ড. মাহবুব উদ্দীন চৌধুরী :
২১ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। সত্তর পাড়ি দিয়ে আজ একাত্তরে পড়ল, সেই অমর একুশে। আমি তখন ঢাকার নবকুমার স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র। আমার সেই শৈশব ও কৈশর লগ্নের সন্ধিক্ষণে ঘটে যাওয়া সেই বৈপ্লবিক দিনটির ঘটনাবহুল পটভূমি, যা বহুদিন পরে আমার কাছে পাঠানো সেদিনের সেকালের এক তুখোড় ছাত্রনেতা- গাজীউল হকের লেখা তুলে ধরার চেষ্টা করব আজ। গাজীউল হক ভাইকে তখন চিনতাম না বা চেনার কোনো উপায়ও ছিল না। উনি বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র, আমি স্কুলে পড়ি। তবে সেদিন আমতলার সেই যুগান্তকারী সমাবেশে তিনি ছিলেন সভাপতি। আর আমরা ক্ষুদে যে কয়জন, দেখতে ছোট ও বয়সেও কম স্কুলছাত্র, সেই সমাবেশে যোগ দিতে যাই, সেদিন বড় ভাইয়েরা সামনের কাতারে বসিয়ে দিয়েছিলেন। তাই খুব কাছ থেকেই সভাপতি ও অন্য বক্তাদের দেখতে পাই এবং তাঁদের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আবেগপ্লুত হয়ে সভাশেষে সত্যাগ্রহী কায়দায় বিশ^বিদ্যালয়ের গেটের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়ে উঠেনি। আমরা গেটের কাছে পৌঁছানোর আগেই পুলিশ টিয়ারগ্যাস ছুঁড়বে ছুঁড়বে রব উঠে, আর একথা শুনে আশপশে থাকা বড় ভাইয়েরা আমাদের পানিতে কাপড় ভিজিয়ে দেন, ও তা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে উল্টাদিকে দৌড়ে বিশ^বিদ্যালয়ের দূরের একটা বিল্ডিংয়ে চলে যেতে নির্দেশ দেন। তাদের নির্দেশ মেনে আমরা দৌড়াই, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই সর্বত্র টিয়ারগ্যাসে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আমরা কাবু হয়ে পড়ি, আর ভেজা কাপড় দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে রক্তচক্ষু নিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের সেই দূরের একটা ক্লাসরুমে আশ্রয় নেই। সেখানে আরও অনেকেই ইতিমধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। ছোখের জল ও জ¦ালা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে, বাইরের অবস্থা শান্ত হয়েছে আশ^াস পেয়ে আমরা বেরিয়ে আসি। দেখলাম বিশ^বিদ্যালয়ের গেটের বাইরে থেকে পুলিশ সরে গেছে, শুনলাম তারা মেডিকেল কলেজ গেটে অবস্থান নিয়েছে।
আমরা তখন তৎকালীন মধুর কেন্টিনের পেছনে বিশ^বিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের মাঝখানের দেয়াল, যা ইতিমধ্যেই ছাত্ররা কিছুটা ভেঙে ফেলেছে তা টপকে মেডিকেল কলেজে ঢুকলাম। সেখানে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে ঢুকতেই দেখলাম মেডিকেলের ছাত্র-ছাত্রীরা ট্রেতে ওষুধ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং যাদের চোখে টিয়ারগ্যাস লেগেছে তাদের চোখে ওষুধ দিচ্ছে। আমাদেরও তা দিল এবং ছোট দেখে আমাদের বেঞ্চে বসিয়ে রাখলো। আর বাইরের অবস্থা শান্ত না হওয়া পর্যন্ত সেখানে বসে থাকতে বললো। সেখানে বসে থাকা অবস্থায়ই জানতে পারলাম পুলিশ গুলি ছুঁড়েছে। আহত হয়েছে বেশ কজন ছাত্র। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের রুমের বেড ও করিডোরে আহত ছাত্রদের নিয়ে আসা হচ্ছে। উপস্থিত ডাক্তার এবং মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও নার্সরা তাদের চিকৎসা দিচ্ছে দেখলাম।
ওদিকে মেডিকেল কলেজের গেট দিয়ে বেরুতেও বাধা পেয়ে ছাত্ররা মেডিকেল কলেজের হোস্টেল, যেগুলো ছিল দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় নির্মিত মিলিটারি ব্যারাক, সেগুলোর কাঁটাতারের গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে নিকটস্থ আইন পরিষদ ভবনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইন পরিষদ ভবনটি ছিল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রধান ভবনে, যা মেডিকেল হোস্টেলের খুব কাছাকাছি। উদ্দেশ্য আইন পরিষদ ভবন ঘেরাও করা। তাদের সেই চেষ্টাকে প্রতিহত করতে সশস্ত্র পুলিশ আতর্কিতে গুলি চালায়। ভাষার দাবিতে ঢাকার মাটি লাল হয়ে যায়। সেদিন শহীদ হলেন আবুল বরকত, রফিক ও নাম নাজানা ১২-১৩ বছরের এক কিশোর। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সেই ব্যারেক হয়ে উঠলো এক পূণ্য ভূমি।
ছাত্ররা সেই ব্যারেকের পাশেই ২২ ফেব্রুয়ারি রাতের অন্ধকারে একটা শহীদ মিনার গড়ে তুলে। তবে সেটা পরদিনই পুলিশ গুঁড়িয়ে দেয়। পুলিশ বার বার গুঁড়িয়ে দেয়া সত্ত্বেও ছাত্ররা বার বার সেই চিহ্নিত স্থানে শহীদ মিনার পূণর্নির্মাণ করে। শেষ পর্যন্ত পরবর্তী সরকার এলে একটা স্থায়ী শহীদ মিনারও সেখানে তৈরি হয়। ক্রমে সেই শহীদ মিনার হয়ে উঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমূলে ধ্বংস করার মানসে ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ এর পরপরই পাকিস্তান হানদার বাহিনী সেই শহীদ মিনারটিকে সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হলে সেদিনের সেই শহীদ মিনারটি আবার গড়ে উঠে সেদিনের ভাষা শহীদদের রক্তঝরা সেই স্থান ও আশপাশের ব্যাপক এলাকাজুড়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক জ¦লন্ত প্রতীক হয়ে।
ফিরে যাই গাজী ভাইয়ের কথায়। ইতিমধ্যে ১৯৫২ এর ঐতিহাসিক সেই দিনটির প্রায় ৪০ বছর পার হয়েছে। গাজী ভাইয়ের সঙ্গে বেশ নিবিড় পরিচয় হয়েছে আমার অনুজপ্রতিম ভগ্নিপতি নাঈমের মাধ্যমে। আমি তখন থাইল্যাণ্ডের রাজধানী ব্যাংককে জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক সংস্থায় (টঘ ঊঝঈঅচ) মহাকাশ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। নাঈম তখন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। পরবর্তীকালে নাঈম সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন উর্ধ্বতন বিচারপতি হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন। বিচারপতি নাঈমের সঙ্গে গাজী ভাইয়ের সঙ্গে আগ্রজ-অনুজ বন্ধুপ্রতিম সম্পর্ক। সেই সুত্রে আমারও গাজী ভাইয়ের সঙ্গে সেই ধরণের সম্পর্ক গড়ে উঠে। তারই সূত্র ধরে একবার ব্যাংকক থেকে ঢাকা এলে গাজী ভাইকে ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ এর আমতলার সেই ঐতিহাসিক সমাবেশে সামনের সারিতে বসে থাকার আমার সেই বাল্যস্মৃতির কথা বলি। স্বভাবতই তাঁর মনে থাকার কথা না, তবুও আবেগাপ্লুত মনে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দেখলাম তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো।
গাজী ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তারপর থেকে ক্রমেই বেড়ে চললো। সেই সুযোগে একদিন তাঁকে বলেই ফেললাম ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ এর সেই যুগান্তকারী সভার সভাপতি হিসেবে আপনাকে ভাষা আন্দোলন তথা বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সেইদিনের সর্বাধিনায়ক বলা চলে। তাই জাতিকে জানিয়ে যান সেদিনের ভাষা আন্দোলনের সত্যিকারের পটভূমি। আমার জানামতে তিনি কোনিদিনই ভাষা আনোলনের মহানায়ক হয়েও কোনো কিছু চাননি বা পানও নাই। ব্যথাতুর হৃদয়ে সেদিন কেবল বলেছিলেন, কি লিখব ও কে পড়বে, আমার লেখা পাগলের প্রলাপ। হয়তো তিনি লিখেছেন, হয়তো কেউ পড়ে চেপে গেছে, হয়তোবা কেউ পড়েই নাই তার সেসব যুগান্তকারী লেখা। তাই জীবনযুদ্ধে তিনি একজন পদাতিকই রয়ে গেছেন, সর্বাধিনায়কের ইস্পিত সম্মান বা সেদিনের অনেক ভাষাসৈনিকের মতো জীবন সমৃদ্ধিও পাননি তিনি।
ঐা হোক সেদিনের আলোচনার খেই ধরে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা তাঁর এমন একটি পাণ্ডুলিপি আমার হাতে আসে ১৯৯২ সালে। আমিও চেপে থাকি দীর্ঘদিন ধরে। তবে দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায়, যারা বায়ান্নোর ২১ শে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে আমার বাল্যকালের সম্পৃক্ততার কথা জানতো তারা আহ্বান জানালে আমাকে কিছু-না-কিছু বলতে বা লিখতে হতো। গাজী ভাইয়ের সেই লেখা তখন কাজে লাগাতাম। আর এই ব্যাপারে পত্রপত্রিকায়ও প্রায় প্রতি বছরই ২১ ফেব্রুয়ারিতে স্বেচ্ছায় লিখতাম যাতে নতুন প্রজন্মকে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এর দিনপঞ্জির সঠিক বৃত্তান্ত মনে করিয়ে দিয়ে যেতে পারি। এবার তাই ২১ ফেব্রুয়ারির আগমন বার্তা ও সেই উপলক্ষে ‘সপ্তাহিক ঠিকানা’র বিশেষ সংখ্যায় লিখার আমন্ত্রন পেয়ে গাজী ভাইয়ের সেই পুরানো লিখাটি থেকে নিংড়ে আনা কিছু সঠিক তথ্য সংযোজন করে অমর একুশের সত্যিকারের পটভূমি তুলে ধরার উদ্যোগ নিলাম।
এই প্রসঙ্গে প্রথমেই জানা দরকার- কোন প্রেক্ষাপটে এলো ২১ ফেব্রুয়ারি? সেদিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের সভা বসবে আইন পরিষদ ভবনে। তখন আইন পরিষদ ভবন ছিল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রধান মিলনায়তনে। সেদিন সেখানে উপস্থিত থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন, তার মন্ত্রী সভার সদস্য ও আইন পরিষদের সকল সদস্য। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররা সেদিন প্রদেশব্যাপী হরতাল দিয়ে মিছিল করে আইন পরিষদ ভবন ঘেরাও করে সরকারের কাছে সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবি আদায় করবে, এই ছিল তাদের সেদিনের কর্মসূচী। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, সে সময়ের রাজবন্দীদের মধ্যে একজন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
রাজবন্দীদের মুক্ত করার এই আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে ১৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন জিল্লুর রহমান (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি)। বক্তৃতা করেন তৎকালীন তুখোড় ছাত্রনেতা নাদিরা বেগম ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হক চৌধুরী। সভায় ১৭ সদস্যের বিশ^বিদ্যালয় রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক করা হয় গাজীউল হককে। পাকিস্তান জন্মের পর এটাই ছিল প্রথম রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলন কমিটি। সেদিনের ছাত্রসভা শেষে ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র সমাবেশ ও পরবর্তী ঘেরাও কর্মসূচী ঘোষণা করা হয় এবং তা জানিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সেটে দেয়া হয়।
প্রস্তুতি ঠিকমতোই চলছিল, তবে তাতে নুরুল আমীনের তাবেদারী সরকারের টনক নড়ে উঠে। সেসব প্রস্তুতি দেখে ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুরের দিকে সরকার পরদিন অর্থাৎ ২১ তারিখ সকাল থেকে ঢাকা শহরে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টার দিকে যখন মধুর ক্যান্টিনে বসে গাজী ভাই ও তাঁর সহযোগীরা মিটিংয়ের পিকেটিংয়ের জন্য স্বেচ্ছাসেবকের তালিকা তৈরি করছিলেন তখন মাইকযোগে প্রচারিত ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা তাদের কানে ভেসে এলো। তাঁরা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। মাইকের আওয়াজে আমরাও সেই ১৪৪ ধারা জারির কথা শুনলাম। পরে বড়দের কাছে শুনলাম কাল কোনো মিছিল মিটিং করা যাবে না, এমনকি দল বেঁধে চলাফেরাও করা যাবে না। একসঙ্গে ৪ জনের বেশি হাঁটাচলাও করা যাবে না, তাতে ১৪৪ ধারা ভাঙার অপরাধে পুলিশ গ্রেফতার করবে।
মেডিকেল কলেজ থেকে উত্তেজিত ছাত্ররা মধুর ক্যান্টিনে এসে জানালো সরকারের তরফ থেকে রটিয়ে দেয়া হয়েছে সক্ষম রোগীদের চলে যেতে হবে, হাসপাতালের বেড খালি করতে হবে, যাতে পরদিন পুলিশের হাতে আহত ছাত্রজনতাদের সেগুলোতে রাখা যায়। সবই ছিল ছাত্রদের ভীতসন্ত্রস্ত করা। হিতে বিপরীত হলো। ছাত্ররা আরও মারমুখী হয়ে উঠলো। সেদিন সন্ধ্যায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ফকির সাহাবউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় সিদ্ধান্ত নিলো ছাত্ররা ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা মেনে নিবে না। অনুরূপ সিদ্ধান্ত নিল ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্রসভায় আব্দুল মোমিনের সভাপতিত্বে। মেডিকেল কলেজের ছাত্রনেতা আহমেদ রফিকও জানালেন তারাও এব্যাপারে একমত। ইতিমধ্যে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠন করা হয়। তাই ছাত্রসভার এসব সিদ্ধান্ত ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ’কে জানিয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে আব্দুল মোমিন ও শামসুল আলমকে (ফজলুল হক মুসলিম হলের সহসভাপতি) দায়িত্ব দেয়া হলো।
সেদিনই সন্ধ্যার পর নবাবপুর আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে আবুল হাসিমের সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের’ সভা বসে। যথাসময়ে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ এর সভায় উপস্থিত হয়ে ছাত্রসভাগুলোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন তাঁরা। তাতে বিতর্কের সৃষ্টি হলো। সামনে নির্বাচনের সম্ভাবনা, এখন ১৪৪ ধারা ভাঙলে হাঙ্গামা হবে এবং সেই সুযোগে মুসলিম লীগ সরকার নির্বাচন বন্ধ করে দেবে। তাই ১৪৪ ধারা ভাঙা যাবে না বলে অনেকেই মতামত দিলেন। তবে বিদ্রোহ করে বসলেন যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে জানালেন সরকারি আদেশ মেনে নেয়া অর্থাৎ ১৪৪ ধারা না ভাঙার অর্থ হলো ভাষার দাবির কবর দেয়া। এটা হতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের অধিকাংশ সদস্য তাদের মতে স্থির রইলেন। শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটি হলো। অলি আহাদ সাহেব ও তাঁর সমর্থকেরা ১১-৪ ভোটে পরাজিত হলেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ সিদ্ধান্ত নিলো ২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে না।
