আজ কুর্চির বিয়ে

জেবুন্নেছা জ্যোৎস্না

মে মাসের প্রতিটা সন্ধ্যার ন্যায় সেদিনের সন্ধ্যাটাও ছিল উদাস। বাহ্যিকভাবে অনাড়ম্বর সন্ধ্যাটিতে শুধু কুর্চি আর তার পরিবারই একটু ব্যতিক্রম ছিল। মা হলুদ বেঁটে কুর্চিকে ছোঁয়াতে চাইলো। কিন্তু তার এসব আদিখ্যেতা পছন্দ নয়। তাই সে মা’র হাত থেকে ছোঁ মেরে হলুদটা নিয়ে নিজেই একটু ঘষে গোসল করে নিল। কিছুক্ষণ আগে সে বাজার থেকে কিছু রজনীগন্ধার মালা নিয়ে এসেছে। পার্লারে না গিয়ে অন্য সব দিনের মতো ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তার অতি সাধারণ সাজটা সেজে নিল। আজ কুর্চির বিয়ে। দু-দিন আগে এক প্রবাসী ছেলে তাদের বাসায় হঠাৎ করে এসে তাকে দেখেছিল। কুর্চি ভদ্রলোকের দিকে ফিরে ভাল করে দেখেওনি। তার সঙ্গে থাকা দুলাভাইর সাথে সে শুধু কথা বলেছে। অনেক রাতে যখন তারা বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিল, কুর্চির বাবা, জহির সাহেব রাজি হন নি। কারণ কুর্চির জন্য সে এক আর্মি অফিসারের ফ্যামিলির সাথে কথা দিয়েছে। হঠাৎ করে তার মা মারা যাওয়ায় , বিয়েটা পিছিয়ে গেছে। এছাড়াও সে তার অতি আদরের মেয়েকে অনেক দূরে বিয়ে দিতে চায়না। কুর্চি যদিও সবসময় প্রবাসী হওয়া অপছন্দ করতো , কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হলো যে এটাই তার একমাত্র মুক্তির পথ। সে তার মাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাল যে তার বিয়ে করে দেশে থাকাটা উচিত হবে না । দেশের চাইতে প্রবাসী পাত্রই তার জন্য উত্তম। কুর্চি ছেলেকে ভালভাবে না দেখে, শুনে তার বাবাকে বললো, সে এখানেই বিয়ে করবে। বাবা, মেয়েকে অনেক দূরে পাঠানোর আশঙ্কায় শয্যাশায়ী, উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারেন না। কুর্চি তখন বাবাকে বুঝালো, সে যেহেতু এখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে, মাস্টার্স কমপ্লিট না করে সে বিদেশ যাবেনা। আর এই শর্তে যদি ছেলে রাজি হয় তবে সে বিয়ে করবে।
বিয়ের আগের দিন সে ছেলের সাথে দেখা করে তার শর্তের কথা জানালে ছেলে রাজি হল। কুর্চি আরও জানালো যে সে মাথায় কাপড় দিতে পারবে না; আর স্যান্ডেল খুলে তার হাইট’টাও বোঝাল। কুর্চি জানায় তাকে ইন্টারমেডিয়েট হোস্টেলে থেকে পড়তে হয়েছে; কারণ তাদের শহরের পরিবেশ খুবই খারাপ। নবম শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে তার কৈশোরের উচ্ছল উদ্দামতা সম্পূর্ণ গৃহবন্দী হয়ে যায়। সে জানালার পাশে যেতে পারেনা, ছাদের রেলিং ধরে কোণায় দাঁড়াতে পারেনা। তদুপরি স্কুল অথবা বাইরে একা যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ বাসার আশেপাশে, স্কুলের পথের ধারে মজনুবেশী উঠতি দাড়ি-মোছ গজানো ছেলেরা দাঁড়িয়ে থাকে, বাইক চালিয়ে সকাল-বিকাল বাসার সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করে। পাড়ার