অভিবাসীর যাপিত জীবন (৩৪)

মাহমুদ রেজা চৌধুরী

পৃথিবীর প্রাণী জগতে এক সময় তাও প্রায় ২৪০ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসর নামে এক প্রাণী বাস করতো। ইতিহাস ঘাটলে জানি যে, ‘ডাইনোসর’ নামটি গ্রিক শব্দ ‘Deinos’থেকে এসেছে, মানে ভয়ঙ্কর বা আতঙ্ক। ইংরেজিতে কেউ কেউ বলেন ‘Terrible’ বা Terrible’. আর ‘sauros’ মানে লেজ বা ‘ Lizard’ বা রেপটাইল । বিজ্ঞানীরা অনেকে ইতিহাসের এই mesozoic ধারা বা যুগকে তিনটি সময় বা কালে ভাগ করেছেন। যেমন ‘ÔTriassic’ Jurassic আর cretaceous । ডাইনসর’স এখন প্রাণী জগতে বলতে গেলে অবলুপ্ত। এর প্রজাতি হিসেবে, কুমির, সর্প, টিকটিকি প্রজাতিকে অনেকেই ডাইনোসর প্রাণীর বিবর্তনও বলে মনে করেন। যাই হোক, আজকের আলোচনাতে প্রাণী জগতের এই সাংঘাতিক প্রাণী বিষয়ে কিছু না লিখলেও মানব ডাইনোসর বিষয়ে দু-একটি পর্যবেক্ষণ নিয়ে পাঠকের সাথে মনের এলোমেলো কিছু ভাবনা শেয়ার করছি।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মানব ডাইনোসরদের রাজত্ব এবং প্রভুত্ব চোখে পড়ার মতো।
যে কারণে স্বদেশেও এদের প্রতাপ হিং¯্রতা পড়ি এবং দেখি। অভিবাসী জীবনেও এর সাংগঠনিক এবং দলীয় একতা আছে। এরা সংখ্যায় স্বল্প কিন্তু প্রচারে এবং প্রসারে ব্যাপক এবং সুসংগঠিত। সম্প্রতি নিউইয়র্কে একটি মেলাতে গিয়েছিলাম। সাধারণত যাই না কোথাও, কিন্তু এবার ব্যক্তিগত কারণে মেলাতে কিছুক্ষণের জন্যই উপস্থিত ছিলাম।
বিষ না খেলে বিষের কি সাধ বোঝা যায় না। যেমন চিনি বা নুন না খেলে তার স্বাদ বলা যাবে না।
নিউইয়র্কে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত ২-৩ দিনের বই মেলা ইতিবাচক মিলন কেন্দ্র। নিঃসন্দেহে প্রচুর মানুষ সমাগম হন এখানে। প্রধানত একে অন্যের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হবার একটা ভালো সুযোগ। দ্বিতীয়ত, এই মেলাকে কেন্দ্র করে শাড়ির দোকান, খাবারের দোকানে- মূল্য দেখলাম দুই-তিন গুণ বেশি।
তৃতীয়ত, কারো কারো নিউইয়র্কে ভ্রমণ হয় একটা উসিলাকে কেন্দ্র করে। মন্দ কি।
চতুর্থত, বই বেচাকেনা, কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বক্তৃতা-ভাবনা। দুই বা তিন দিনের বাইরে যার আর কোনো রেশ বছরের বাকি সময় খুব কমই চর্চা হয়। কঠিন বাস্তবতা আর পরিশ্রমে অভিবাসীদের প্রতিদিনতো এ রকম আনন্দ স্ফূর্তি করা সম্ভবও না। বই মেলাতে গিয়ে ক’টা বই ক’জন কিনি বা সেটা পড়ি। সারা বছরই বা ক’টা বই ক’জন পড়ি। বই মেলাতে বই সংক্রান্ত বিষয়েই গুরুত্ব থাকার কথা বেশি। কিন্তু এখানে বইটা হলো এক ধরনের উপলক্ষ, মূল লক্ষ নয়। বই নিয়ে যে বই নতুন প্রকাশিত হলো সেসব বই নিয়ে আয়োজকরা লেখকদের সাথে আলোচনা করার একটা পর্ব রেখেছিলেন, অনেকটাই যাচ্ছেতাই মোড়কে। বই নিয়ে আলোচনা দেখলাম অনুষ্ঠানের এক জায়গার মূল মঞ্চেও নয়। নিচের তলাতে একটা কড়িডোরের স্পেসে। একজন উপস্থাপক, দুই বা তিনজন আলোচক। তারাও নির্দিষ্ট বইটি না পড়েই আলোচনা বা মন্তব্য করেন। আর উপস্থিত দেখলাম লেখকের দু-একজন বন্ধু বা বান্ধবী। গোটা দুই একটা বাচ্চা-মা বাবার সাথে এসে বসেন। সব মিলিয়ে ১০ জনেরও কম। বই মেলাতে বইয়ের আলোচনা বেশিটাই এমনই দেখলাম। কোনো কোন লেখক তার প্রকাশকের স্টলে বসেন নিজের বই বিক্রি করার জন্য। এইতো বই মেলা। এটার ইতিবাচক দিক হলো এ রকম একটা বই মেলা গত ২৭-২৮ বছর ধরে চলছেতো। উদ্যোক্তাদের অবশ্যই ধন্যবাদ জানাই ।
