জয়া ফারহানা
প্রবাদ ছিল মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে। একদা এই বাংলা মুল্লুকে মাঘ মাসে এত শীত পড়ত যে কঠিন সেই মাঘের শীতে টিকতে না পেরে বন জঙ্গল থেকে শীতকাতর বাঘ ছুটে আসত লোকালয়ে। লোকালয়ের লোকজন বাঘকে তখন মাঘে কাঁপতে দেখেছে (চোখের সামনে বাঘকে কাঁপতে না দেখলে নিশ্চয়ই এ প্রবাদ তৈরি হয়নি)। মাঘের শীতে বাঘকে কাঁপতে দেখা এখন বিরল। বিরলও নয় ঠিক, রীতিমতো বিলুপ্ত কোনো দৃশ্য। সময়ান্তরে শীত তার চরিত্র বদল করেছে। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে কয়েক বছর ধরে আমরা মাঘে শীতই পড়তে দেখিনি। এ বছর নাকি লা নিনার প্রভাবে শীত জেঁকে বসেছে এবং সেটা মাঘের আগেই। লা নিনার প্রভাবেই হোক আর অন্য যেকোনো কারণে হোক শীতের দেখা মিলেছে। কিন্তু বাঘের দেখা পাওয়া মুশকিল। লোকালয় থাক, বনে গিয়েও বাঘের কাঁপতে দেখা পাওয়া মুশকিল। অতএব তারা কাঁপছে কি না সে তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে মানুষ কাঁপছে। তার যতটা না শীতে তার চেয়ে ভয়ে। ৫ জানুয়ারির আগে পরের ঘটনাপ্রবাহ এবং তার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ভয়। কপাল দোষে বাংলাদেশের জনগণের ঘাড়ে ৫ জানুয়ারির এই ভয় যুক্ত হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ৫ জানুয়ারি পরিণত হয়েছে একটি আতঙ্কের তারিখে। প্রত্যেক বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের আগে পরে জনগণ আতঙ্কে কাঁপতে থাকে, না জানি আবার কোনো দুর্ভোগ দুর্দশায় পড়তে হয়। আবার কার ছোড়া আগুনে পুড়ে মরতে হয়। আগুন, তা সে বিহঙ্গ পরিবহনেরই হোক আর জামায়াতের পরিবহনের হোক, পুড়ে মরতে হবে তো জনগণকে। ত্রিশ থেকে নব্বই শতাংশ আগুনে ঝলসে জনগণ যখন বার্ন ইউনিটে মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করবে, প্রধান দুই দলের নেতারা তখন জমজমাট শীতের কাপড় পরে ধূমায়িত কফির মগের সামনে পরস্পরকে দোষারোপ করে পার পেয়ে যাবেন। ধরে নিচ্ছি, জনগণ নিজেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিজেই নিজেকে গুম করে। নিজেই নিজেকে ক্রসফায়ার করে। এই দেশে যা কিছু মন্দ তা সব জনগণই ঘটায়। এই হলো বাংলার সেই নিরীহ জনগণ যাদের সব ভাবে শোষণ করা যায়। ৫ জানুয়ারিও শোষণের একটি দিনে পরিণত হয়েছে। এই তারিখের আগে পরে তারা চিন্তিত থাকে না জানি সংশয় সঙ্কুল বিপদাপন্ন জীবনে আবার কোন নতুন শঙ্কা যুক্ত হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ডিসকোর্সে সবচেয়ে আলোচিত তারিখ ছিল ৭ নভেম্বর। ৭ নভেম্বরের ওপর বিস্তর গ্রন্থ লেখা হয়েছে। তবে তার একটির সঙ্গে আরেকটির বয়ান এত মৌলিকভাব সাংঘর্ষিক যে পাঠকদের ধন্ধে পড়ে যেতে হয়। এত ভিন্ন ভিন্ন বয়ান ৭ নভেম্বর নিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যারা ৭ নভেম্বরকে রাজনৈতিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন বয়স নিয়ে চাক্ষুস দেখেননি, তাদের পক্ষে কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয় ঠিক কী ঘটেছিল ৭ নভেম্বরে। অনেক কিছুই ঘটেছে। কিন্তু এ বিষয়ে শ’খানেক বই পড়লেও মনে হয় কোথাও কোনো ফাঁক থেকে গেল। কোনো বই থেকে যদি বা ঘটনা জানা গেল তো ৭ নভেম্বরের শানেনজুল জানা গেল না। কোনো বই সিপাহি জনতা ভাই ভাইয়ের উত্থান লিখল তো কোনো বই লিখল সিপাহি-জনতা ভাই ভাই কনসেপ্ট স্টুপিডিটি ছাড়া কিছু নয়। ওই লেখকের মতো আবার সিপাহি-জনতা ভাই ভাই তো দূর, সিপাহি-সিপাহি ভাই হওয়ার চিন্তা ইডিওসি।
৭ নভেম্বরের মতো খ্যাতিতে ওজনদার না হলেও ৫ জানুয়ারিও দিন দিন খ্যাতিমান হয়ে উঠছে। ৫ জানুয়ারি সম্পর্কে গত কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগের মূল্যায়ন ছিল এটি গণতন্ত্র রক্ষা দিবস। তাদের ভাষায় এদিন শুধু গণতন্ত্রই রক্ষা পায়নি, রক্ষা করা গেছে সংবিধানকেও। এ বছর আওয়ামী লীগের ভার্সন বদলেছে। এ বছর ৫ জানুয়ারিকে তারা বিএনপির আত্মহত্যা দিবস এবং বিলুপ্ত বন্য প্রাণীর মতো বিএনপির বিলুপ্তি দিবস হিসেবেও ঘোষণা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ভাষায় ৪০ শতাংশ প্রদত্ত ভোটে তারা নির্বাচিত হয়েছে। ৫ জানুয়ারি ৪০ শতাংশ ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে তারিখটি নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের জন্য আনন্দের। ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতায় যত শত মানুষ পুড়ে মরেছে, যারা আহত হয়েছে তাদের জন্য দিনটি বেদনার। এরশাদ সাহেবের জন্য দিনটি মিলনের। গলফ ক্লাবে ক্রীড়ারত এরশাদ সাহেবকে দেখে পুলিশ বাহিনীর মনে হয়েছিল, খেলাধুলার জন্য তখনও তিনি যথেষ্ট সুস্থ নন। আরো ভালো খেলার জন্য আরো সুস্থতার দরকারÑ এই বিবেচনায় জনগণের বন্ধু পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এস্কর্ট করে সিএমএইচ এ নিয়ে যায় এরশাদকে। গলফ ক্লাবে গলফ খেলার আগে পর্যন্ত সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি নির্বাচন করছেন না। কিন্তু ততক্ষণে রওশন এরশাদ নির্বাচনে অংশ নেয়ায় মত দিয়েছেন।
আফিমের ঘোরে কমলাকান্ত কুকুর বেড়ালের সঙ্গে কথা বলতেন। সিএমএইচ এ এরশাদ সাহেব কিসের ঘোরে কার সঙ্গে কথা বলেছিলেন আমরা জানি না। যে আসন থেকে তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছিলেন ৫ জানুয়ারির পর দেখা গেল তিনি সেই আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। স্ত্রীর মতে মত দিয়ে বিশ্বের নির্বাচনের ইতিহাসে তিনি রেকর্ড তৈরি করলেন। ৫ জানুয়ারি আবার আওয়ামী লীগ এবং স্ত্রীর সঙ্গে নতুন করে মিলন রচিত হলো। অতএব জাতীয় পার্টির কাছে ৫ জানুয়ারি মিলনের দিন। জাতীয় পার্টির যে অংশটির নির্বাচনে মোটেই মত ছিল না তাদের জন্য এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যারা নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছিল কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ায় অংশ নিতে পারেনি তাদের জন্য এটি বিরহের দিন। এবং এরা সবাই মিলে ৫ জানুয়ারিকে একটি সংকটের দিনে পরিণত করেছেন। জনগণের জন্য এটি একটি সংকটের দিনই বটে। এই সংকট আরো কত দিন জনগণের ঘাড়ে সিন্দবাদের ভূতের মতো চেপে থাকবে জনগণ তা জানে না।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যখন বলা হয় ৫ জানুয়ারি জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেট নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর জনগণ দলে দলে কাতারে কাতারে বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল ঘর থেকে তখন জনগণকে বিস্ময় মানতেই হয়। জনগণ কি আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেট পাওয়ার কারণে উল্লাসে দিশেহারা হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল নাকি তিন মাসের বন্দিদশার পর পেটের তাগিদে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল? আবার বিএনপির পক্ষ থেকে যখন বলা হয় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সারাদেশে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল তখনও বিস্ময় মানতে হয়। কী কারণে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে আসবে? জনগণের ভালোর জন্য কোন আন্দোলন তারা করেছিলেন যে শোকে বিহ্বল হয়ে জনগণ তাদের কাজকর্ম থেকে অব্যাহতি নিয়ে কবরের নীরবতা রচনা করবে? জনগণ বরং দেখেছে বিএনপি এমন এক অকার্যকর নিষ্ক্রিয় নির্লিপ্ত দল এমন এক ব্যর্থ অপদার্থের দল এমন এক ধূসর নির্বিকার দল যাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ১৫৪টি মতান্তরে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে এবং ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন করার পরও সেই নির্বাচনকে জায়েজ করে নিতে পারে। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চাহিদা পূরণ না করে যারা সদম্ভে চার বছর এবং লাগাতার নয় বছর রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে শুরু করে এ্যাপার্টমেন্ট মালিক সমিতির মত তুচ্ছ প্রতিষ্ঠানেও একক আধিপত্যের শাসন চালিয়ে যেতে পারে। সম্ভবত ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপি নেতারা এত অবৈধ এত অনৈতিক এত অগ্রহণযোগ্য অকায়দায় সম্পদের মালিক হয়েছেন যে গত আট বছর ধরে ক্ষমতায় না থেকেও ক্ষমতায় থাকার মতো বিলাসী জীবনযাপন করতে পারছেন। কোর্টের বারান্দায় সকাল-সন্ধ্যা হাজিরা দেয়া ছাড়া আর কোনো ভোগান্তি তারা অনুভব করেন বলে মনে হয় না। সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। নির্বাচনও কারো জন্য অপেক্ষা করবে না।
নির্বাচনী ট্রেন বিএনপির স্টেশনে থামবে নাÑ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এহেন বিবৃতির পরও বিএনপির পক্ষ থেকে কোন যুক্তিযুক্ত প্রতিবিবৃতি আসে না। আওয়ামী লীগ যখন বলে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দলীয় সরকারের অধীনেই হবে, না তারা অবশ্য বলে নির্বাচন কমিশনের অধীনেই হবে। বর্তমান সংসদ বহাল রেখে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তাতে বিএনপি অংশ নেবে কি নেবে না তাতে কিছুই যায় আসে না, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার দায় আওয়ামী লীগের নয়, তখন বিএনপির কী প্রতিক্রিয়া হয় জানি না, কিন্তু এটা শুনে আমরা জনগণ আতঙ্কিত হই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একবার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে যাচ্ছে। আবার ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে? গণতন্ত্রের জন্য, সংবিধানের জন্য, জনগণের জন্য এমন অপরিহার্য নির্বাচন আরো একবার হবে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই অপরিহার্য নির্বাচনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাবে? এভাবেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা অথবা পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন চলতে থাকবে?
বিএনপি নেতারা বলেন বটে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পাঁচ পারসেন্ট ভোট পড়েনি। কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। নবম সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই মন্ত্রিপরিষদ শপথগ্রহণ করেছে। নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। তাদের মেরুদ- নেই। প্রশ্ন হলো, আপনারা তবে এই নির্বাচন মেনে নিলেন কেন? কেন ভাবলেন আওয়ামী লীগ মত বদলাবে? কেন অপেক্ষায় ছিলেন সংবিধান রক্ষার এই নামকাওয়াস্তের নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগ আরেকটি নির্বাচন দেবে? জগতে অনেক ব্যর্থ সরকারের দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু এত বড় ব্যর্থ বিরোধী দলের দৃষ্টান্ত আছে বলে জানা নেই। যারা নাকি নিজেদের এবং নিজেদের ভোটারদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিপক্ষ দলের সুমতির ওপর নির্ভর করে থাকে। জনগণ যে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং সেই ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তারা কিছুই করতে পারেনি। আমরা সেই দুর্ভাগা জনগণ যারা ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হই এবং এ নিয়ে পরস্পরের দোষারোপের রাজনীতি সহ্য করতে হয়। জনগণের আরো দুর্ভাগ্য যারা এ নিয়ে কথা বলবেন তারা প্রত্যেকে যার পর নাই দল অনুগত। অন্ধ আনুগত্যের তোড়ে তারা এমন কথা বলে বসেন যা তাদের নিজেদের জন্য অবমাননাকর। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এর যে কোনো একটি দলকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন যে ইনক্লুসিভ হতে পারে না এই সত্য কথাটি বলার জন্য এখন আলো জ্বালিয়ে লোক খুঁজতে হয়।
লেখক : কলাম লেখক