মনজুর কাদের :
বাঙালি মূলত স্বাধীনচেতা জাতি। নয়তো সাতচল্লিশে দেশভাগ হওয়ার চার বছরের মাথায় বাঙালি জিন্নাহকে চোখ রাঙাত না। আজীবন যক্ষ্মার রোগী হাড্ডিসার জিন্নাহ নিজে মোটেও ধার্মিক না হয়েও ধর্মের দোহাই তুলে ভারতবর্ষ থেকে জমি খামচে নিয়ে এসে পাকিস্তান বানালেন।
জিন্নাহর প্রায় পুরো পরিবারের সঙ্গেই অগ্নিপূজারি পার্সিয়ানদের আত্মীয়তা ছিল। তিনি নিজে সুন্নি মুসলিম ছিলেন না। ছিলেন শিয়া ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের লোক। ধর্মকর্ম থেকে আজীবন যোজন যোজন দূরে থেকেছেন। পশ্চিমা কৃষ্টি লালন করেছেন। কথিত আছে, একবার ঈদের দিন তার চাকর নানা পদের চর্বচোষ্য ও মিষ্টান্ন পাতে দিলে তিনি চোখ কপালে তুলে এত আয়োজনের কারণ জানতে চাইলেন। পরিচারক জানাল, ঈদ উপলক্ষে এই বিশেষ আয়োজন। তিনি ঈদ কী জানতে চাইলে পরিচারকটি সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিল, এটি খ্রিষ্টানদের বড়দিনের মতো মুসলিমদের একটি বড় উৎসব। তিনি নিয়মিত পান করতেন এবং মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ পশুর মাংস খেতেন।
এই যার ধর্মাচারের নমুনা, তিনি কিনা মুসলিমদের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে পাকিস্তান কেড়ে আনলেন, পাকিস্তানের ‘বাবায়ে কওম’ বা জাতির পিতা বনে গেলেন এবং আজীবনের জন্য পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল পদ বাগিয়ে নিলেন।
শুধু তা-ই নয়, তিনি অগ্নিপূজারি পার্সিয়ান বা জরাথুস্ট্রবাদের অনুসারী পরিবারের রতনবাই পেটিটকে বিয়ে করেন। পরবর্তী সময়ে তার কন্যা দিনাও অগ্নি উপাসক পার্সিয়ান যুবক ওয়াদিয়াকে বিয়ে করেন।
ধর্মকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে একটি রাষ্ট্রের পত্তন করা ও এর আজীবন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভাতে মাছে বাঙালি জাতির কাছে জীবনের চরম উষ্ঠা খেয়ে ধরাশায়ী হয়েছেন। সাতচল্লিশের তথাকথিত বিক্রমশালী মহানায়ক আটচল্লিশেই বাঙালিদের রক্তচক্ষু দেখে ভড়কে গেছেন। এরপর উনপঞ্চাশ, পঞ্চাশ ও একান্নর অসন্তোষ ও অবজ্ঞা হজম করতে করতে বাহান্নতে এসে চরম শিক্ষা পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেছেন। পরের ইতিহাস আরো তাচ্ছিল্যের, আরো অবজ্ঞার, আরো বিদ্রোহের। একাত্তরে এসে জিন্নাহদের আম-ছালা দুটোই খোয়াতে হয়েছে বাঙালিদের কাছে। এর কারণ হলো তাদের রাজনীতিকেরা ভণ্ড ও ধর্ম ব্যবসায়ী ভাঁওতাবাজ আর জেনারেলরা মদ্যপ ও অহমিকাতাড়িত দুর্বৃত্ত।
‘অন্ধকে পাগলের পথ দেখানো’ সংক্রান্ত শেক্সপিয়ারের সেই বিখ্যাত সংলাপ এখানেও প্রযোজ্য। পাকিস্তানের অধিকাংশ জনতাই মূলত অন্ধ এবং তাদের এখনো পথ দেখিয়ে চলছে পাগলের দল। কপাল ভালো, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ‘অমর কবিতাখানি’ রচিত না হলে কোনো দিনই পাকিস্তানি জেনারেলদের উর্দির কমরবন্ধ, ব্যাজ, তলোয়ারÑএসব কিছুই হয়তো আজও খসে পড়ত না।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে জনকের হাত ধরে জাতি বাংলাদেশ নামক একখণ্ড জমি কিনে তাতে মনের মতো আলপনা আঁকছে আর পবিত্র রোদের চাষ করে চলেছে। তার পরও আমাদের চাষের খেতে মাঝেমধ্যে শুয়োরের আনাগোনা দেখা দেয়।
জনকের হাত ধরে শোনিতের দামে কেনা ভূমি থেকে শুয়োর তাড়িয়ে পবিত্র আলোকের চাষ অব্যাহত রাখতে আমাদের আরও কিছু স্বাধীনতা দরকার।
নারী অধিকারের স্বাধীনতা : এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, নারীরা কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করায় বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল হয়েছে, জিডিপির পরিমাণ বেড়েছে এবং বহুমুখী আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সংবিধানের বিপক্ষে গিয়ে নারীশিক্ষা ও নারীর কর্মসংস্থানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা। বিপরীতে শুদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন দিন দিন নিষ্প্রভ হচ্ছে। কবিতা, গান, নাটকসহ বিভিন্ন ললিত আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রাচীন সংস্কারকে অতিক্রম করতে হবে।
স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নারীদের অবাধ চলাচল ও জীবনযাপনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দরকার। নারীরা যত বেশি শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে, দেশের উন্নতিও ততটাই ত্বরান্বিত হবে।
একমুখী শিক্ষার স্বাধীনতা : দেশে মূলত ত্রিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চলছে। বিশ্বাসভিত্তিক বা ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা, বিদেশি ভাষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা ও জাগতিক বা বিজ্ঞাননির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা। এতে করে একটি জাতি তিনটি বিপরীত চিন্তাধারা ধারণ করে এক আলো-আঁধারির মনোজগৎ তৈরি করছে। প্রতিটি শিশুর একমুখী জাগতিক শিক্ষাব্যবস্থার অধিকারের স্বাধীনতা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
একমুখী বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা : একটি দেশে একই সঙ্গে সংবিধানভিত্তিক বিচারব্যবস্থা ও শরিয়াভিত্তিক বিচারব্যবস্থা চলছে। সংবিধানভিত্তিক বিচারব্যবস্থায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা আছে। কিন্তু শরিয়াভিত্তিক বিচারব্যবস্থায় নারী-পুরুষের সম্পদ বণ্টনসহ বিবিধ রকমের বৈষম্য রয়েছে। একটি স্বাধীন দেশের প্রত্যেক নাগরিকের সমঅধিকারভিত্তিক একমুখী বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা প্রয়োজন।
শ্রমিকের ন্যায্য অধিকারের স্বাধীনতা : অতি সম্প্রতি চা-শ্রমিকদের বেতন পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। তাদের যে বেতন স্থির করা হয়েছে, তাতে এই বাজারে দুই কেজি চালও কেনা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ চা-বাগান মালিকেরা এ দেশের সেরা ধনী। একই পরিস্থিতি পোশাকশিল্পসহ অন্যান্য সেক্টরেও। সেখানে আমাদের নারী শ্রমিকেরা খুবই অপমানজনক মজুরিতে কাজ করেন। দুটো বাড়তি পয়সার জন্য ওরা ভোর থেকে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত ওভারটাইম করে ঘরে এসে রান্নাবান্না করে স্বামী-সন্তানের মুখে যাহোক দুটো অন্ন তুলে দেন। ওদের সন্তানেরা মায়ের সাহচর্য, স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই সন্তানগুলো রাষ্ট্রের নাগরিক, রাষ্ট্রের সম্পদ। নারী শ্রমিকেরা নয়টা- পাঁচটা কাজ করে সম্মানজনক পারিশ্রমিক পেলে ওদের পারিবারিক জীবন জলাঞ্জলি দিয়ে ওভারটাইম করতে হতো না। এতে ওদের সন্তানেরা আরও উন্নত সুসন্তান হয়ে জাতির সম্পদে পরিণত হতো।
জনমুখী প্রশাসনের অধিকার : ডিসি-এসপিদের তো বটেই, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, পিয়ন-চাপরাশিদেরও স্যার না ডেকে নাগরিকের উপায় থাকে না। মেয়ের শিশুসুলভ আচরণের জন্য জজ সাহেবার স্কুলে এসে ক্ষমতা দেখানোর অভিলাষে ছাত্রীদের মায়েদের পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা বা রংপুরের ডিসি সাহেবাকে স্যার সম্বোধন না করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে তিরস্কার করার ঘটনা সম্প্রতি দেশে ঘটেছে। সরকারি কর্মচারীদের এই সনাতনী শোষণ প্রয়াসের শেকল ভেঙে একটি জনমুখী সেবামূলক প্রশাসনের অধিকার এখন সময়ের দাবি।
গৃহকর্মীদের স্বাধীনতা : ঘরে ঘরে গৃহকর্মীরা মূলত প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই কাজ করে। এদের আবার বেশির ভাগই শিশু-কিশোর। দু’মুঠো ভাতের জন্য সাত রাজার ধনকে পরের গঞ্জনা সইবার জন্য অসহায় বাবা-মায়েরা সন্তানকে অন্যের ঘরে কাজ করতে পাঠান। দু-একটি ক্ষেত্র বাদে এদের অধিকাংশই সর্বাঙ্গে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা ও হাড্ডিসার দেহ নিয়ে জীবন বয়ে বেড়ায়। প্রকারান্তরে এই দাসপ্রথা থেকে আমাদের সন্তানদের মুক্তি দরকার।
আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে ভৌতিক উন্নয়ন হয়েছে। এবার মননের উন্নয়ন চাই। দুর্নীতিমুক্ত, সভ্য, সুশীল, পরোপকারী একটি দয়া-মায়ার বাংলাদেশ দেখার জন্য আমরা উন্মুখ হয়ে আছি।
লেখক : ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক।