আনপেইড ওয়ার্ক

রিমি রুম্মান :

‘আজ আমার ছুটির দিন। আজ কোনও কাজের কথা বইলো না তো!’ কাঁটাচামচ দিয়ে স্ক্রেম্বল এগের টুকরো মুখে পুরছে। চিবোচ্ছে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আছে সজীবের। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে স্ত্রী তানির উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলল সে।
‘আমার ছুটির দিন কবে?’ বালিশের পুরনো কভারটি খুলে নতুন আরেকটি কভার ভরতে ভরতে জিগ্যেস করে তানি।

আরেক টুকরো এগ মুখে পুরতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে এমন একটি প্রশ্ন শুনে খাবার মাঝপথে থামিয়ে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকায় সজীব। যেনো মঙ্গল গ্রহ থেকে নতুন কোনো ভাষা পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছে, যার বিন্দুবিসর্গ অর্থ বোঝা পৃথিবীর কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়!
‘তুমি কি চাকরি করো নাকি, যে তোমার ছুটির দিন থাকবে?’ কথাটি বলেই বাকি খাবার মুখে পুরে খালি প্লেটটি সামনে ঠেলে দিয়ে আবার ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগী হয় সজীব ।
একে একে বিছানার চাদর, বালিশের কভার, স্বামী-সন্তান-শাশুড়ির কাপড় লন্ড্রি ব্যাগে ভরে বিশাল এক বোঝা কাঁধে তুলে, অন্য হাতে লিকুইড সোপের কন্টেইনার নিয়ে মোড়ের লন্ড্রোমেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় তানি। যেনো বোঝা পিঠে এক উট আরব দেশের মরুভূমির পথে হেঁটে চলেছে।
রাতের খাবার শেষে পরদিনের জন্যে সন্তানের স্কুল ইউনিফর্ম, স্বামী সজীবের কাজের পোশাক ভাঁজ করে ওয়ারড্রবের উপর রাখতে রাখতে ‘এই শোনো না, এবার জন্মদিনে উপহারস্বরূপ কত টাকা দেবে?’ বেশ আহ্লাদি স্বরে জিগ্যেস করে তানি। গরম দুধের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে যাচ্ছিল সজীব। কাপটি পিরিচে রেখে চোখেমুখে এক পৃথিবী বিস্ময় লেপ্টে তানির দিকে তাকায়। যেন সে জন্মেছে শুধু সংসারে ক্ষণে ক্ষণে বিস্মিত হতে। এ ছাড়া পৃথিবীতে আর কিচ্ছুটি করার নেই তার!

‘টাকা দিয়া কী করবা তুমি? আমার কি আরেকটা সংসার আছে নাকি? আমার যা কিছু উপার্জন সবই তো তোমাদের জন্যে।’ বলতে বলতে বিরতিহীনভাবে বেজে চলা ফোনের রিসিভার তোলে।
‘হ্যালো, ওহ্‌ তাই নাকি! আমি তো ভুলেই গেছিলাম। ভালোই হইলো মনে করায়ে দিলি। আমি ডলার পাঠাচ্ছি। তোর খুশিমতো কিছু একটা গিফট কিনে নিছ কিন্তু। হ্যাপি বার্থ ডে, আফা।’ সজীবের কণ্ঠে উৎফুল্ল ভাব।
কথাগুলো দরজার ফাঁকফোকর গলিয়ে লিভিং রুম আর হলওয়ের মাঝের জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা তানির কানে এসে আছড়ে পড়ে। সে দুই কদম এগিয়ে সোফায় বসে পড়ে। দীর্ঘশ্বাস নেয়। সামনের টি-টেবিল থেকে খবরের কাগজ তুলে নেয়। মেলে ধরে চোখের সামনে। চোখ বুলায়। বড় বড় হরফে হেডলাইন, ‘হাওয়া লেগেছে দিন বদলের পালে’।
স্কুল থেকে ফিরে ব্যাকপ্যাক টেবিলে রেখেই বাবার রুমের দিকে ছুটে যায় আয়ান। হাতে রঙিন একটি কার্ড। আজ ফ্রাই ডে। ‘মা দিবস’-এর আগে শেষ স্কুল। অন্যসব শিশুদের মতো নিজে কার্ড বানিয়েছে মা’র জন্যে।
‘বাবা, বিকেলে কিন্তু আমরা শপিং এ যাবো। মাকে সারপ্রাইজ গিফট দেবো। মা যেনো টের না পায়।’ বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কথাগুলো বলে আয়ান। সজীব বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে বলে, ‘সে-কী, শপিং করতে হবে কেনো? মাকে কার্ড দিলেই তো হয়!’

