বিশেষ প্রতিনিধি : যুক্তরাষ্ট্র থেমে গেছে, সুবিধা করতে পারবে না বুঝে বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবনা ক্ষ্যান্ত দিয়ে ফেলেছে- মহলবিশেষের এমন ভাবনা মাঠে মারা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটুও বাংলাদেশের পিছু ছাড়েনি। রাখছে চোখে চোখে। এই চেয়ে চেয়ে দেখার দিনও শেষ পর্যায়ে। যার বার্তা দিয়েছে গেলবারের মতো এবারও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘গণতন্ত্রের সম্মেলনে’ বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে। আমন্ত্রিত ১১১টি দেশের তালিকায় জায়গা হলো না বাংলাদেশের। আমন্ত্রণ পেয়েছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী কাছাকাছি দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এমনকি মালদ্বীপও। ২৯-৩০ মার্চ বাইডেন সম্মেলনে এবারের অ্যাজেন্ডা তিনটি- কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিহত করা, দুর্নীতি দমন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখা।
এসব অ্যাজেন্ডার প্রতিটিতেই বড় দুর্গতিতে বাংলাদেশ। আবার যুক্তরাষ্ট্রও গোস্যা বা বাংলাদেশকে টার্গেট করেছে মর্মে কিছু বলছে না। শালীনতার অংশ হিসেবে কূটনৈতিক খায়খাতির রাখছে। তাদের সম্পর্কে রাষ্ট্র ও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আজেবাজে মন্তব্য, এমনকি রাষ্ট্রদূতকে অপদস্থ করার পরও সয়ে চলছে। দেশটির হাইপ্রোফাইলরা যাতায়াত অব্যাহত রেখেছেন। সর্বশেষ দুদিনের সফরে ঢাকা এসেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাউন্সেলর, আন্ডার সেক্রেটারি ডেরেক শোলে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ কূটনৈতিক অ্যাসাইনমেন্টগুলো পালন করে থাকেন ওই দপ্তরের অত্যন্ত প্রভাবশালী এই শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্ট, হোয়াইট হাউস এবং পেন্টাগনসহ সরকারের অভ্যন্তরে ও বাইরে মার্কিন কূটনীতিতে কাজ করে এক-চতুর্থাংশেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন। তার ঢাকা সফরটি ফলোআপ সফর।
মার্কিন অতিথিরা কেবল চীন, মিয়ানমার, রোহিঙ্গা, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির খুঁটি গাড়তেই বাংলাদেশে আসছেন বলে মনে করেন কেউ কেউ। বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধ ও বিশ্বরাজনীতির বাঁকবদলের পরিবর্তনকালে বাংলাদেশে আর মাত্র নয় মাস পর সংসদ নির্বাচন, তা এড়িয়ে যাওয়ার বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের তাগিদ দিয়েই চলছে। এ প্রশ্নে কোনো দম নিচ্ছে না। ঘটনার অনিবার্যতায় আসন্ন নির্বাচনটির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িয়ে গেছে।
মার্কিন কূটনীতিকসহ দেশটির হাইপ্রোফাইলদের ঘন ঘন বাংলাদেশে ছুটে আসার প্রশ্নের জবাব ডেরেক শোলে ঢাকায় পৌঁছার আগেই দিয়ে এসেছেন। উঁচু দরের ডিপ্লোম্যাটিক জবাব তার। বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক, এই অঞ্চল এবং সারা বিশ্বে দুই দেশের অংশীদারত্বকে যুক্তরাষ্ট্র যে কতটা গুরুত্ব দেয়, এই সফরগুলো তারই প্রমাণ। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে মন্তব্যসহ বলেছেন, ‘আমার সফরে এসব ইস্যু নিয়েই ফলোআপ করব।’ রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ সহায়তা দেবে বলে আগাম আশ্বাসও দিয়ে রেখেছেন ডেরেক শোলে। বিগত বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধ ও পরবর্তীকালে শ্রীলঙ্কায় পৃথক তামিল রাষ্ট্র, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শিখস্থান, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সেভেনে সিস্টারের মতো ঝামেলা পেকেছে। এবারের পর্বেও কোথাও কোথাও কিছু খুচরা ঝামেলা পাকছে। বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি বাহিনী নামের দুষ্টক্ষতের পর এখন রোহিঙ্গা যন্ত্রণা। একে ঘিরে দেশি-বিদেশি নানা খেলা। আন্তর্জাতিক সমীকরণও প্রচুর।
কংগ্রেসের ভাষণে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব পরিস্থিতি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে না’ ঘোষণার পর কিছু ভিন্ন আলামত দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তনের পর থেকে দেশ দুটিতে মার্কিন প্রভাব বেড়ে গেছে। দুই নৌকায় পা দিয়ে রাখা ভারত আদানি জ্বরে কাঁপছে। বিচার-বহির্ভূত হত্যা, মানবাধিকারসহ বাংলাদেশের কিছু ঘটনার তথ্য ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস হয়ে জমা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ ডেস্কে। সেই আলোকে বার্তা দিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তার ‘উন্নয়ন ও নিরাপত্তা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ঊর্ধ্বে নয়’ কথার অর্থ সরকারের জন্য মারাত্মক বিব্রতকর। পিটার হাসের ‘মানবাধিকার সুরক্ষা এবং গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা একটি দেশের অর্থনীতিকে টেকসই করে’ মন্তব্যও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সরকার সরাসরি জবাব না দিয়ে সম্প্রতি ‘কোনো চ্যালেঞ্জ’ মোকাবিলার সক্ষমতার জানান দিচ্ছে।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্যে প্রতিদিনই শক্ত হাতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার হুমকি-ধমকি আসছে। সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে র্যাব-পুলিশ, আনসার-ভিডিপি, এমনকি নৌ-পুলিশ থেকেও দেওয়া হচ্ছে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতা জানানোর বার্তা। এসব বার্তা ও হুমকিতে চ্যালেঞ্জের বিষয়বস্তু ঊহ্যই থাকছে। কী চ্যালেঞ্জ, কার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ, কে এর পক্ষ-বিপক্ষ, তা-ও পরিষ্কার নয়। সেখানে বিভিন্ন বাহিনীকে দিয়ে কাকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে- এ প্রশ্ন স্পর্শকাতর মহলকে ভাবাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বকে উদ্দেশ করে এমন ধমক-কাণ্ড হয়ে থাকলে পরিস্থিতি কোথায় গড়াবে, তা ভাবনার সঙ্গে উদ্বেগেরও বিষয়। দেশ এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রকেও তখন ভিন্ন দৃশ্যপটে পড়তে হতে পারে। আর যদি কেবল বিরোধী দলকে ভয় পাওয়াতে বা মাঠ গরম রাখতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা শোনানো হয়ে থাকে, তাহলে আরেক অর্থ দাঁড়াবে।
আজব চ্যালেঞ্জে সরকার
ঢাকার পিছু ছাড়ছে না ওয়াশিংটন