রোমিনা লোদী (জয়িতা) : টেক্সাসের অস্টিন শহরে গত ২৯ অক্টোবর মঞ্চস্থ হলো ঢাকা থিয়েটারের নাটক ‘পঞ্চনারী আখ্যান’। নাটকটি রচনা করেছেন হারুন রশীদ আর নির্দেশনায় ছিলেন শক্তিমান অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম। অস্টিন শহরে প্রায় ৩০০ নাট্যপ্রেমী বাংলাভাষী দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করল দুর্দান্ত অভিনেত্রী রোজী সিদ্দিকী অভিনীত এই একক মঞ্চনাটকটি। অগণিত দর্শক-শ্রোতার মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। এই মনোড্রামা পুরোমাত্রায় উপভোগ করেছি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। অস্টিনের বিমোহিত দর্শকেরা একদম টুঁ শব্দটি না করে টানা দেড় ঘণ্টা নাটকটি দেখে যায় প্রবল উচ্ছ্বাসে।
অভিনেত্রী রোজী সিদ্দিকী, পুরুষশাসিত সমাজের পাঁচটি নিগৃহীত, অবহেলিত, শোষিত, নারী চরিত্রকে তার অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন দেড় ঘণ্টার এই নাটকটিতে। জুলেখা, নাজমা, মনোরমা, মরিয়ম কিংবা ইতিহাসের মোগলসম্রাজ্ঞী মমতাজ- সবার জীবনেরই করুণ পরিণতি একে একে পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠছিল আমাদের চোখের সামনে। একক শিল্পী হিসেবে টানা দেড় ঘণ্টা ধরে মঞ্চে উপস্থাপন, অল্প সময়ের মধ্যে পোশাক পরিবর্তন এবং অবিরত ডায়ালগ বলে যাওয়া, মঞ্চনাটকের মাপকাঠিতে শিল্পীর এক অসামান্য মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছে। হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা, আক্রোশ, আপত্তি, কোনো আবেগেরই কমতি ছিল না তার অভিনয়শৈলীতে। ঘরে, বাইরে, সাম্প্রতিক সময়ে কিংবা ইতিহাসের পাতায়, নারীদের অবস্থান ও তাদের জীবনের নির্মম কাহিনিচিত্র বারবার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে তাদের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী যেমন পুরুষ, তেমনি দায়ী আমরা নারীরাও।
রাটলেজ এলিমেন্টারি স্কুলের অডিটরিয়ামে আফজাল হোসেনের ডিজাইনে নির্মিত চমৎকার একটি স্টেজ গঠন করা হয়; যেখানে শোভা পায় কাঠের তৈরি প্রপস, অভিনেত্রীর পোশাক এবং চমৎকার স্পটলাইট। সব মিলিয়ে এককথায় অসাধারণ একটি পরিবেশনা, যা অস্টিনে বসবাসকারী বাঙালি কমিউনিটিকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। সবার মুখে বারবার একই কথাই ঘুরে ফিরছে, এ রকম উচ্চ মানের মঞ্চনাটক তারা বহুদিন পরে দেখল। কেউ কেউ বহুদিন বাদে দেখল বা কারও জীবনে প্রথম মঞ্চনাটক দেখার অভিজ্ঞতা হলেও সেই অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ।
আমি বরাবরই বাংলা নাটকের প্রতি প্রবল অনুরাগী। হোক না সেটা অনলাইনে, টিভিতে বা স্টেজে। এখানে লোকাল বাঙালি কমিউনিটির পহেলা বৈশাখ বা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা নাটকে আমি শখের বশে বেশ কিছু অনভিজ্ঞ, অপেশাদার অভিনয়ও করেছি। ওইদিন সামনের সারিতে বসে আমি স্টেজের নারী চরিত্রগুলোকে একমনে অবগাহন করছিলাম আর মনে পড়ে যাচ্ছিল, বহুদিন আগে ঢাকায় ফেলে আসা সেই বেইলি রোডের স্মৃতিগুলো। বেইলি রোডের নাট্যপাড়ায় পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মঞ্চনাটক দেখতে যাওয়া, বাইরে চটপটি, ফুচকা, শিঙাড়া খাওয়া, পাশেই মা-খালাদের জন্য টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের হাতছানি। আহা, কোথায় যেন হারিয়ে গেল সেই রঙিন দিনগুলো।
অস্টিনের শহরে এই প্রথম থিয়েটার প্রোডাকশনের পেশাদার বাংলা মঞ্চনাটক পরিবেশিত হয়। তাই সবার মধ্যে দেখার উৎসাহ ছিল সাংঘাতিক রকমের বেশি। শোর সব টিকিট ছিল সোল্ড আউট। নাটকটি পরিবেশনার এক দিন আগে জনপ্রিয় সেলিম দম্পতি ও ডালাস শহর থেকে আসা তাদের বন্ধু প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার ফরহাদ হোসেন, সালমা রোজী ও শাহ জুলফিকার অস্টিন শহরে আমাদের মাঝে চলে আসেন। এই মঞ্চনাটকের আয়োজক আমাদের বন্ধু দম্পতি আহসান কবির ও রথি হকের বাড়িতে তারা ওঠেন। সবার সঙ্গে পরিচিত হতে আমরা কিছু ভক্ত-অনুরাগী তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাই।
সাক্ষাতে, পরিচয়ে, গল্পে গল্পে এই গুণী মানুষগুলোর সঙ্গে দারুণ একটা সন্ধ্যা উপভোগ করি আমরা। সেলিম ভাই বলছিলেন, বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে বিভিন্ন শহরে নাটক করতে গেলে তাদের বন্ধুসম পরিজনেরা যখন সঙ্গে থাকেন, তখন কোথা থেকে আলাদা একটা শক্তি পান তারা। তিনি আরো বলছিলেন, পঞ্চনারী আখ্যান নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি সমাজের কর্ণধার ও শোষক শ্রেণির পুরুষদের দিকে আঙুল তুলে দেখাতে চেয়েছেন। ঢাকা থিয়েটারের এই একক নাটকটি সর্বপ্রথম আমেরিকার মাটিতেই মঞ্চস্থ হয়। তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন, বিদেশের এই ব্যস্ত জীবনে আমরা যারা ভালো নাটক দেখার উদ্দেশ্যে ও বাঙালি শিল্প-সংস্কৃতির টানে সময় বের করে নিয়ে এই পঞ্চনারী আখ্যান দেখার জন্য জমায়েত হয়েছি, তারা কেউ নিরাশ হব না। অত্যন্ত বিনয়ী, নিরহংকার সেলিম ভাইয়ের কথাই ঠিক হয়েছিল। আমরা কেউ নিরাশ হইনি। আপনারা যারা নাটকটি দেখেননি, সুযোগ পেলে অবশ্যই দেখবেন।
লেখক : কলামিস্ট ও ব্লগার, অস্টিন, টেক্সাস।