অভিবাসীর যাপিত জীবন (৪৫)

মাহমুদ রেজা চৌধুরী

মানব সভ্যতার নানান ইতিবৃত্ত আছে নদীকে নিয়ে, নদীকে ঘিরে। সিন্ধু সভ্যতা, নীলনদের সভ্যতা, প্রাচীন এমন অনেক সভ্যতার গোড়াপত্তনও হয়েছে নদীকে ঘিরে। আবার অনেক সভ্যতা, বসতি, সংসার ভেঙে গেছে নদীর প্লাবনে। এই ইতিহাস কম নয়।
মানুষ গ্রাম থেকে শহর, আবার সেখান থেকে আরেক শহর। ছুটেছি অজানাকে জানার তাগিদে। আবার মানুষ দেশান্তরিত হয়েছি ¯্রফে জীবনের কোন না কোন নিরাপত্তা বা আরেকটু ভালোর দিকে পৌঁছবার স্বপ্নের ঘোড়ায় চড়ে। এই দেশান্তরিত হবার অনেক কাহিনী, অনেক কষ্ট, হতাশা এবং স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প আছে।
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের এক সময়ের বিখ্যাত একটি নদীর নাম করতোয়া। আরো যে সব নদ/নদী বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক জলবায়ুর নাতিশিতষ্ণু দেশের পলি মাটিকে সুজলা-সুফলায় ভরে রেখেছে, এর মধ্যে আছে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, আত্রাই। যমুনা, মেঘনা, কর্ণফুলী, সুরমা, এ রকম অসংখ্য ছোট বড় নদী। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গা। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ দেশের অন্যান্য নদী, জেলা বা এলাকা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ধীর ধীরে চলে আসে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে। এই নদীকে কেন্দ্র করে ঢাকা নগর এবং নাগরিক জীবন বিকশিত হয়। সময়ের প্রবাহে এর ওপর নানান ¯্রােতে জল ঘোলাটে হতে থাকে। জীবনের নিশ্চয়তা সবার জন্য অর্থবহ হয়ে ওঠে না। পাড়ি দেয়া শুরু হয় এই নদী ছেড়ে অন্য মহানদী বা সাগর পাড়ে। মধ্যপ্রাচ্যের নীল নদ বা নদীকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ পাড়ি দিয়েছে মহাসগর আটলান্টিক, টাইগ্রিস ও প্রশান্ত মহাসাগর তীরে। এখানকার সভ্যতা, উন্নতি, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা পদ্মা বা যমুনা বা বুড়িগঙ্গার চেয়েও উন্নত মনে করে ভিটে ছিড়ে অনেক মানুষ বিচ্ছিন্নও হয়। যে মানুষ আজকে এই আটলান্টিক তীরে, এরাও কি আমরা প্রত্যেকে ছুতে পেরেছি জীবনের নিশ্চয়তা বা সুখ নামের সোনার হরিণ। না, পারিনি। এই নিজেদের নানান জীবন এবং জনের গল্প আরেক পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসের মতই। এই কথা বলতে গিয়েই চোখের সামনে ভেসে এলো প্রখ্যাত উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসাধারণ উপন্যাসের কথা, পূর্ব-পশ্চিম। পাক-ভারত উপমহাদেশের দেশ বিভাগ নিয়ে এমন হৃদয়স্পর্শ করা উপন্যাস আর আছে কিনা জানি না। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, পূর্ব ও পশ্চিম দুই বাংলার এক ধরনের সমান্তরাল বাঙালী জীবনকে নিয়ে এই উপন্যাসের পূর্বে এ রকম উপন্যাস পড়েছি বলে মনে হয় না। পূর্ব-পশ্চিম গ্রন্থটি দুই খ-ে বিভক্ত। গ্রন্থের প্রকাশক বলেন, দুই বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের পালাবদলের ¯্রােত কীভাবে এসে মিশেছে এই আশির দশকের মোহনায় এই গ্রন্থ বা উপন্যাসটি এর এক জীবন্ত দলিল। একইভাবে বলা যেতে পারে, ’৭০ দশক থেকে শুরু করে আজকের একবিংশ শতাব্দীর ২০১৮ তে। দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নমুখী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সমাজের চাওয়া-পাওয়াতেও যে পালাবদল ঘটেছে এবং এখনও ঘটছে। তার এক খ- চিত্র আছে আজকের অনেক অভিবাসীদের যাপিত জীবনের রোজনামচাতেও। এই রোজনামচাটিকে ইস্ট ভার্সেস ওয়েস্ট সভ্যতার ভিন্ন আরেক চিত্র বলা যেতেও পারে। এই পালাবদলের ঘটনা নিয়েও ভবিষ্যতে উপন্যাস রচিত হবে। সেই ইতিহাসের ফুটনোটে এখানের কিছু পাওয়া বা না পাওয়ার গল্প থাকলেও থাকতে পারে। উত্তর আমেরিকাতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের অনেকেই বা এর একাংশ এসেছেন ঢাকা শহর বা জেলা থেকে। তবে সমগ্র বাংলাদেশ থেকে যারাই দেশান্তরিত হয়েছেন তাদের সবাইকে রূপক অর্থে বলছি বুড়িগঙ্গা থেকে আগত বলতে বাংলাদেশ থেকে। এর এক বড় অংশের গেট অব এন্ট্রি নিউইয়র্ক। এই নিউইয়র্ক নগরও কিন্তু ঘিরে আছে বেশ কিছু নদ-নদী দ্বারা। যেমন হাডসন, ইস্ট রিভার, লং আইল্যান্ড সাউন্ড ইত্যাদি। ইস্ট রিভারটি একেবারে নিউইয়র্ক মেট্রোপলিটান সিটিকে ঘিরে। এখানের অসংখ্য অধিবাসীদের কথা বলতে গেলে বড় দাগে বলতে হয় বুড়িগঙ্গা থেকে ইস্ট রিভারের কাহিনী বা এর জীবন্ত গল্প। এর যাপিত সকাল সন্ধ্যার ছবি।
ওর নাম বুশরা, অনেক বছর থেকে ওকে চিনি। চটপটে আর ভীষণ আত্মনির্ভরশীল মেয়ে। জীবন সংগ্রামে লড়তে দেখা এই শহরের একটি বাংলাদেশি মেয়ে। নিজস্ব একটা ছোট্ট ট্রাভেল এজেন্সি আছে। একাই চালায়। ম্যানহাটনের মতো ব্যয়বহুল এলাকার একটি দালানে ওর অফিস ছিল। এক সময় এয়ার টিকেট করতে গিয়ে ওর সাথে পরিচয়। ভীষণ বিনয়ী মনোভাবটাই বুশরার ব্যবসার সফলতাকে প্রসারিত করেছে। বুশরা বললো, বিয়ের পর কিছুদিন ও ওর স্বামী কাজ করতেন নিউ ইয়র্কের রাজধানী-আলবানিতে। ওখানে বুশরাও যায়। কিন্তু নিয়তি কার জন্য কোথায় কি লিখে রাখে আমরা জানি না। বুশরা ওর স্বামীর সংসারে গিয়ে দেখলো ওর স্বামী তার মা-ভাই বোনদের নিয়ে থাকেতেই বেশি ভালবাসে।
