনি- এসব ব্রান্ডের বিভিন্ন জিনিসপত্র, অতি অল্প দামে। গুচির একটা মেয়েদের হাতব্যাগ, স্টোরে যার দাম ৩-৪শ’ ডলার, রাস্তায় সেটা বিক্রি হয় ৬০-৭০ ডলারে! এসব জিনিসের মধ্যে পুরুষ এবং মেয়েদের দামি দামি সুগন্ধিও বিক্রি হয়। সবই শপ্-লিফটিংয়ের জিনিসপত্র। কিন্তু এগুলো চুরি করা জিনিস জেনেও বিক্রেতা গ্রেফতার হচ্ছে না। কারণ সেই চুরির কোন প্রমাণ থাকে না।
এ রকম বাজারে কোন জিনিস কি দামে ক্রেতার কাছে পৌঁছবে, নির্ভর করে এর ইনভেস্টমেন্টের ওপর। চুরি বা ডাকাতি হলে যে ইনভেস্টমেন্ট সেটা প্রধানত এক রকম ধরা পড়বার ঝুঁকি, আর কোন খরচ নেই। চুরির জিনিস অপেক্ষাকৃত কম দামেরই হয়। এতে ক্রেতার লাভটাই বেশি, যেমন বিক্রেতারাও, উইন উইন অবস্থা বলা যায় দুই পক্ষেরই। তবে কথা আছে, অনেক সময় বিশেষ করে নিউইয়র্কেই এটা হয় বেশি। আসল চুরির মালের সাথে নকল বা আদর করে অনেকে বলে ‘কপিকেট’ অনেক জিনিস বা দ্রব্য বিক্রি খুবই সস্তা হলেও এর তিন দুরাবস্থা হতেও দেখা যায়। প্রথম দুরাবস্থা জিনিসটা নকল, দ্বিতীয় কম পয়সার কেনা তাই টেকেও কম, তিন কখন আবারও সেটা পুনরায় কিনতে হয়।
যা হোক, যা বলছিলাম, এই দেশে প্রায়ই দেখা যায় সুন্দরী, সুপরিচিত অল্প বয়সের মেয়ে অভিনেত্রী বা গায়ক অথবা গায়িকারা শপ্-লিফটিংয়ে ধরা পড়ে জেল-সাজা বা কোর্ট-কাচারিতে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে।
কলেজে আমার এক সহপাঠী ছিলো, ও বিমানবালা হয়ে কাজ করেছে বহুবছর বাংলাদেশ বিমানে। একবার লন্ডনে এক শপ্-লিফটিংয়ে ধরা পড়ে বিমানের চাকরি হারিয়েছে। সে এখন জার্মানিতে স্বামী-সন্তান নিয়ে আছে, একেবারে পুরোমাত্রায় গৃহিণী।
ওর জন্য কষ্ট হয়। কারণ ও এখন অনেকটা মানসিকভাবেও দুর্ভোগে আছে। লন্ডনে শপ্-লিফটিংয়ে ধরা পড়ার পর কিছুদিন ওখানের জেলেও ছিল। ওর হাসব্যান্ড, সেও এক সময় বিমানের ইঞ্জিনিয়ার ছিলো, ভীষণ সহজ সরল বিনীয় মানুষ। বছর কয়েক আগে লন্ডন এয়ারপোর্টে দেখা হলে বান্ধবীর খবর জানতে চাইলে বলেন- জানেন ও যেনো কেমন হয়ে গেছে। আগের মতো প্রাণবন্ত নেই। মাঝে মাঝে এখন কেউ এলে দরজায় কলিং বেল বাজলেও আঁতকে ওঠে। মনে হয় ওর আত্মা খাঁচা থেকে বের হবার উপক্রম। সেই ঘটানার পর থেকেই ও এ রকম একটা অসুখে ভুগছে। দোকানপাটে একদমই যেতে চায় না।
শুনে খারাপ লাগলো। ও কেনো এ রকম একটা অভিজ্ঞতায় নিজেকে জড়ালো বুঝতে পারিনি।
এক সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ফিউজিটিভ নামে একটি ছবি দেখানো হতো। ফিউজিটিভে দেখা ট্রেনের এক ডাকাত হোয়াইটের কথা মনে পড়ে। যদিও সে প্রকৃতই ডাকাত ছিলো, আর ফিউজিটিভ চরিত্রটি ছিলো নির্দোষী। আজকে সেই বান্ধবীর বর্তমান হালের কথা শুনে মনে হলো একটি চুরিতে ধরা পরে এখন ‘ও’ নিজেকে হোয়াইট এর মতো মনে করে আতঙ্কে থাকে কিনা।
ওর হাসব্যান্ডের অবস্থা বউয়ের এই আতঙ্ক উপশমে জীবন কাটাতে হচ্ছে দেশ ছেড়ে অনেক দূরে সুদূর জার্মানিতে।
মানুষ যে কতো কারণে অভিবাসী হয়, সবতো আমরা জানি না। আর সেই অভিবাসীর যাপিত জীবন কেমন কাটে, তাও বা কতোটা জানি।
শপ্-লিফটিং বিষয়টা খুবই সাধারণ বিষয়ও নয় কিন্তু। জানা মতে, শপ্-লিফটিংয়ের শিকার হয়ে এখানে অনেকে নিহতও হয়েছে নিরাপত্তা রক্ষীদের সাথে অপরাধীর ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে। অনেক সময় লিফটার আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে কিংবা ভয়ে নিজের আগ্নেয়াস্ত্র বের করে নিরাপত্তা রক্ষীদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। সেই দ্বন্দ্বে কারোর কারোর জীবনের অবসান হয়। এ রকম শখের স্বভাব যদি থেকে থাকে আমাদের অভিবাসীদের কারোর, প্লিজ ঝুঁকি নেবেন না। এ রকম ‘ফান’ ও করবেন- না, ফান্্ বলছি কেউ কেউ বিষয়টাকে ‘ফান’ ভেবে উৎসাহিত হয়ে এ রকম চুরি করে।
উল্লেখ্য যে, এই শপ্-লিফটিং বিষয়টি জানামতে লিপিবদ্ধ বা ডকুমেন্টেড হয় ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে বিলেতে। উনিশ শতকের মধ্যে এটা ছড়িয়ে পরে বিশ্বের অনেক দেশে। ঐ সময় ব্যাপারটাকে এক প্রকার ফিমেল বা মহিলাদের কাজ বলে মনে করা হতো। ৯০’এর দশকে এসে এ ব্যাপারে নানা গবেষণায় এর একটা রাজনৈতিক দিককে আবিষ্কার করা হয়। অর্থাৎ এর দুই শ্রেণি বিন্যাস হয়। প্রথম ভাগকে বলে বুস্টার্স (Boosters)। এরা বিভিন্ন দোকান থেকে নানা দামি জিনিস চুরি করে বাইরে বিক্রি করে জীবন ও জীবিকা চালায়। পরের দলটি শুধু নিজেদের ব্যবহারের জন্য চুরি করে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এই সময়ে দোকান পাটগুলো বেশ কিছু পদক্ষেপ বা স্ট্রাটেজি নিয়েছে। দোকানে সিসি ক্যামেরা, ভিডিও মনিটরিং, স্টোর ডিটেকটিভ এবং নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ এর অন্যতম। শপ্-লিফটিং বিষয়টি এতোটাই মারাত্মক যে, এখানে ORC (Organised Retail Crime) নামে প্রতিষ্ঠান আছে। তাদেরই গবেষণা এবং কার্যক্রম প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতি বছর আমেরিকার রিটেল ইন্ডাস্ট্রিতে এই শপ্-লিফটিংজনিত অপরাধের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার! আরো বের হয়েছে, এর ফলে দেশের সরকারের বিক্রয় কর থেকে আয়ের ক্ষতি প্রায় ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের মতো। বিষয়টি সরকার এবং নাগরিকদের কাছেও ভাবনার।
সরকারের ভর্তুকি ক্ষেত্রগুলো সামাল দিতে হয় সাধারণ নাগরিকদের থেকে নেয়া আয়কর থেকেই। আয়কর বেড়ে যায়, সেই তুলনায় আয় বাড়ে না। অন্যদিকে আয়কর বাড়ালে সরকারকে সমালোচনা এবং প্রতিপক্ষের বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়। সবকিছু বিবেচনার আলোকে বলা যায়, শপ্-লিফটিং বিষয়টি এখানে সব অভিবাসীদের আর্থিক জীবনযাপনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক।
১৮ মে, ২০১৮।
ই-মেইল: [email protected]