আপডেটেড কোভিড বুস্টার নেয়া জরুরি

এম.এস.হক : এবারের শীত মৌসুমে করোনা সংশ্লিষ্ট জটিলতায় মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে কিংবা হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি কমাতে শারীরিক সমস্যাগ্রস্ত এবং বয়ঃবৃদ্ধ আমেরিকানদের আপডেটেড কোভিড বুস্টার (নিউ বাইভ্যালেন্ট কোভিড বুস্টার) নেয়ার জোর তাগিদ দিয়েছে সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে সংস্থার ভ্যাক্সিন এফেকটিভনেস টাস্ক ফোর্স প্রোগ্রামের পরিচালক ড. রুথ লিঙ্ক-গেলেস এই জরুরি তাগিদ দিয়েছেন। সিডিসির গবেষকগণ দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণে দেখতে পান যে পেন্ডামিকের শুরু থেকে ৬৫ বা তদুর্ধ বয়সী যে সকল আমেরিকান কমপক্ষে ২টি শট বা পুরোপুরি ভ্যাক্সিন গ্রহণ করেছেন তাদের তুলনায় সমবয়সী যে সকল আমেরিকান ২টি শট ছাড়াও নতুন বাইভ্যালেন্ট কোভিড বুস্টার গ্রহণ করেছেন তাদের করোনা সংশ্লিষ্ট জটিলতায় হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যুর হার ৮০% কম। গবেষকগণ আরও দেখতে পান যে সময়ের ব্যবধানে ভ্যাক্সিনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। এমতাবস্থায় ৬৫ বা তদুর্ধ বয়সী যে সকল আমেরিকান অতিরিক্ত নতুন বাইভ্যালেন্ট কোভিড বুস্টার গ্রহণ করেন তারা কমপক্ষে ৪০% থেকে ৮০% বাড়তি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেন। ফলে তাদের নতুনভাবে করোনায় আক্রান্ত হওয়া, করোনা সংশ্লিষ্ট জটিলতায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিংবা করোনায় মৃত্যু বরণের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ৮০% কমে যায়। তবে দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে : অদ্যাবধি ১৪ কোটি ৭৫ লাখ ডোজ নতুন বাইভ্যালেন্ট কোভিড বুস্টার দেয়া হয়েছে।
মৃত্যু অব্যাহত- সংক্রমণের হার বৃদ্ধি : এবারের হলি ডে সীজনে (অবকাশ মৌসুমে) আমেরিকানদের চিরায়ত আনন্দ-উল্লাসের লাগাম শক্ত হানে টেনে ধরেছে করোনা নামক শতাব্দীর ভয়াবহ আসমানী গযব। কোভিড-১৯, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং এবং রেসপিরাটরী সিনসিশিয়াল ভাইরাস (আরএস ভি- শ্বাসনালীতে প্রদাহ সৃষ্টিকারী ভাইরাস) নামক ট্রিপলডেমিক (ত্রিমাত্রিক মহামারি) আমেরিকান আবাল-বৃদ্ধবনিতার জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের প্রতিবেদন অনুসারে গত সপ্তাহের মত চলতি সপ্তাহেও প্রতি ২৪ ঘন্টায় গড়ে ৩৮৬ থেকে ৪০০ জন হারে পুরো সপ্তাহে সর্বমোট ২,৮০০ আমেরিকান চিত্রগুপ্তের খতিয়ানে নাম লিখিয়েছেন। আর মৃতদের ৯৪% ই বর্ষীয়ান, শারীরিক জটিল সমস্যাগ্রস্ত এবং ডিজ্যবল বলে সিডিসি নিশ্চিত করেছে। এছাড়া চলতি সপ্তাহে প্রত্যহ ৬৬ হাজার হারে সর্বমোট ৪ লাখ ৭০ হাজার আমেরিকান নতুভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। একইভাবে চলতি সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ৫,১০০ হারে পুরো সপ্তাহে সর্বমোট ৩৫,৭০০ নতুন করোনা রোগী হাসপাতালে পরিষেবা গ্রহণ করেছেন বলেও সংস্থাটি দাবি করেছে। সর্বোপরি আমেরিকার বিভিন্ন হাসপতালে বর্তমানে ৩১ সহস্রাধিক করোনা রোগী মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন বলে ইউনাইটেড হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস জানিয়েছে। আর ইউএসসি ভারডুগো হিলস হসপিটালের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ড. আর্মান্ডো ডরিয়ান বলেন, দেশজুড়ে শীত মৌসুমের রোগ-ব্যাধি প্রবলভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