উত্তেজিত অলি আহাদ উঠে দাঁড়ালেন, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘এ সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। আগামীকাল বিশ^বিদ্যালয়ে যে ছাত্রসভা হবে সেই সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে যদি রায় হয় তবে আমরা ভাঙার পক্ষেই থাকবো।’ অলি আহাদের বক্তব্যে সভাপতি ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘বিশ^দ্যিালয়ে যে ছাত্রসমাবেশ হবে, সে সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে শামসুল হক রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত ছাত্রদের জানিয়ে দেবেন। যদি তবুও ছাত্ররা ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে তবে স্বাভাবিকভাবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বিলুপ্তি ঘটবে।’ সভাপতির এই বক্তব্য প্রস্তাব আকারে গৃহীত হলো। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে সাড়াও পাওয়া গেল। সেদিনই রাত ১২ টার দিকে ফজলুল হক মুসলিম হল ও ঢাকা হলের মাঝখানের পুকুরের পূর্ব পাড়ের উত্তর ধারের সিড়িতে চুপিসারে সমবেত হলো বিভিন্ন ছাত্রাবাসের ১১ জন নেতৃস্থানীয় ছাত্র পর দিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে।
সেদিনের সেই বৈঠকে যে ১১ জন ছিলেন তাঁরা হলেন মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান শেলী (পরবর্তীকালে প্রধান বিচারপতি), মোহাম্মদ সুলতান (যুব লীগের যুগ্ম সম্পাদক), জিল্লুর রহমান (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি), আব্দুল মোমিন (আওয়ামী লীগ সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য), এস. এস. বারী এটি (ছাত্রনেতা), এম. আর. আখতার (মুকুল), কামরুদ্দীন মসুদ (পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্র বিভাগের অধ্যাপক), আনোয়ারুল হক খান (ফজলুল হক মুসলিম হলের সাধারণ সম্পাদক), আনোয়ার হোসেন (খুলনা থেকে আসা ইকবাল হলের আবসিক ছাত্র), মঞ্জুর হোসেন (ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র নেতা) ও গাজীউল হক (ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ও বিশ^বিদ্যালয় রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক)। বৈঠকে স্থির হলো যেকোনো মূল্যেই হোক ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভাঙতে হবে। পুকুরপাড়ের সেই বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হলো পরদিনের আমতলার সেই সভায় সভাপতিত্ব করবেন গাজীউল হক।
তবে সন্দেহ হচ্ছিল সরকার সেই সভা পণ্ড করার উদ্দেশ্যে সভার সঙ্গে জড়িত নেতাদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠাবে। তাই সেই বৈঠকে ঠিক হলো অনুষ্ঠানের আগে যদি গাজীউল হক গ্রেফতার হন, তবে সভাপতিত্ব করবেন এম. আর. আখতার (মুকুল)। আর মুকুলও যদি গ্রেফতার হন তবে সভাপতিত্ব করবেন কমরুদ্দীন মসুদ। বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সভার শুরুতেই শামসুল হককে বক্তৃতা করতে দেয়া হবে। যাতে তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত সবাইকে জানিয়ে দিতে পারেন। তারপর বক্তৃতা করবেন বিশ^বিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আব্দুল মতিন (ভাষা মতিন)। সবশেষে সভাপতির ভাষণ দিবেন গাজীউল হক। ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত দিবেন তিনি। তবে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে সত্যাগ্রহী কায়দায় অর্থাৎ ১০ জন ১০ জন করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে। এটাও ঠিক হলো সত্যাগ্রহীদের প্রথম দলের নেতৃত্ব দিবেন বিশ^বিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র হাবীবুর রহমান শেলী। স্বল্পক্ষণ স্থায়ী সেই বৈঠকে কোনো প্রকার বিতর্ক ছাড়াই নেয়া হলো এসব ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।
ঐতিহাসিক সেই পুকুর পাড়ের বৈঠক শেষে সবাই চলে গেল নিজ নিজ হল ও কক্ষে। থাকলেন কেবল দু’জন -আব্দুল মোমিন আর গাজীউল হক। মোমিনের সন্দেহ হচ্ছিল গাজীউল হককে রাতেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, যাতে তিনি পরদিনের ছাত্রসভায় উপস্থিত থাকতে না পারেন। তিনি তাই গাজীউল হককে কক্ষে না গিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের কলা ভবনে ঢুকে আত্মগোপন করে রাতটা কাটাতে বললেন। আব্দুল মোমিনের যুক্তি মেনে নিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম ও মাঠ পাড়ি দিয়ে মেডিকেল কলেজের ভেতর দিয়ে মধুর ক্যান্টিনের পেছনের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে সবার অগোচরে বিশ^বিদ্যালয়ের আর্টস বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়লেন গাজীউল হক। ঘড়িতে দেখলেন তখন রাত প্রায় সাড়ে তিনটা। নিজেকে তার বড় নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল। মোমিন তাকে বিশ^বিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে নিজের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অন্যত্র চলে গেলেন।
গাজী ভাই বিশ^বিদ্যালয়ের কলা ভবনের দোতলায় উঠার সিড়ির এক কোনে গুটিসুটি মেরে বসে থাকলেন। একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন, তবে তন্দ্রাটা কেটে উঠলে নিজেকে কিছুটা সতেজ করে তুলতে একটু পায়চারী শুরু করলেন দোতলার বারান্দায়। ভোর হতে আর কিছুক্ষণ, দেখলেন ইতিমধ্যে পূর্ব আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে আগামী দিনের সূর্য উঠবে, শুরু হবে এই দেশের সংগ্রামী মানুষের নতুন অভিযান, এক দুঃসাহসিক পদযাত্রা। উঁকি মেরে দেখলেন বিশ^বিদ্যালয়ের গেটের উল্টো দিকে রাস্তাজুড়ে লাইন করে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে শত শত পুলিশ। তারা সম্ভবত শেষরাত থেকেই অবস্থান নিয়েছে।
যথাসময়ে সূর্য উঠলো, গাজী ভাই সিড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন। আর্টস বিল্ডিংয়ের দেয়াল ঘেসে গুটিসুটি মেরে পুলিশের চোখ এড়িয়ে মধুদার দোকানের পেছনের দরজায় হাজির হলেন। সেখানে কিছুক্ষণ ঠোকা দিলে মধুদার কর্মচারী একটা ছেলে দরজা খুলে দেয়। তিনি ছাত্রনেতা তাই তাঁকে চিনত। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি তাঁকে এক কাপ চা ও টোস্ট বিস্কুট এনে দিলো। চা খেতে খেতে জনালা দিয়ে দেখলেন বিশ^বিদ্যালয়ের গেটের বাইরে পুলিশের আনাগোনা অনেক বেড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ২জন ২জন করে বিভিন্ন হল ও হোস্টেল থেকে ছাত্ররা এসে লোহার শেকলে আংশিকভাবে আটকানো ও আড়াআড়িভাবে খোলা, বিশ^বিদ্যালয়ের গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে শুরু করলো। ১৪৪ ধারা না মানার অজুহাতে পুলিশ যাতে হয়রানি করতে না পারে সেজন্য ছাত্রদের ২ জন ২ জন করে হেটে আসার কথা আগে থেকেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।
নেতাদের সবাই ৯ টার মধ্যে চলে এলেন। মধুদার ক্যন্টিনের চা ও সিঙ্গাড়া খেতে খেতে সেদিনের সভার কর্মসূচী ঠিকঠাক করতে লেগে গেলেন। প্রায় ১০টার মধ্যে বিভিন্ন হল, হোস্টেল ও স্কুল-কলেজ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীতে বিশ^বিদ্যালয় প্রাঙ্গন প্রায় ভরে গেলো। আমরা তখন থাকতাম আজিমপুর কলোনীতে। আমরাও সকাল সকালে দল বেঁধে রওনা দিলাম বিশ^বিদ্যালয়ের সেই ছাত্রসভায় যোগ দিতে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনে পৌঁছালে পিকেটিংরত ছাত্র বড় ভাইয়েরা আমাদের দুই জন দুই জন করে, একটু দূরত্ব বাজায় রেখে হেঁটে যেতে বললেন। আমরা তখন দুই জন দুই জনে ভাগ হয়ে হেঁটে চললাম বিশ^বিদ্যালয়ের দিকে। আমার সঙ্গে ছিল আমার বাল্যবন্ধু মুহিবুর রহমান (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের চীফ ইঞ্জিনিয়ার)। আইন পরিষদ ভবন থকে বিশ^বিদ্যালয় গেট পর্যন্ত সারা রাস্তার বাম পাশজুড়ে সশস্ত্র পুলিশের উপস্থিতি দেখতে দেখতে আমরাও প্রায় ১০ টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম বিশ^বিদ্যালয় চত্বরে।
প্রায় সাড়ে ১১ টায় শুরু হলো বিশ^বিদ্যালয় আমতলায় সেই ঐতিহাসিক সভা। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সভাপতি হিসেবে গাজীউল হকের নাম প্রস্তাব করলেন এম. আর. আখতার মুকুল, সমর্থন জানালেন কমরুদ্দীন মসুদ। আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথমেই ডাকা হলো শামসুল হককে তার বক্তব্য পেশ করতে ও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত সভাকে জানিয়ে দিতে। শামসুল হক অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। কিন্তু সেদিন ব্যর্থ হলেন তিনি, ছাত্রদের সম্মিলিত ও উত্তপ্ত বিক্ষোভে তার কণ্ঠ চাপা পড়ে যেতে লাগলো বারবার। তার পরপরই শামসুল হকের বক্তব্য ও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভাঙার স্বপক্ষে জ¦ালাময়ী ভাষায় বক্তব্য রাখলেন আবদুল মতিন (ভাষা মতিন)। উত্তেজিত হয়ে উঠলো সেদিনের আমতলায় জড়ো হওয়া সেই ছাত্রসভার হাজারো ছাত্র-ছাত্রী।
সেদিনের শেষ বক্তা ছিলেন ঐতিহাসিক সেই ছাত্রসভার সভাপতি গাজীউল হক। সভাপতির ভাষনে তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভাঙার ঘোষণা দেন। আর ১৪৪ ধারা ভাঙলে বিশ^বিদ্যালয়ের বাইরে মোতায়েন করা পুলিশ ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করবে, নুরুল আমীন সরকারের দেয়া সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, ‘১৪৪ ধারা আমরা ভাঙবই। আমরা দেখতে চাই নুরুল আমীন সরকারের বারুদাগারে কত বুলেট জমা আছে। ১০ জন ১০ জন করে শান্তিপূর্ণভাবে সত্যাগ্রহ করা হবে- ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে।’ আবার তুমুল উত্তেজনা। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে বিশ^^বিদ্যালয় প্রাঙ্গন। সঙ্গে সঙ্গে সত্যাগ্রহী দল গঠনের কাজ শুরু হয়ে যায়। সত্যাগ্রহীদের নাম ঠিকানা লিখে রাখার দায়িত্ব দেয়া হয় মোহম্মদ সুলতানকে। আর তাকে সাহায্য করার দায়িত্ব দেয়া হয় হাসান হাফিজুর রহমানকে (কবি, সাহিত্যক ও সাংবাদিক)।
আগের রাতের ফজলুল হক হলের পুকুরঘাটের সিড়ির মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক হাবীবুর রহমান শেলীই প্রথম সত্যাগ্রহী দল নিয়ে বেরিয়ে যান বিশ^বিদ্যালয়ের আধখোলা গেট দিয়ে। দ্বিতীয় দলটি নিয়ে বেরিয়ে যান ইব্রাহিম তাহা, ডা. আজমল ও আবদুস সামাদ এবং তৃতীয় দল নিয়ে বের হন আনোয়ারুল হক খান। তিনটি দলকেই গ্রেফতার করে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। এমনি সময়ে পুলিশের তরফ থেকে গেটের দিকে হামলা ও লাঠিচার্জ শুরু হয়। লাঠিচার্জের পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তে একটু রদবদল করা হয়। ঠিক হয় চতুর্থ দলটিতে যাবে কেবল মেয়েরা। তখন মহিলা পুলিশ ছিল না, তাই পুলিশ হয়তো মেয়েদের কিছুটা হলেও ছাড় দিবে, এই ছিল সেদিনের ছাত্র নেতাদের মনে।
সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রীদের যে দলটি বের হলো তার নেতৃত্ব দেন সাফিয়া খাতুন (পরবর্তীকালে মন্ত্রী)। সেই দলে ছিলেন সুফিয়া ইব্রাহীম, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন নাহার, হালিমা খাতুন, ডা. শরীফা প্রমুখ। কিন্তু পুলিশ কোনো বাচবিচার না করে মেয়েদের উপরও লাঠিচার্জ করলো। আহত হলেন সুফিয়া ইব্রাহীম (পরবর্তীকালে ব্যারিষ্টার সৈয়দ ইস্তিয়াক আহমদের স্ত্রী) ও রওশন আরা বাচ্চু (আমাদের পরিচিত এক বড় আপা যাকে বাচ্চু আপা বলেই জানতাম)। তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো হল ছিল না। বাচ্চু আপা থাকতেন বিশ^বিদ্যালয়ের মহিলা হোস্টেল চামেলি হাউসে। মনে আছে, পরদিন অথবা ২৩ শে ফেব্রুয়ারি আমরা আহত বাচ্চু আপাকে দেখতে যাই সেখানে।
মেয়েদের গ্রেফতার না করলেও পরবর্তী সত্যাগ্রহী দলগুলোর উপর পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্র্জ করে ও প্রায় সবাইকে ট্রাকে উঠিয়ে জেলে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যে পুলিশ বিশ^বিদ্যালয়ের গেট ও অভ্যন্তরে টিয়ারসেলগ্যাস ছুঁড়তে শুরু করে। লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ার জন্য ছাত্ররা আরও মারমুখী হয়ে উঠে। তারা বিশ^বিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের মাঝখানের দেয়াল ভেঙে মেডিকেল কলেজ গেটের দিকে চলে যায়। সেখানে পুলিশ তাদের বাঁধা দেয়। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসে মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগ এলাকা সম্পূর্ণ ছেয়ে যায়। ভাগ্যিস সেদিন হরতাল থাকায় রোগীর ভিড় ছিল না। ডাক্তার-নার্সেরা মেডিকেল কলেজের ভেতরে আশ্রয় নেয়। আগেই বলেছি, আমরাও সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেদিন। আর আমাদের সেই অপেক্ষালগ্নে ঢাকার মাটি লাল হয়ে যায় ভাষার দাবিতে। শহীদ হন আবুল বরকত, রফিক ও নাম নাজানা ১২-১৩ বছরের সেই কিশোর। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ব্যারাক হয়ে উঠে এক পূণ্য ভূমি।
বাংলার বিপ্লবী ইতিহাসের পরম লগ্নের এক প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আমরা সেদিন বাড়ি ফিরে আসি আমাদের মা বাবার কাছে। আর যারা ফিরল না তারা তাদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেলো তাদের মা-বাবার ভাষাকে রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে। সেদিনের ভাষা শহীদদের রক্তের ভিত ধরে গড়ে উঠলো বাংলার জাতীয়বাদী আন্দোলন, যার পূর্ণতা প্রাপ্তি হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়ে। তাই একাত্তরের বিজয় যেমন আমাদের উল্লাসে মাতায়, অমর একুশের আত্মাহূতি তেমনি আজও আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়। আজ থেকে একাত্তর বছর আগে মরহুম গাজী ভাই, মতিন ভাইসহ যারা সেদিন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যাদের অনেকের নাম গাজী ভাইয়ের লেখাটি থেকে আজ উল্লেখ করলাম, তাদের অনেকেই আজ আর নেই, তাঁরা বা যারা অনুল্লেখিত রয়ে গেছেন, তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর শপথে অবিচল থাকতে জাতির প্রতি আবেদন জানাচ্ছি এবং সেই ঘটনাবহুল দিনের একজন শাশ^ত সাক্ষী হিসেবে সেদিনের নেতানেত্রীদের সহগামী হওয়ার সৌভাগ্য পাওয়ায় নিজে কৃতার্থ বোধ করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক।