আধুনিকতার অন্ধকার কাকে বলি

মাহমুদ রেজা চৌধুরী

প্রস্তাবনা : অন্ধকার না থাকলে আলোর প্রয়োজন বা গুরুত্বকে বোঝা যায় না। সব যুগ বা কালই তার নিজ নিজ সময়ে আধুনিক। অন্ধকারকে ভেদ করেই কাল অতিক্রম করে যাবার চেষ্টা করে এবং ভাবে। চলতি আধুনিক সময় এবং কালেও আমরা সেটা করছি বা করতে চেষ্টা করি। বর্তমান কালকে অনেকে উত্তরাধুনিক কাল বলেও মনে করি। তবু এই উত্তর-আধুনিক সময়ে যে অন্ধকার আমাদের ভাবায়, এর অন্যতম একটি সত্যকে নিয়ে বিভ্রাট, সত্যকে উপেক্ষা। সত্যের আলোর মুখোমুখি না হওয়া এবং এর কিরণ গায়ে না মাখা।
ব্যাখ্যাঃ জেনেশুনে এবং বুঝে কি সম্ভব একজন অসৎ ব্যক্তিকে যুগ, সময় বা তার বাস্তবতার যুক্তিতে প্রতিষ্ঠা এবং শ্রদ্ধা করা। এটা কি সম্ভব প্রগতিশীল চিন্তার ধারক হয়ে বা দাবি করে কোন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বা বিশ্বাসী হয়েও অথবা না হলেও অন্যায়ের বিপরীতে আরেকটি অন্যায়কে ন্যায় হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। এই সাধারণ জীবনে একজন অতি সাধারণ মানুষ হয়েও এসব জটিল প্রশ্নের উত্তর খোঁজে মন। অনেকে মনে করি আদর্শ, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, স্বচ্ছতা- এসব কথা বা ভাবনাগুলি শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু বাস্তবতা না। এই দলের আমরা ভাবি বাস্তবতা হচ্ছে- ‘জোর যার মুল্লুক তার।’
মিথ্যা, ভ-ামি এবং অসৎ হয়ে অপনি যতো পার পেয়ে যাবেন- এখনকার সময়ে আপনিই ততো বড় নেতা/নেত্রী। নেতা/নেত্রী হবার এখন অন্যতম একটা যোগ্যতা হলোÑ ইতিহাসকে বিকৃতি করা, মিথ্যা কথা বলা, অন্যকে অশ্রদ্ধা করা। সম্প্রতি যোগ হয়েছে, মিথ্যাকে ‘অল্টারনেটিভ ট্রুথ’ বলে দাবি করা। চারপাশে এসবই দেখছি এখন, ঘরে বাইরে সর্বত্র। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা- এটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। দিনের শেষে সত্য যা, তা সত্যই থেকে যায়। মিথ্যা কখনোও সত্য হয় না।
এক বৌদ্ধ প-িত বলেছেন-When I did not know the truth, river was a river, mountain was a mountain. When I was searching for the truth, river was not a river any longer, mountain was not a mountain any longer. When I found the truth river was a river again, mountain was a mountain again.
এটাও সত্য যে, এ যুগে সব কিছুতেই দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ করি। তাই সত্য কী, এই বিষয়েও দৃষ্টিভঙ্গী বদলে গেলেও সত্যের বিপরীত অলটারনেটিভ সত্য না। দুঃখজনক, সেটাই সত্য বলে প্রচারিত হয়। টেলিভিশনে উপস্থাপিকা বলেন বা বলতে চান- নির্বাচন স্বচ্ছ না হলে প্রতিপক্ষের ও বা সে জিতলেন কিভাবে। একদল মানুষ মনে করেন যে, তারা হচ্ছেন সময়ের সবচে চৌকস এবং সত্যের প্রতিনিধি। বাকিরা সব কটা গর্ধভ। যা বলবো, তাই শুনবে।
ক্ষমতা এখন নেতা/নেত্রী এবং তাঁদের চোখকানা সমর্থকদেরও মিথ্যুক বানাচ্ছে। ক্ষমতার প্রতি অন্ধ মোহ নেতা/নেত্রীকে মিথ্যুক তৈরি করে। বর্তমান বিশ্বে এর একেবারে প্রতিদিনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট মি. ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতার প্রতি তাঁর অন্ধ আবেগ, জেদ এবং মোহই তাকে এক প্যাথলজিক্যাল লায়ারও বানিয়েছে। সকাল/বিকাল এই ভদ্রলোক মিথ্যা কথা বলেন। এখনকার সময়ে বিশ্বের আরো অনেক সমাজ এবং রাষ্ট্রেও মিথ্যাবাদী ও কর্তৃত্ব প্রধানরা আছেন। অনেকে তাঁদের নেতা/নেত্রী বলে মনে করেন। নেতা বা নেত্রী একটি ইতিবাচক চারিত্রিক বৈশিষ্ট। ক্ষমতার জোর গলা বা কালি ও কলমের জোর কিংবা, অল্টারনেটিভ সত্যের জোর বা অপপ্রচারের জোর অথবা সময়ের তর্ক দিয়ে ইতিহাসে মাস্তান হওয়া যায়। নেতা/নেত্রী না।
দল এবং ক্ষমতাকে বাঁচাতে বা রক্ষা করতে গিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে সততাকে যদি গলা টিপে হত্যা করি, সেটা কোন অর্থেই ‘নেতা বা নেত্রী’ এই নামের ইতিবাচকতাকে ধারণ করে না। সুবিধাবাদী বা জেনে-বুঝে কোপ দেয়া। চারিত্রিক দুর্বলতার কৌশল, সততা না।
এই রকম বুদ্ধিজীবীদেরও সংখ্যা ক্রমান্বয়েই কোন কোন সমাজে বাড়ছে। এরা সত্য থেকে দূরে কিন্তু অসত্যের ভক্ত। বিষয়টা আধুনিকতার এক রকম অন্ধকারও বলা যায়। মানুষ আর সত্য নিয়ে বা সততা নিয়ে মাথা ঘামায় না। বেশির ভাগ আমরা সাধারণ মানুষ ভালবাসি মিথ্যা এবং বস্তুকেন্দ্রিক হতে। নগদ যা আসে ওটাই লাভ, ওটাই সত্য। একটির পর একটি পরিবর্তনের ধারা ধরে মানুষ এক প্রত্যাবর্তনহীন পথেও হাঁটছে। এই হাঁটা বা চলাই অধিক বাস্তব বলে মাথা এবং হৃদয়ে গেঁথেও যাচ্ছে। এই হাঁটার একটা নিকট লক্ষ আছেÑ ক্ষমতার মোহ, অর্থের লোভ, প্রচারের প্রতি দুর্বলতা। কিন্তু লক্ষ না শান্তি অর্জনের। সুখটা যেন সেই পাওয়া যা কিছু দেখবো, ধরবো, ছুঁবো, ভোগ করবো। সুখের জন্য অন্য আরেকজনের ত্যাগকে চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করি না। এসব কারণে আধুনিকতাতেও মানুষ হত্যা, গুম, এবং হিংসা-প্রতিহিংসায় সংঘর্ষ বড় হচ্ছে। বাড়ছে। সত্য সংঘর্ষের হয় না। যত মিথ্যা বড় হয় ততোই সংঘর্ষ বাড়ে সমাজে, ঘরে এবং পরিবারে।
সমাজ দার্শনিকদের মধ্যে অনেকে মনে করেন, মধ্যযুগে মানুষের অধিক বিশ্বাস ছিলো সৃষ্টিকর্তার উপরে। তখন মানুষের আচার-আচরণও ছিল শক্ত নিয়ম দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। বর্তমান যুগে সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ করাটাই প্রগতিশীলতা এবং আধুনিকতা।
উল্লেখ্য যে, এক সময়ে রাজার একটা অহং ছিল যে সে হলো সৃষ্টিকর্তার সরাসরি উত্তরাধিকারী! অতএব তিনি যা বলবেন সেটাই ঈশ্বর বা খোদার বাণী! বর্তমান যুগে এই জায়গাটা নিয়েছে জনতা। আজকের নেতা/নেত্রী জনতার প্রতিনিধি। সেই প্রাচীন যুগে ইউরোপেও ‘অবিশ্বাসীদের’ শাস্তি হতো এই বলে যে- সে শয়তানের প্রভাবাধীন। এই যুগে এসে দেখছি এবং জানছিও এখন বিপরীত মতাবলম্বীদের বিপক্ষে অভিযোগ- এরা জনতার শত্রু। অর্থাৎ এখন জনতা এবং জনগণের নেতা ঈশ্বরের মতই অভ্রান্ত, প্রান্তিক সত্যের অধিকারী। এই অসত্য এবং মুর্খতা থেকে আধুনিকতার মুক্তি না হলে বিকৃত এবং অপ্রতিরোধ্য মিথ্যা সমাজে বিকশিত হবে।
বাংলাদেশ সৃষ্টি হবার পর থেকেই আমরা এর অনেক নেতাকে হত্যা করেছি। কোথাও কোথাও অত্যন্ত নির্মম বা নিষ্ঠুরভাবেও হত্যা করেছি। সত্যের স্বার্থে নয়। বৈষম্য, শ্রেণিস্বার্থ, রাজনৈতিক ক্ষুদ্র বা দলীয় স্বার্থ এবং ক্ষমতার কারণে। হত্যার পরে প্রায় প্রতিটা হত্যা, খুন এবং অবিচারকে ন্যায় বলে এক একজন নিজ নিজ ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি, তাতে মিথ্যার অংশই বড়।