সিডিসির সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী পূর্ববর্তী সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। চলতি সপ্তাহে ২৯৫ টি কাউন্টি, ডিস্ট্রিক্ট কিংবা টেরীটরী হাই কোভিড-১৯ কমিউনিটি লেভেল; ১,১২৪ টি কাউন্টি মিডিয়াম কোভিড-১৯ কমিউনিটি লেভেল এবং ১ হাজার ৭৮৮৯ টি কাউন্টি লৌ কমিউনিটি লেভেল স্তরে রয়েছে। অধিকন্তু আরিজোনা, ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া, হাওয়াই, নিউ মেক্সিকো, রোড আইল্যান্ড এবং ইউটাহর সকল কাউন্টি লৌ কমিউনিটি লেভেল জুরিসডিকশনের রয়েছে। আর নিউ ইয়র্ক স্টেটে ফ্লু পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলে স্টেট স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে। সিডিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওমিক্রনের সাব-ভ্যারিয়েন্ট বিকিউ.ওয়ান.ওয়ানের সংক্রমণ জাতীয় পর্যায়ের মোট সংক্রমণের ৩৮.৪ % এবং বিকিউ.ওয়ানের সংক্রমণ ৩০.৭% হয়েছে । এদিকে সিংহভাগ ওমিক্রন উদ্ভূত ঢইই নিয়ে গঠিত অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টগুলোও জাতীয় সংক্রমণের মোট ৭.২ % এবং বিএন.ওয়ানের সংক্রমণ জাতীয় সংক্রমণের ৪.১% গঠন করেছে বলে সিডিসি জানিয়েছে। সিডিসি আরও জানিয়েছে যে ওমিক্রনের সাবভ্যারিয়েন্ট বিএ.ফাইভ এবং এর ৫টি সাবলাইনেইজ বা বংশ বিএ. ফোর. সিক্সের সংক্রমণ ৭.৪%; বিএফ. সেভেনের সংক্রমণ-৬.৮%; বিএ.টু সেভেন্টিফাইভ. এর সংক্রমণ ১.৩%; বিএ.ফাইভ.টু. সিক্সের সংক্রমণ ৩% এবং বিএ.টু. সেভেন্টীফাইভ.টু এর সংক্রমণ- ১.৩% বলে জানা গেছে। সিডিসির ২০ ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান অনুসারে চলতি সপ্তাহে সামগ্রিকভাবে বিকিউ.ওয়ান.ওয়ান এবং ঢইই নিয়ে এর সংক্রমণ আনুপাতিক হারে বেড়েছে এবং বিকিউ.ওয়ান, বিকিউ.ফাইভ, বিএফ. সেভেন, বিএন.ওয়ান, বিএ.ফাইভ.টু. সিক্স এবং বিএ.ফোর.সিক্সের সংক্রমণ আনুপাতিক হারে হ্রাস পেয়েছে।
চীনে করোনায় ১০ লাখ মৃত্যুর পূর্বাভাস : করোনা নামক আসমানী গযবে ২০২৩ সালে চীনে নতুনভাবে ১০ লাখ লোকের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের পরিচালক ক্রিস্টোফার মুরে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মুরে জানান, ১৪০ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত চীনে আগামী বছরের ১ এপ্রিল পর্যন্ত কমপক্ষে ৩ লাখ ২২ হাজার মানুষ প্রাণ হারাবে। মুরে আরও জানান যে ১০ লাখ লোকের প্রাণহানি ছাড়াও ২০২৩ সালে চীনে কমপক্ষে ৪৭ কোটি মানুষ নতুনভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মুরে জানান, করোনা সংশ্লিষ্ট পূর্বারোপিত বিধি-নিষেধ শিথিল করার পর চীনে নতুনভাবে করোনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে এবং কমপক্ষে ৭ হাজার মানুষ নতুনভাবে মারা গেছে। তিনি জানান, পরিস্থিতির আরও ভয়ানক অবনতি ঠেকাতে ইতোমধ্যে সাংহাই ও অন্য কিছু এলাকায় শ্রেণীকক্ষ পাঠদানের স্থলে অনলাইন পাঠদান শুরু হয়েছে।
লস এঞ্জেলেস কাউন্টিবাসীর ভোগান্তি তুঙ্গে : করোনার উপদ্রবে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ এঞ্জেলেস কাউন্টির বাসিন্দাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। কাউন্টির পাবলিক হেলথ পরিচালক বারবারা ফেরের ১৯ ডিসেম্বর বলেন, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত এবং হাসপাতালে করোনা রোগীর ভর্তির হার অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উক্ত কাউন্টিক হাই ক্যাটাগরী কোভিড-১৯ এলাকা ঘোষণা করা এবং জনস্বার্থে কাউন্টিতে মাস্কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পরিচালক বারবারা ফেরের বলেন, ১ মাস আগের তুলনায় উক্ত কাউন্টিতে করোনায় দৈনিক আক্রান্তের হার গড়ে ১২৯% বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন আগে যেখানে গড়ে প্রতি ২৪ ঘন্টায় আক্রান্ত হয়েছিল ১,৩২২ জন, বর্তমানে সেখানে বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন ৩,০২৮ জন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। কাউন্টির পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে ফেরের বলেন, ১ মাস আগে যেখানে প্রতি ২৪ ঘন্টায় গড়ে ৫৮০ জন করোনা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, বর্তমানে সেখানে প্রতি ২৪ ঘন্টায় গড়ে ১,৩০৪ জন নতুন করোনা রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এদিকে সেডা সিনাইর অ্যাসোসিয়েটেড চীফ মেডিক্যাল অফিসার ড. সোনিয়া গান্ধি বলেন, হাসপাতালের রোগীদের ১৮% ই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত। তিনি জানান যে উক্ত কাউন্টিতে ফ্লু পজিটিভিটি ইতোমধ্যে ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সেন্টারস ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরিসংখ্যান অনুসারে লস এঞ্জেলেস কাউন্টির ৯ রিজিয়নে নতুন সংক্রমণের ৬৭.৮%ই হচ্ছে বিকিউ.ওয়ান এবং বিকিউওয়ান.ওয়ান।
সিডিসির সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী শুরু থেকে এ পর্যন্ত সমগ্র আমেরিকায় ৬৬ কোটি ৯৯ লাখ ডোজ ভ্যাক্সিন প্রদান করা হয়েছে। আর প্রায় ২৩ কোটি ১০ লাখ আমেরিকান বা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০.১% প্রাইমারী সিরিজ; এবং ৮৩.৩% বা ২৮ কোটি ৭৫ লাখ আমেরিকানকে কমপক্ষে ভ্যাক্সিনের ১টি ডোজ প্রদান করা হয়েছে। সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট প্রথম বুস্টার দেয়া হয়েছে ১৬ কোটি ২৫ লাখ ডোজ । ৫ বছর বয়সী মোট জনসংখ্যার ৫০.৮%কে প্রথম বুস্টার দেয়া হয়েছে প্রায় ১১ কোটি ৮৭ লাখ ডোজ। আর ৫০ থেকে উর্ধ বয়সী মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৮.১ %কে প্রায় ৩ কোটি ৭১ লাখ দ্বিতীয় বুস্টার ডোজ দেয়া হয়েছে। আর আপডেটেড বুস্টার দেয়া হয়েছে ৪ কোটি ৪১ লাখ ৫৪ হাজার ২৯৪ জনকে যা মোট জনসংখ্যার ১৪.১%। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ এর সর্বমোট ১০০ কোটি ১৬ লাখ পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এবং চলতি সপ্তাহে গড়ে প্রত্যহ ৩ লাখ ২১ হাজার পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। কোভিড ডাটা ট্র্যাকার এবং কোভিড ডাটা ট্র্যাকার উইকলী রিভিউর পরিসংখ্যান অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে ১১ কোটি ৫ লাখ আমেরিকান কোভিড-১৯ এর বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছেন। আর করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা ১১ লাখ ৪ হাজার ছাড়িয়েছে ।