নূরুল ইসলাম : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো বছরখানেকের বেশি সময় বাকি। কিন্তু দিন যত ঘনিয়ে আসছে, সরকার ও বিরোধী দলগুলোর বিপরীত ও দ্বন্দ্বমূলক রাজনীতির উত্তাপ বেড়েই চলছে। সরগরম হয়ে উঠছে রাজপথ। বিএনপি ও এর শরিকরা মিছিল-সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভে ব্যস্ত। এসব কর্মসূচিতে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, দলটির প্রধান খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তিসহ নির্বাচন নিয়ে একাধিক দাবি তুলে ধরছে দলটি। সরকারের পক্ষ থেকেও গত জুলাই পর্যন্ত নমনীয় ভাব লক্ষ করা যাচ্ছিল। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং শীর্ষপর্যায়ের নেতারা বলে আসছিলেন, তারা চান বিএনপি নির্বাচনে আসুক। সরকার সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বলে তারা বক্তব্য রাখছিলেন। গত ৭ মে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে বিএনপির অংশগ্রহণের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সভায় বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সরকারকেই উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা। পরদিন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলনেও উল্লেখ করেন, তারা চান বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক।
গত মে মাসে আওয়ামী লীগের ওই বৈঠকের পর মনে করা হচ্ছিল, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু চলতি মাসে এসে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বিএনপি নেতাদের ‘সরকার পালাবার পথ পাবে না, অচিরেই পদত্যাগ করতে হবে, খেলা হবে’সহ বিভিন্ন বক্তব্য দিতে দেখা যায়। শাসক দল আওয়ামী লীগের নেতারাও বলতে শুরু করেন, ‘শোকের মাস আগস্ট পার হতে দেন, তারপর টের পাবেন, আগস্ট পার হলেই রাজপথ দখল করা হবে।’ সর্বশেষ গত ২১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘খুনিদের নির্বাচনে আনতে হবে, এমন আহ্লাদ কেন?’ তার এ বক্তব্যের পর আলোচনা বা সংলাপের সম্ভাবনা আপাতত নেই বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফরে এলে তার কাছে সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুনসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে বিএনপি। ক্ষমতাসীনরাও সমানতালে জবাব দিতে শুরু করেন। রাজনীতিতে চোখ রাখা ব্যক্তিরা মনে করছেন, বিএনপি নেতাদের আন্দোলনের হুমকি, মানবাধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিযোগ জানানোর পর সরকার কঠোর মনোভাব নিয়েছে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুনুর রশীদ বলেন, বিএনপির দাবি তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার। কিন্তু এই কনসেপ্ট তারা নিজেরাই নষ্ট করেছে নির্দিষ্ট একজন বিচারপতিকে প্রধান বানানোর জন্য বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে। আবার আদালতে যাওয়ার পর এ ব্যবস্থাই বাতিল হয়েছে। মূলকথা হলো, এটা শুধু বিএনপির দাবি, এ ইস্যুতে তারা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি বা সমর্থনও পায়নি। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক হারুন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, বিএনপি আলোচনা করতে চাইলে সরকারকে অনুরোধ করতে পারে। সেটাও হতে হবে বিনা শর্তে। তাহলে ভেবে দেখা যেতে পারে। তবে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তাদের যে মূল দুই দাবিÑনির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার এবং খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি, সেগুলোতে সরকারের কিছু করার নেই। কেননা আওয়ামী লীগ সংবিধানসম্মতভাবে নির্বাচন চায়। আদালতের রায়ে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে। তাই এ বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, কী জন্য সংলাপ, কিসের দাবিতে সংলাপ? তাদের দাবিকৃত নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অস্তিত্ব এ দেশের সংবিধানে নেই। আর সরকার সংবিধানসম্মতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। এখানে আলোচনার কিছু নেই। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে, এ দেশের স্বার্থে বিএনপির নির্বাচনে আসা উচিত। আমরা চাই সব দল নির্বাচনে অংশ নিক।