মাহমুদ রেজা চৌধুরী
একবিংশ শতাব্দীরও প্রায় মাঝামাঝি সময়ে এখন আমরা। এক রকম “নিও রিয়ালিজমের” যুগ সন্ধিক্ষণে। কত কি দেখছি, শুনছি, পড়ছি, আচরণ করছি। দেখে-শুনে মাঝে মধ্যে মনে হয় এর শেষ কোথায়। ভালো এবং মন্দ দুই প্রান্তেই।
এই সব নিয়ে একটা আড্ডা হচ্ছিল ঘর ভর্তি অনেক জনের সাথে। রোজার মাস। তা-ও আবার সপ্তাহের ছুটির দিনও। এ রকম না খেয়ে দীর্ঘ আড্ডা অনেকটা ব্যতিক্রমও বটে। তবু বাঙালি, সব সময়ই আড্ডা প্রিয়। খাওয়া চলুক বা না চলুক। অনেকে বলি পেটে গেলে সবই সয়, তবে এর অন্যরকমও হয়। আড্ডাটা ছিল সে রকম। সবাই রোজা রেখেছেন তবে কথায় যেন পেট ভরা। আলোচনার শুরুটা ছিল পরিচিত একজন বেশ কয়েক বছর আগে এখানে মারাত্মক এক রোড এক্সিডেন্ট করে তার একটা পা হারিয়েছিলেন। ভদ্রলোক এখন কেমন আছেন নিয়েই কথা শুরু। ভদ্রলোকের বড় ভাই উপস্থিত ছিলেন আড্ডাতে। বললেন ও এখন ভালো আছে। কাজ করছে। স্বাভাবিক জীবনযাপনও করছে, সমস্যা নেই। দু’বছর আগে ফিলাডেলফিয়াতে এক হাসপাতালে তাকে একটা কৃতিম পা লাগিয়ে দেয়। ওটা নিয়েই সে বেশ ভালোভাবেই চলা ফেরা করতে পারে। বোঝাই যায়না আসল পা-টা যে নেই। এবং এটা একটা প্রযুক্তির বানানো পা। ভাগ্যিস, দেশে হলে তো হয়ত লোকটাকে বাকি জীবন স্ক্রাচে ভর করেই চলতে দেখতাম। তখনই মনে হলো এটাও তো এক রিয়ালিজম। আজ থেকে চার-পাঁচ দশক আগে এটা আমরা ভাবতামও না। এখন ভাবি না দেখি এবং দেখছি।
আমাদের এই অগ্রযাত্রা সমাজ এবং সভ্যতার জ্ঞান এবং এর চর্চার এক সুখকর রিয়ালিটি। মনে পড়ল অনেক বছর আগে কোনো একটা বইতে রিয়ালিজম চিন্তাটা কি, পড়ছিলাম। সেখানে পড়েছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ইতালির চলচ্চিত্রে নাকি নিও-রিয়ালিজম আন্দোলনের যাত্রা শুরু। কি সেটা। লুচিনো ভিসকন্তির (১৯০৬-৭৬) ‘ওস সেসিওনে’ (অব সেসন ১৯৪২) ছবির সমালোচনায় আন্তেলিও পিয়েত্রাফেলি ‘নিও রিয়ালিজম’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন (১৯৪৩) যাই হোক, এটা অন্য আলাপ। যেটা নিয়ে আলাপ করছিলাম সে দিন, তা ছিল পোস্ট মর্ডান যুগে আমাদের নূতন নূতন উদ্ভাবন, আবিষ্কার, বাস্তবতার আরেক পৃষ্ঠাতে আমরা কি ক্রমেই সব ব্যাপার বা বিষয়ে নূতন যুগ বলে শুধু যুগের নানা টেকনোলজি এবং এর প্রযুক্তিগত উন্নতি চিন্তার দিকেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি কি না। এখন লন্ড্রি বলতে পরনের পোশাক লন্ড্রি করি মেশিনে। ঘুমানো অবধি যত কিছু করছি সেখানে ফিজিকাল কন্ট্রিবিউশন ধীরে ধীরে সবই প্রযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। লন্ড্রি তো এখন কলের নিচে সাবান ঘষে করি না। কাপড়ের ধোবার মেশিনে দিয়ে দেই, (ঘড়েও) ড্রাইয়ারে দিয়ে দেই। এরপর অনেককে দেখেছি কাপড় আইরন করছেন না। আইরন ঘষা কি দরকার। এক রকমের কাপড়ের ‘স্প্রে’ আছে। ওটা কাপড়ে স্প্রে করলে কাপড়ের ভাঁজ সোজা হয়। খাচ্ছি-অনেক ক্ষেত্রেই রেডিমেড। মাইক্রোওভনে দাও আর খাও। সেদিন একজন বলছিল ভাই, আমি বাজার থেকে মাছ কিনে এনে ক্লিন করে বাসায় ভেজে বা রান্না করে খাই। হোটেল রেস্টুরেন্টে খাই কম। ওরা এক বছর আগে যে মাছটা কিনে ডিপ ফ্রিজ করে- সেটা ক্রেতা গেলে ওখান থেকে বের করে আধুনিক চুলাতে গরম তেলে বা মশল্লায় রেডি করে এমনভাবে সার্ভ করে মনে হবে এই বুঝি নদী থেকে নিয়ে এলো। ঘুমোতে যাবেন, প্রচ- গরম। হাত পাখা কি দরকার, ঠান্ডার বাক্স মানে এয়ারকন্ডিশন অন করে দেন। অথবা ছাদে লাগানো ‘ফ্যান’ টা অন করে ঘুমিয়ে যান। দুর্ঘটনায় হাত, পা কোমর ভেঙে গেছে। অসুবিধা কি হাসপাতালে যান, ক্রেডিট কার্ড ঘষে নূতন পা নিয়ে বা হাত নিয়ে ঘড়ে চলে আসি। কাউকে সাজা দিতে চান। মল্ল যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করে বিরত্ব দেখানো কি দরকার। গুম করে দেন। অথবা ক্রসফায়ারে মেরে ফেলেন। কিংবা বোমা বা পেট্রলবোমা মেরে মিশিয়ে দেন। কাজ খতম। এটা এখন কোথাও কোথাও পোস্ট মডার্ন রিয়ালিটিও বটে। আমরা এখন বাঁচি কেবল ভোগের জন্য। কম বা বেশি নির্ভর করবে সুযোগ, ক্ষমতা, অধিপত্য, সাথে মাসেল আর বন্দুকের টিগার কার হাতে তার উপর। সব কিছুকেই স্বাভাবিক মনে করার যুগ এটা। মানুষের মন এবং ভাবনা অর্থহীন।
এই পোস্ট রিয়ালিজম আমাদের অনেকেরই মধ্যে একটা ভাবনা এনে দিয়েছে। ছোট্টো করে এটা ‘হলেই তো হলো’। এই ভাবনা। সেই হওয়াটা কতখানি হওয়া, কি রকমের হওয়া। এই বিষয় বা চিন্তাগুলো তেমন গুরুত্বের না। গুরুত্বটা হচ্ছে, হলো কি না ‘কাজটা’। সেটা জোর জবরদস্তি করে হোক বা প্রযুক্তিনির্ভর হোক, যাই হোক না কেন। কর্পোরেট ভাষাতে বলে ‘গেট দ্যা জব ডান।’ আমাদের মন হৃদয়। এসবের স্বতঃস্ফূর্ততার অনুভূতি এবং সেই ভাবনা অকেজো অনেকটাই। অনেকে বলেন সময় বদলাচ্ছে ভাই, আগে পোস্ট কার্ডে লিখতেন। এখন সেটা ই-মেইল-এ। বুঝতে তো হবে। অবশ্যই বোঝার দরকার তো আছেই। নয়া রিয়ালিজম কে বুঝতে হলে এটা তো বুঝতেই হবে। মানুষ কি না পারে। এই ভাবনার দ্রুতগতির যুগও এটা। এই কি না পারার প্রতিযোগিতা অন্য অর্থে মানুষের অমানবিকতা এবং পশুত্বের প্রতিযোগিতাও।
সব কিছুকে সহজ করে দেখা এই যুগের এক রকম ট্রেন্ড। কিন্তু এই ট্রেন্ড কি সব ক্ষেত্রে সঠিক? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ। আমাদের নানা প্রকারের মানবিকতা, সৌহার্দ্য, সহনশিলতা এবং বিনয়কে কতটা ধরে রাখছি বা চর্চা করি, বৃহত্তর ক্যানভাসে বলতে বৃহত্তর সামাজিক ব্যবস্থাপনাতে, রাজনীতিতে অর্থনীতিতে এবং নৈতিকতাতে। পোস্ট মডার্ন ‘এরা’ কি বলবে জানি না।
মানুষই বা কত দিনই বা আমরা বাঁচি। বড়জোর ১০০ বছর। এর মধ্যে ১-২০ বছর চলে যায় এটা সেটা নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্টে। কিছু সময় যায় অবিশ্বাস, সংশয়, দ্বিধা এবং স্বল্প ভাবনাতে। বয়সের সাথে অভিজ্ঞতা বাড়ে, জ্ঞানও বাড়ে। চিন্তার গুরুত্ব এবং পরিসর বাড়ে। কতটুকু বা সেটা। ভাবছিলাম, এই অল্প টুকুন সময়ে কেবল আপন স্বার্থের জন্য অন্য কারোর মত, চিন্তা বা কাজে উত্তেজিত হই। রি-এ্যাক্ট করি, তবে সেটা নির্দিষ্ট স্বার্থের সাথে যদি বৃহত্তর সমাজ বা রাষ্ট্রও জড়িত হয় বা থাকে- সে ক্ষেত্রে উত্তেজনা বা প্রতিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সামাজিক ও রাজনৈতিক নৈতিকতা, বিচার সংস্কৃতি। সর্বত্রই জোর যার মুল্লুক যেন তার-ই। বর্তমান শতাব্দীর এই আধুনিকতা বা পোস্ট মডার্ন সময়ে এসেও আমরা পুরনো মানসিকতা, শোষণ, স্বৈরশাসন মিলিটারি কৃষ্টি, অ-বিচার, মিথ্যাচারিতা এবং ভ-ামিকে এড়াতে পারছি না। মানুষ কি না পারে যদি হয়, তা হলে, পারছি না কেন সামাজিক অপরাধ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় অপরাধের ইতি টানতে ঘরে এবং বাইরে। মূলত এটা নিয়েই আড্ডাতে আড্ডা হচ্ছিল। ওখানে অনেক মন এবং মতের বন্ধুরা ছিল।