মাঝে বহু বছর কোনো যোগাযোগ ছিলো না বুশরার সাথে। সেদিন হঠাৎ পত্রিকায় ওর ট্রাভেল এজেন্সির ছোট্টো বিজ্ঞাপন দেখে মনে হলো বুশরার সাথে কথা বলি। কল করলাম ওর নম্বরে। বুশরা ধরতেই নাম বলতেই বললো, ও রেজা ভাই কেমন আছে আপনি। কয়েক যুগ পরে কল করলেন। কথা হলো নানা বিষয়ে। বুশরাকে বলছিলাম আমিরাটসের কারেন্ট একটা ফেয়ার এখন কেমন জানাতে।
পরের দিন সন্ধ্যায় বুশরা জানালো। তখন আরো কিছু কথা হলো। এক সময় বুশরার ভাই থাকতো ওর সাথে। বুশরার মা থাকে কানাডাতে। যাই হোক গল্পে জানলাম বছর কয়েক আগে বুশরার স্বামী মারা গেছেন মাত্র ৪৯ বছর বয়সে। বললো, তাদের বিয়েটাও হয়েছিল ওর মা আর ভাইদের অনুরোধে। বুশরা কাঁদতে ছিলো। বললো, জানেন রেজা ভাই, ও দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম ছিল। বুয়েটের ছাত্র ছিল। এখানে ও একটা ভালো কাজও করতো। ভীষণ নাকি বিনয়ী ছিলেন ভদ্র লোক। কিন্তু মা-ভাই-বোনদের বেলাতে সম্পূর্ণটাই তাদের কথা মতোই চলতেন। এই কারণেই বুশরার সংসারটা শুরু থেকেই স্বাভাবিক ছিলো না। ভদ্রলোক মারা যাবার পরে বুশরা কিছুটা মচকে গেলেও ভেঙে পড়েনি। বললো, রেজা ভাই এখন আপনি আমাকে দেখলে চিনতেই পারবেন না। হিজাব পড়ি। বাসা থেকেই ব্যবসাটা ধরে রেখেছি। এই ছোট্ট আয়টুকু ছাড়া আমার আর কোনোই আয়ও নেই। আমার স্বামী বেঁচে থাকতেও কোন পয়সা দিতো না, আর আমিও ওর কাছে চাইতামও না। এখনতো ও নেই। তো বুঝতেই পারেন। সারাদিন নামাজ পড়ি। কোরআন পড়ি, তজবিহ পড়ি। এই আমার এখনকার যাপিত জীবন। এপার্টমেন্ট থেকেও সপ্তাহে একদিনও বের হই না। দরকার পড়ে না। বললাম, কোথায় থাকেন। এসটোরিয়া পার্কের কাছেই একটা এপার্টমেন্টে গত ২৮ বছর থেকেই আছি। আমার ড্রইংরুমের জানালা দিয়ে ইস্ট রিভার দেখা যায়। বুড়িগঙ্গা নদীর কথা মনে পড়ে। যখন ছোট ছিলাম আব্বা বুড়িগঙ্গার ধারে প্রায়ই আমাদের বেড়াতে নিয়ে আসতেন। তারপর আব্বা একটা নৌকা ভাড়া করে নদীতে কিছু সময় কাটাতাম আমরা বলেই কেঁদে দিলো। বললো দেশ ছেড়েছি তাও প্রায় ২৮ বছর। আর যাওয়া হয়নি প্রিয় সেই নদী বুড়িগঙ্গার কাছে। বলেই বললো যাক বাদ দেন আমার কথা। বলেন, আপনি কি করছেন এখন, কোথায় থাকেন। যোগাযোগটুকু রাখবেন প্লিজ।
বুশরার সাথে কথা বলতে বলতে মনে পড়লো ৮০’র শেষ দিকে আমার সাথে এক সহকর্মী ছিলো, যখন দোকানে পার্ট টাইম কাজও করতাম। ওর নাম পড়শী। ও প্রায় দু’তিনটা ভাষা জানতো। নিউ ইয়র্ক শহরের সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ বলতে স্পানিশ ভাষাতে কোন বাঙালিকে আমি এভাবে অনর্গল কথা বলতে শুনিনি। কি করে এই স্পানিশ ভাষায় ও দক্ষ হলো একদিন গল্পে সেই গল্প বলেছিলো পড়শী। অনেকটাই বুশরার মতো গল্প ছিলো সেটাও। একটা ছেলেকে পড়শী ভীষণ ভালোবাসত। কিছু কারণে পড়শীর বাসার কেউ রাজি ছিলো না ঐ ছেলেটার সাথে পড়শীকে বিয়ে দিতে। ছেলেটি থাকতো সুইডেনে। পড়শী পরিবার পড়শীর বিয়ে ঠিক করে আরেক জায়গাতে। পড়শী সেই ছেলেটিকে জানালো সে অন্য কাউকে ভালোবাসে, তাই পড়শীর পক্ষে সম্ভব না তাকে বিয়ে করা। ছেলেটি বলেছিল নাকি তার কোনো আপত্তি নেই। তবু সে পড়শীকে চায়। পড়শীর কথা তাহলে বিয়েটা হবে কাগজে কলমে কিন্তু এর এক পা-ও এগুবে না। ছেলেটা ফেরত যায়। পড়শীর বাবা-মা অসুস্থ হন। পড়ে ওর বাবা মারা যায়। পড়শী কোনভাবে ব্যবস্থা করে ছুটে আসে সুইডেন। ওর ভালোবাসার মানুষের সাথে ওর বিয়েও হয়। কিন্তু বিয়ের দুই বছরের মধ্যে ওদের সম্পর্ক তীক্ত হয়ে যায়। পরিণতি ডিভোর্স। পড়শী সুইডেন থেকে তখন চলে আসে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে। কাজ নেয় বড় এক দোকানে। রাতে স্কুলে যেত। নিউ ইয়র্ক এসেই ও বুঝতে পারছিল এই শহরের ভাষা ইংরেজির চেয়েও স্পানিশ গুরুত্বপূর্ণ। এরপর পুরো দস্তর স্পানিশ ভাষা শিখে। স্পানিশ ভাষা শেখার পরই নাকি ও বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজের অফার পেতে থাকে। ইংরেজিতে ও দুর্বল ছিল বলে কর্পোরেট জবে যেতে পারছিলো না। তখন ইংরেজিকে মেজর করে গ্রাজুয়েশন করে। একদিন সন্ধ্যায় দোকানে প্রায় কোনো কাস্টমারই ছিলো না। পড়শী তখন গালগল্পে বললো ওদের বাসা ছিলো নারায়ণগঞ্জে। তোলারাম কলেজে যখন ও পড়তো ছেলেটার সাথে সেখানেই দেখা। ছেলেটা তখন ছাত্র রাজনীতিতে ছিলো। পড়শীর ভালো লাগতো ওর বক্তৃতা। প্রেমে পড়ে যায়। এরপর ছেলেটা সুইডেন চলে আসে, ওদের ভালোবাসাতে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। পড়শী ওকে বিয়ে করতে বলাতে ছেলেটা নাকি বলতো আগামী পাঁচ, ছয় বছরের আগে হবে না। পড়শী বললো জানেন আমি মেনে নিয়েছিলাম। বাসাতে যুদ্ধ করেছি অনেক ওর জন্য। একটা কারণ ছিলো, ওদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না আমাদের তুলনায়। এটা বাবা মা আমি তাদের এক মাত্র সন্তান ছিলাম বলেও মেনে নেননি। জীবনে আর বিয়ে করবো না বলেই বললো নদীর মতই জীবন বয়ে যাবে কিন্ত কোন ঘাটে আর নৌকা ভিড়াবো না।
একটা গানের মৃদু অন্তরা মনে পড়লো -এই সব স্মৃতি নিয়ে লিখতে গিয়ে।
“নদীর এ পাড় ভাঙে, ওপার গড়ে
এই তো নদীর খেলা
সকাল বেলা ধনীরে তুই
ফকির সন্ধ্যা বেলা।”

এই জীবন অভিবাসীদেরও।

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক।
৫ অক্টোবর, ২০১৮।