এই মেলাতে এসে মানব ডাইনোসর কারো কারো কথা শুনেছি, যারা নিজেকে এবং নিজেদের ‘ঘরানার’ বাইরে কাউকেই সমাদর করেন না। বই সম্পর্কে মন্তব্য করেন, শুনলেই বোঝা যায় এদের শিক্ষার দৌড় বা জ্ঞানের গভীরতা কতটুকু। এই ধরনের কুয়োর মধ্যে ব্যাঙের লাফালাফি, সেই ব্যাঙ কতটুকুই বা ‘আলো’ দেখতে পারে। অভিবাসীর যাপিত জীবনে বিগত ত্রিশ/বত্রিশ বছর প্রবীণ, নবীন, সদ্য উদিত বুদ্ধিজীবী বলে প্রচারিত এবং প্রসারিত অনেককেই জেনেছি, দেখেছি। এদের এক একজনকে মানব ডাইনোসরদের মতো হিং¯্র, সাংঘাতিক এবং স্বজাতিকেও খেয়ে ফেলার মতো বলেই মনে হয়। ডাইনোসর প্রাণীও কিন্তু ক্ষুধা লাগলে অন্য ডাইনোসরকে খেয়ে ফেলতো। এখন দেশেও আমরা স্বজাতিকে এক এক করে খেয়ে ফেলছি গুম, খুন করে বা কাউকে প্রকাশ্যে অসভ্য ভাষায় গালাগালি করে। একই বাতাস বইছে অভিবাসেও। আমরা বলতে এখানে কেবল যারা মানব দেব-দেবি পূঁজা করি তারাই আমরা জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি, বাকি সব মুর্খ। এই ভাবটা কথায় প্রকাশ না পেলেও অনেকেরই আচরণ এবং ব্যবহারে অনেক ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট দেখলাম বই মেলাতেও। বই হচ্ছে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখায়, কিন্তু আমরা সেই বইকে সেভাবে গ্রাহ্য করি কম। বই কেবল আমার কথা, আমার ভাষা, আমার দর্শনকে উপস্থিত করলেই ওটা বই, অন্যত্র হলে ওটা ধরাও যেন পাপ।
প্রাণী জগতে ডাইনোসরের বিলুপ্তি ঘটলেও আধুনিক সমাজ এবং সভ্যতায় মানব ডাইনোসরদের বিলুপ্তি পৃথিবী বিলুপ্তির আগে ঘটবে না। এটা জন্তু ডাইনোসরের সাথে মানুষ ডাইনোসরের পার্থক্য। অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছেন, ভাবছেনও যে, এই দুই প্রাণীকুল মানুষ আর ডাইনোসররা কি একসাথে বসবাস করতে পারবে কিনা, যদি ডাইনোসরা ফিরে আসে।
এর উপর ১৯৯৩ সালে একটা ছবি হয়েছিল ঔঁৎধংংরপ চধৎশ’ ছবিটাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এর পরিচালক দেখিয়েছেন আজকের সময়ে এই প্রাণী মানুষের সাথে একই সময় ডাইনোসরও জীবিত থাকলে কি হতে পারে বা পারতো।
সমাজ এখন অনেক অগ্রসরমান, সভ্যতা অনেক উন্নত, জ্ঞানে এবং প্রসারে। কিন্তু এর শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো মানব সমাজে মানব ডাইনোসরদের হাত থেকে মানবিক বিশ্ব ও সমাজ কে কতটা রক্ষা করতে পারবে বলাটা কঠিন। প্রবীণ, নবীন বুদ্ধিজীবী একাংশ চরমভাবে নিবুর্দ্ধিজীবীও বটে। এরা জানাতে বা বোঝাতে বা বলতে চায় অনেক কিছু। কিন্তু সেই জানার প্রশ্নে এদের অন্যদের প্রতি এক রকমের তুচ্ছতা কাজ করে। ব্যাঙ্গাত্মক হাসি, মুচকি হাসি বা শারীরিক অভদ্রতার আচরণ লক্ষ্য করি। এরা সেই অর্থে ডাইনোসরের মতো হিং¯্র, সাংঘাতিক এবং টেরিবল।
তিন দিনব্যাপী বইমেলা দেখে মীর্জা গালিবের একটা কবিতার কথা মনে পড়ল। ভাগ্যক্রমে আজকে ২৬ জুন যখন এই এই লেখাটা লিখছি। এই সমাজ দার্শনিক, সুফি, জ্ঞানী-প-িতের আজ ২২০তম জন্মদিন। মির্জা গালিবের অপরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার একটা কবিতা আছে এরকম:
“খোদা কি মহব্বিত কো ফানা কোন কারেগা
সবি বান্দা নেক হো তো গুনাহ কোন কারেগা
এ খোদা মেরে দোস্তকো সালামাত রাখনা
ওর্না মেরি সালামাতি কি দুয়া কোন কারেগা
আওর রাখনা মেরে দুসমানো কোবি
মেহফুজ
ওর্না মেরি তেরে পাস আনে কি দুয়া কোন কারেগা। ”

বাংলাতে বললে,
খোদার ভালোবাসাকেও নস্যাৎ বা ধ্বংস কে করবে,
সবাই যদি নেক বান্দা হয় গুনাহ কে করবে।
হে খোদা আমার বন্ধুকে তুমি ভালো রেখ।
তা না হলে আমার ভালোর জন্য দোয়া কে করবে।
রেখো আমার শত্রুকেও সুরক্ষিত
তা না হলে তোমার কাছে আসবার জন্য
আমার জন্য দোয়া কে জানাবে।
তবুও নিউইয়র্কের বই মেলা অব্যাহত থাকুক। আমাদের না পাওয়া থেকেও পাবারও যে আছে অনেক কিছু।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক।
১৩ জুলাই, ২০১৮।
ই-মেইল: [email protected]