মিথ্যার ঝুড়ি এবং নানা ‘মিথ’কেও অবলম্বন করে সাধারণ মানুষকে বিগত প্রায় পাঁচ দশক সত্যের বিপক্ষে নিয়ে দাঁড় করিয়েছি। অর্থনৈতিকভাবে আমরা তলাহীন ঝুড়ি নই, কিন্তু তলাহীন মিথ্যার মোহে এবং অনৈতিকতায়।
এই তলাবিহীন মিথ্যা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। কিন্তু এই পথে অন্তরায় আমাদের অসহিষ্ণুতা এবং অনীহা দুটোই। কোথাও দল বা সমাজের কোন গোষ্ঠী নিজেদেরকে সত্যের একমাত্র অধিকারী মনে করি। কোথাও কেউ আমরা ভিন্ন অথবা বিপক্ষের মতকেও সত্য মনে করি। কিন্তু সেই সত্য নিয়ে বিচার এবং বিবেককে চালনায় অনীহার রোগেও আক্রান্ত।
লক্ষ করেছি আমাদের মধ্যে পরিবর্তনের কোন আগ্রহ নেই। পরিবর্তনের যারা কর্ণধার, সমাজের সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেশির ভাগই মনে করেন- পরিবর্তনের কি দরকার, আমরা তো ভালই আছি! যারা পরিবর্তন চাই, সত্য চাই, তারা সব অর্থেই দুর্বল এবং বিভক্ত। ভুল/মিথ্যা এবং অযোগ্য নেতৃত্বের লড়াইয়ে সত্য মুখ থুবড়ে আছে।
জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী মনে করেন- জাতীয়তাবাদ যে কোন ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী এবং শ্রেণি দ্বন্দ্বের উপরে। এই জাতীয়বাদীরা ক্ষমতায় গেলে মনে করেন, জাতীয়তাবাদী নীতি-আদর্শবোধ বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জরুরি, এরপর কোন প্রয়োজন নেই। তখন সমজাতীয় বিভিন্ন ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে দলীয় স্বার্থে বিভক্ত রেখে সমাজে বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেয়া হয়। মিথ্যাকে সত্য বানানো হয়।
ধর্ম, বর্ণ এবং আর্থিক শ্রেণি বিভাজনের পুরনো মতগুলো এখনও চলমান। ক্ষমতার লড়াই দুর্মর। এই দ্বন্দ্ব আধুনিককাল এবং সমাজেও অব্যাহত। একেই বলে আধুনিকতার আলোয় অন্ধকার। এর চটজলদি উত্তরণ কঠিন। তবে অসততা, অন্যায়, লোভ, হিংসা-প্রতিহিংসা, অবিচারকে রোধ করে সুশাসনকে কিছুটা অগ্রাধিকার দিতে পারলে আগামী সমাজ অবয়বে পরিবর্তন আসবে। সত্য এবং ন্যায়পরায়ণতার বিকল্প রূপ নেই। সত্যের স্বরূপ একটাই, তা হলো- অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। এখানে সব মানুষের অধিকার সমান।
২০২০ সালের আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের সিনেটর মিস ক্যামেলা হ্যারিস (কধসধষধ ঐধৎৎরং)। তাঁর একটি সাম্প্রতিক কথা উল্লেখযোগ্য বলে মনে করি। গত ২৭ জানুয়ারি ২০১৯, এক বক্তৃতাতে ক্যামেলা বলেন, We are at an inflection point in the history of our Nation and World, we must speak truth and fight for the truth.
বর্তমান বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কথাটি সত্য। সমাজ থেকে সত্য যত দূরে সরে যাবে, সমাজ তখন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং এসবের প্রয়োগে উজ্জ্বল হলেও মানবাধিকারের চর্চা, নৈতিকতা এবং সত্য থেকে দূরে সরে আধুনিকতার চ্যালেঞ্জ আলোর পথ দীর্ঘ করার বিপরীতে এর সরু পথে অন্ধকারকে গভীর এবং দীর্ঘ করতে পারে। একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ সম্মুখে চলতে গিয়ে যেন আধুনিকতার অন্ধকারে না হাঁটে।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক।
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯।
ই-মেইল: [email protected]