এক একজন এক এক রাজনৈতিক দর্শনে বা চিন্তায় বিশ্বাসী। একটা প্রশ্ন যদিও অনেক পুরনো প্রশ্নই। পুনরায় আসল। আমরা এই দেশে বসে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যুক্ত হই কেন। কেউ এটা, কেউ সেটা এই দলাদলি কোন্দল হইচই কেন করি। এতে ঐ সব দলের দলীয় স্বার্থ, ব্যক্তি স্বার্থ আর সাথে কারোর বিদেশে এসে ফ্রি থাকা, খাওয়া, বাজার এসবই হয়। দেশের মোটা দাগের সাধারণ মানুষের কি উপকার করছি, আমরা এ রকম বিভক্তিতে।
পোস্ট মর্ডান ইজম কি কেবলই মানুষকে মানবতা এবং মনুষত্বের থেকে দূরত্বের সীমানায় ফেলে দিচ্ছে কি না। এটাও তো আমরাই করছি, করতে পারছি। তাই সব ক্ষেত্রে কিছু যেন একটা হলেই তো হলো। এটাই যেন শেষ কথা না হয়। কিভাবে সেটা হলো, কি হলো, এতে সময় কি সে বদলালো। মানুষ মানুষ রূপে কতটা ভালো অর্থে পরিবর্তন হলো কি না। ভাববার গুরুত্ব আছে। পশুকে ট্রেইন করে বিশ্বাসী বা আস্থাশীল বা নির্ভরশীল করি। কিন্তু এই মানুষ আমরা নেতা হই বা নেত্রী হই। শিক্ষিত হই বা উচ্চ শিক্ষিত যাই হই। অনেক ক্ষেত্রে পোস্ট মডার্ন যুগে এসে একে অন্যের প্রতি সেভাবে বিশ্বাসী, আস্থাশীল, নির্ভরশীল বা মানবিক সেই মাত্রায় হয়ে উঠতে পারছি না।
মানুষ কি সবই পারে? এক অর্থে হয়ত বা। দেশ থেকে অভিবাসী হয়ে দূরে থেকেও অনেক কথা, শব্দ, সংজ্ঞা বা ধারণা নূতন করে শুনছি এখানেও। যেমন আইনের আওতা, দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসী, জঙ্গি, অসত ব্যবসায়ী। আদালত অবমাননা। জাতি, জাতীয়তা, ধর্ম, সংস্কৃতি, বিচার, ন্যায়, অন্যায়। প্রতিদিনের জীবনের সাথে এই সব যুক্ত রাজনীতি অর্থনীতি এবং মূল্যবোধে। এসব ধারণাগুলো চমকে দেয়, হতবাক করে। ভাষাহীন করে। মনে হয় শাশ্বত এই সবের সব অর্থ এবং ধারণা পাল্টে ফেলছি কেবল ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বার্থে। সমগ্রের কল্যাণে নয়। আধুনিক একংবিশ যুগ বলে কথা, মানুষ আমরা কি না পারি।
এরপরও আধুনিক এই বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অবদানও অনেক, যার আলাদা উল্লেখ প্রয়োজন নেই। যা আছে তাতো দেখছি, ভোগও করছি। কিন্তু যা হারিয়ে যাচ্ছে, স্বদেশে এবং প্রবাসে-তা যে যুগেই থাকি-না কেন। যত প্রাচুর্যই পাইনা কেন। যা পাচ্ছিনা, দেখছিনা এবং অবক্ষয়ের ক্ষতকে গাঢ় করছে। সেটাই তো ভাবনাকে আলোড়িত করবে। নাড়াবে। সব জ্ঞানই কি কেবলই বিজ্ঞান কেন্দ্রিক, সব গতিই কি কল্যাণের। কোথাও না কোথায়তো আমাদের দাঁড়াতে হবে। থামতেও হবে। ট্রেন যদি শুধু চলতেই থাকে কোথাও-ই বা না থামে, সেই ট্রেনের যাত্রী হবে কে- এই চিন্তাকেও যেন গুরুত্ব দেই। স্বদেশে এবং অভিবাসেও।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক।
১৫ জুন, ২০১৮।
ই-মেইল: [email protected]