‘মা আমাদের জন্যে অনেক হার্ডওয়ার্ক করে। আমি মাকে হ্যাপি করতে চাই।’ বেশ উত্তেজনার স্বরে বলে ওঠে আয়ান।
‘আমি হার্ডওয়ার্ক করি না? আমি তো সারাদিন কাজ করি তোমাদের জন্যে।’ বলেই আয়ানের দিকে তাকায় প্রতিউত্তর শোনার অপেক্ষায়।
‘হুম, তুমি পরিশ্রম করো, বিনিময়ে মানি আর্ন করো। আম্মু তোমার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করে। বাট এ জন্যে সে কোনো পারিশ্রমিক পায় না। আনপেইড ওয়ার্ক।’
আয়ানের কথা শেষ না হতেই দুই হাতে বাজার ও শাশুড়ির ওষুধ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে তানি।
‘তুমি এইসব শিখিয়ে দিয়েছ এতটুকুন শিশুকে?’ তানির দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে সজীব। আগামাথা বুঝতে না পেরে আয়ান ও সজীবের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে একবার আয়ানের দিকে, আরেকবার সজীবের দিকে তাকায় তানি। গোপন কথা বিশ্বস্ততার সাথে গোপন রাখতে না পারায় বাবার প্রতি রাগে, ক্ষোভে কেঁদে ফেলে আয়ান।
‘টের তো পাও না সংসার ক্যামনে চলে। খালি খাও, দাও আর ঘুমাও। বাইরে কাজ করে দ্যাখো, দুনিয়াটা এত সহজ না!’ সজীবের কাছ থেকে এমন খেদোক্তি গত দশ বছরের সংসার জীবনে কম করে হলেও এক হাজারবার শুনতে হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে বিয়ের পরপরই আমেরিকায় চলে আসে তানি। কিছুদিন ভালো একটি চাকরি করেছিল। আয়ানের জন্মের পর মেটারনিটি লিভ শেষে আর কাজে ফিরতে পারেনি। দেশ থেকে আসা শাশুড়ি আর সন্তানের যত্নআত্তির বিষয়টি সামনে চলে আসে। শাশুড়ি ও স্বামী তানির চাকরি করার ঘোর বিরোধী। ফলত অনেকগুলো বছর সে আর নতুন কোনও চাকরিতে যোগ দেয়নি। এখন আয়ান খানিকটা বড় হয়েছে। ওকে স্কুলে দিয়ে কাছেই একটি এলিমেন্টারি স্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি নিয়েছে তানি। অন্তত নিজের প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ্য তো হলো। কিন্তু সমস্যা হলো অন্যখানে। সজীবকে বিছানা ছেড়ে ডায়নিং টেবিলে এসে ঢেকে রাখা খাবার মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেতে হয়। কফিটাও নিজেই বানিয়ে নিতে হয়। বিধায় তানিকে কাজ ছেড়ে দিতে চাপ সৃষ্টি করে। তানি গা করে না। রা করে না।

উপায়ান্তর না পেয়ে সজীব দেশে ফোন করে শাশুড়িকে বিষয়টি অবহিত করে। অভিযোগ জানায়, ‘আম্মা আপনার মেয়ে আগে ভালো ছিল। কথা শুনতো। টু শব্দটি করতো না। ইদানিং কোনো কথা মাটিতে পড়তে দেয় না। উল্টা তর্ক করে।’

সাবিনা বেগম জামাতার অভিযোগে চিন্তিত হয় না। ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে বরাবরের মতো কোমল স্বরে বলে, ‘বাবা, বিয়ের পর থেকে তানির যে ব্যবহার, আচরণ দেখেছ, সেইসব বাবার বাড়ি থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা। এতদিন তোমার সংসারে থেকেছে। এখন তার যে আচরণ দেখছো, এইগুলা তোমার সংসারে গিয়ে শেখা।’
আগুনের লেলিহান শিখা থেমে যাবার পর দেয়ালে দেয়ালে ধোঁয়ার কালো পরতের মতোন কথাগুলো লেপ্টে থাকে সজীবের শরীরে।

ম্যাগনোলিয়া, চেরি, ওক, ম্যাপল গাছ পেরিয়ে হেঁটে যায় তানি। চারিদিকে বসন্তের পাখিরা ডেকে ওঠে। সে ঘাড় তুলে প্রকাণ্ড সব বৃক্ষের ডালের দিকে তাকায়। দুই হাত বুকের উপর আড়াআড়িভাবে ভাঁজ করে বিচিত্র এক অনুভূতিতে হেঁটে চলে ধীরে। যেনো ও পথে হেঁটে চলে সন্ধ্যার মেঘমালা। চলতি পথে পাশের জলাশয়ের ছোট ছোট ঢেউ হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। অপার্থিব এক দীপ্তি বয়ে যায়। সে অস্তমিত সূর্যকে ভালোবাসতে শুরু করে, পরদিন প্রত্যুষে আবার উদিত হবে বলে। খসে পড়া হেমন্তের পাতাকে ভালোবাসতে শুরু করে, আগামী বসন্তে আবার নতুন করে জন্ম নেবে বলে। এতকালের অশ্রুজলে বিবর্ণ হয়ে থাকা হৃদয় মুক্তির আনন্দে বিড়বিড় করে বলে চলে, ‘কোনো কিছুই শেষ নয়, নতুন করে শুরু করা গেলে।’

আটই মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। জগৎসংসারের সব নারীকে অভিবাদন।