লোকদের চোখে এ সব খুবই দৃষ্টিকটু এবং তারা নানারকম মুখরোচক কাহিনী বানাতে শুরু করে । কুর্চিও একদিন এক স্টাইলিস বাইকের মালিকের কাছ থেকে স্কুল শেষে পাওয়া ফুল, কার্ড ও চিঠি নিয়ে বাড়ি এল। তারপর নিজের রুমের বিছানায় সেই চিঠি খুললো পড়ার জন্য। মেয়েকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখা জননী তখনই রুমে ঢুকে সব কিছু ছোঁমেরে নিয়ে নিল এবং বাবাকে দেখাল। দশম শ্রেণীতে থাকাবস্থায় তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। জহির সাহেব মেয়ের জন্য স্কুলের ইংলিশ, ম্যাথ আর বিজ্ঞানের স্যারদের বাসায় এনে পড়ানোর ব্যাবস্থা করেন। এস. এস.সিতে প্রথম বিভাগ পাওয়ার পর কুর্চি’কে তার বাড়ি থেকে অনেক দূরের এক শহরে বোর্ডিং কলেজে তার বাবা ভর্তি করে দেয়।
হোস্টেল জীবনের শেষ দিকে তার পরিচয় হয় শুভর সাথে। কুর্চিদের কলেজের ফাংশনে শুভ ব্যান্ড গান গেয়েছিল। তখন সে দেখতে পেল সব মেয়ে সুদর্শন শুভকে নিয়ে কানাঘুষা করছে। মাসখানেক পর কুর্চির বাবা যখন হোস্টেল তাকে দেখতে আসে, কাকতলীয়ভাবে তাকে শুভদের বাসায় নিয়ে যায়। কারণ শুভর বাবা তার পূর্ব পরিচিত। শুভকে যে সে ভালবেসেছে তা নয়, শুধু ঝোঁকের বশেই শুভর সাথে তার আলাপচারিতা হয়। শুভ হয়তো ব্যাপারটা বুঝেছিল। তাই প্রথম থেকে সে চেষ্টা করেছে সব রকম ডকুমেন্ট যোগাড় করে কুর্চিকে আটকে রাখতে।। কুর্চি মনে মনে ধারণা পোষণ করেছিল বিয়ে না হওয়া অবধি সে কাউকে ৫০% বেশি ভালবাসবে না। কারণ শেষ পর্যন্ত তাকে যেন বিরহ ব্যথায় ভুগতে না হয়। শুভ ব্যাপারটা জানত। তাই কুর্চির হোস্টেল ছেড়ে চলে আসার পর তার চিন্তা বেড়ে গেল। বাড়ি আসার পর, কুর্চিকে লেখা শুভর চিঠি বাবা-মা’য়ের হাতে পড়ে। যদিও তারা শুভ’কে চিনত, কিন্তু বানান ভুলের চিঠি দেখে বাবা অগ্নিশর্মা। কুর্চির সকল আত্মীয়-স্বজনের নিকট ধর্র্না দিয়ে শুভ অনেক কান্নাকাটি করেছে। এমন সু-দর্শন, ভালো ফ্যামিলির ছেলেকে সবার পছন্দ শুধু জহির সাহেব ছাড়া। শুভ’র বাড়ি অন্য জেলায় হওয়ায়, তার সাথে কুর্চিও দেখা-সাক্ষাৎ খুব কম হয়েছে । যে ক’বার দেখা হয়েছে, কুর্চি সে দিনগুলোত তার ডায়েরীতে লিখে রেখেছে। শুভর বড় ধরনের ভয় সে হয়তো কুর্চিকে পাবেনা। তাই সে চালাকি করে, দশ টাকা মূল্যের নোটারী কাগজে কুর্চির সই নিয়ে বিয়ের কাগজ বানিয়ে কুর্চির বাসায় পাঠায়। কুর্চির বয়স আঠারো না হওয়ায় তার বাবা একশ টাকা মূল্যের নোটারী কাগজে সে সই বাতিল করে দেয়। তবুও সে ভুল বাংলা লেখা সুদর্শন, বনেদী ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবে না। বাসায় রান্না বন্ধ হয়ে যায়, কুর্চির বই-খাতা বাবা বেঁধে ফেলে। কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দেয়, টিভি বন্ধ, মা-ছোট ভাই -বোনরা মলিন মুখে থাকে .. পুরো পরিবারে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। যা সহ্য করা সত্যিই অসম্ভব হয়ে পড়ে কুর্চির জন্য। বিশেষতঃ সামনে তার অনার্স ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল। অগত্যা বাপের কথাতেই তাকে রাজি হতে হয় এবং শুভর সাথে সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে মুখের কথায় জহির সাহেব বিশ্বাস করেন না। মেয়েকে কোরআন শরীফ ছুঁইয়ে পাকাপোক্ত ওয়াদা করান। বাবার প্রবল জেদের মুখে কুর্চি সব কিছু বিসর্জন দেয়।
সন্ধ্যায় যখন বর পক্ষের লোকজন এলো। এ সময় পাঞ্জাবীপরা এক সুদর্শন ব্যক্তি কুর্চির দিকে তাকাতে তাকাতে ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। বিষয়টি কুর্চির দৃষ্টি এড়াল না। কুর্চির ভাবতে লাগলো লোকটি কে? বরের এক ভাগ্নিকে জিজ্ঞেস করাতে বললো, এই মামার সাথেই তো তোমার বিয়ে হচ্ছে। অথচ আগের দিনই তার সাথে দেখা হয়েছে। পাঞ্জাবী পরাতে তার চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। কুর্চি মনে মনে খুশী হয়। এদিকে একদল মাস্তান বরপক্ষের লোকজনকে ডেকে নিয়ে অস্ত্র দেখিয়ে বলল, এই মেয়েকে বিয়ে করা যাবেনা। বরপক্ষও খুব নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত খুব সাদামাটাভাবে কুর্চির বিয়ে হলো। কুর্চিও সব সময় এধরনের বিয়েতে পক্ষপাতী ছিল। কারণ বউ সাজা’টা তার কাছে খুব লজ্জাকর বিষয়। অথচ অন্য মেয়েরা চায়, বউ সেজে, অনেক জাকজমক করে বিয়ে করতে। কবুল বলার সময় শুভর কথা কুর্চির মনে পড়লো। সে বেচারা জানেওনা যে আজ কুর্চির বিয়ে। সে তার বাবাকে রাজি করিয়ে কুর্চিদের বাসায় আনার চেষ্টায় ব্যস্ত। শুভ বাবাসহ বড় অবিবাহিত দু- ভাইকে কুর্চিদের বাসায় পাঠাতে শেষমেশ সমর্থ হয়েছিল কুর্চির বিয়ের একমাস পর। এদিকে বুকে পাথর চাপা দিয়ে বহু কষ্টে কুর্চি অপরিচিত ব্যক্তিকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিল। এক্ষেত্রে ছোট পরিবারের একান্ত নিজস্ব ভুবনে গাছ-ফুল, গল্প -কবিতায় বড় হয়ে ওঠা সাদাসিধে কুর্চিকে সেই সন্ধ্যায় অনেক জটিলতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হল।
রাতে বর কুর্চিদের বাড়িতেই থেকে গেল। কুর্চির প্রধান খাদ্য মিষ্টি। ক্ষিদে লাগলেই সে মিষ্টি খায়। রাতে কুর্চির ক্ষিদে পেলে সে ফ্রিজ খুলে দেখে মিষ্টি নাই। আর তাই দেখে নববিবাহিতা কুর্চির সেকি কান্না। সেটা বর দেখে ফেলল। বরবেচারা অনেক রাতে বাইরে গিয়ে মিষ্টি কিনে আনল।
বিয়ের দু যুগ অতিবাহিত হওয়ার পরও কুর্চির বর তার জন্য সবসময় ফ্রিজে মিষ্টি রাখার দায়িত্বটা সুন্দরভাবে পালন করে যাচ্ছে। শুধুমাত্র পারিপার্শ্বিক চরিত্রগুলোর কারণে জীবন অনেক অশান্তিময় হয়েছে, কিন্তু কুর্চি আর তার বরের পারস্পরিক টান এবং ভালবাসা আজও তাজা গোলাপের মতো সতেজ, একটুও সুভাস কমেনি তাতে।
-নিউইয়র্ক।