
শামসাদ হুসাম
সে বলতো, ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন, কে কার অলংকার!”
আর আমি বলতাম, ‘বেলুইন হাত’। রুটি বানানোর বেলুনের মতো গোলগাল।
হেসেই জবাব দিতো, সেজন্যই তো অন্যরকম।
সেই বেলুইন হাত নিয়ে আমার গর্দিসের সীমা নেই। মাসে কত বার করে রক্ত দিতে হয়। অসুখের কোন সীমা পরিসীমা নেই আমার। রক্ত পরীক্ষার জন্য যিনি সূঁচ ফোটাতে যান, তার বিরক্তিকর মন্তব্য হজম করতে হয়, ‘বাটার ফ্লাই সূঁচ দিয়েও রক্ত বের করা যায় না, কি যে ঝামেলায় ফেলেন?’
এই এত শারীরিক ঝামেলা নিয়েও কিছুদিন পর পর আমাকে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হয়। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস!
এই পর্যন্ত শতবার ছুরি-কাঁচির নিচে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে দিতে নিজের উপরেই ঘেন্না ধরে গেছে। প্রথমবার ১৯৮১ সালে প্রথম যখন কিডনিতে চারটা বড় বড় পাথর ধরা পড়ল, সেই প্রথম সার্জারির সাথে পরিচয়। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শল্য চিকিৎসক ডা. ডি.ই. রাজা চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে সেই অপারেশনটা হলো। অর্ধচেতন অবস্থায় পোস্ট অপারেটিভ রুমের আলো আঁধারীতে শুয়ে অস্পষ্টভাবে কারুর কথা কানে ভেসে আসলো। কেউ যেনো শক্তভাবে গলা চেপে ধরে বলছেন, ‘শুনুন আপনার অপারেশনটা সাকসেসফুল হয়েছে। চারটা পাথর নিয়ে এসেছি, নেকলেস বানিয়ে দেখাবেন’। সেই নেকলেসটা আর না বানালেও কথাটা লেগে গেলো জীবনের অনেক কিছুর সাথে। ‘কিডনি রোগী’ এই এক অভিধায় কাটিয়ে দিলাম জীবনের সুদীর্ঘ সময়। তার কয়েক বছর পরে ফের শুরু হলো সমস্যা। প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া, শরীর, ফুলে যাওয়া, সেই আসে জ্বর আর প্রচণ্ড বেদনা।
দেশে তখন পর্যন্ত স্টোন ক্রাস করার বিধান চালু হয়নি। দিল্লীতে সবেমাত্র শুরু হয়েছে। সেই সময়ে দিল্লীতে বাংলাদেশ মিশনে কর্মরত ছিলেন আমার হাসবেন্ডের বড় ভাই। জিয়াউস শামস চৌধরী। ডেপুটি হাইকমিশনার। তার আমন্ত্রণে দিল্লীতেই গেলাম। ফুল অ্যালেসথেসিয়া দিয়ে স্টোনটা ক্রাস করে দিলেন আর জে আর স্টোন ক্লিনিকের ডাক্তার। একইভাবে অর্ধচেতন অবস্থায় পোস্ট অপারেটিভ রুমের বিছানায় শুয়ে শুনলাম, ডাক্তারের অ্যাসিস্টেন্ট মুখের কাছে ঝুঁকে বলছেন, ‘শামসাদজী আপনার অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। আর কোন ভয় নেই আপনার।’ ডাক্তার কিন্তু দেখা করতে এসে উল্টো কথা বললেন, ‘অপারেশন সাকসেসফুল হলেও আপনার জন্য বড় ভয়ের কারণ হলো, এই ধরনের রোগীদের বারবার কিডনিতে স্টোন হয়। তাই খুব সাবধানে থাকতে হবে আপনাকে।’ তাই রেড মিট থেকে শুরু করে লিফি ভেজিটেবিল, মিল্ক প্রোডাক্ট সবকিছু খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। তাহলে বাকি থাকে কি?
ডাক্তার বললেন, বেবি চিকেন আর ছোট মাছ। স্বাভাবিক জীবনের বাইরে গিয়ে মানুষ কি করে বাঁচে? নিরন্তর চেষ্টা করেও ভালো থাকা আর হলো না। এরপরে আরো একবার ঢাকায় গিয়ে পিজি হাসপাতারে স্টোন ক্রাস করলাম। তারপর ২০১০ সালে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানের মেট্রোপলিটান হাসপাতালে চতুর্থবারের মতো স্টোন ক্রাস করলাম। গর্দীস আর কমে না।
পরবর্তী সময়ে মাউন্ট সাইনাই হাসপাতালে আরো দু’বার ব্রেস্ট সার্জারি করাতে হলো এবং এর জের হিসেবে পুরো মাসজুড়ে রেডিয়েশন চললো পুরো শরীরের উপর। কত অমানবিক ধকল। একেক সময় সহ্যের বাইরে চলে যায়।
এ মুহূর্তে শুয়ে আছি নিউইয়র্কের ব্রুকলিন প্রেস বাইটারিয়ান মেথোডিস্ট হাসপাতালের আইসিইউতে। বেশ কিছুদিন থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। প্রায়ই পালমোনারী ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্ট থাকে। শ্বাস কষ্টের পরিমাণটা বেড়ে গেছে অনেক খানি। কিন্তু ডাক্তারের বক্তব্য, অ্যাজমাটিক প্রব্লেমই এই শ্বাস কষ্টের পিছনের কারণ। কিন্তু আমি বিষয়টি মানতে পারছি না। তাহলে তো ওষুধের কারণে উপসর্গ কন্ট্রোলে থাকত। তাতো হচ্ছে না।
এর মধ্যে আবার চোখের সমস্যা বেড়েছে। চোখ দেখাতে গেলে ডাক্তার শর্ত জুড়ে দিলেন, কার্ডিওলোজিস্টের কাছ থেকে অথরাইজেশন লাগবে। গেলাম কার্ডিওলোজিস্টের কাছে। দু’বার ই-কেজি করার পর হেসে বললেন, হার্টের কোন সমস্যা নেই। আপনি চোখ দেখাতেই পারেন। কিন্তু আমার চিন্তা যাচ্ছে না। যদি কিছু নাই হবে, তাহলে হাঁটাহাঁটি করলে এতটা ক্লান্ত লাগবে কেন! ঊাথরুম থেকে বের হলেও একই অবস্থা। কার্ডিওলোজিস্টের চেম্বার ব্রুকলিনে। আর আমার বাসা কুইন্সের উডসাইডে। কম দূরত্বের বিষয় নয়। ঘণ্টা দেড়েক লাগে, আর ট্রাফিক জ্যাম থাকলে তো আরো সময় লাগে। তারপরও গেলাম ব্রুকলিনে ডাক্তারের চেম্বারে। জানালাম আমার একটা থরোলি চেক-আপ দরকার। কথাটা শুনে বললেন, ঠিক বলেছেন, আপনারাতো আবার ‘কাউ ইটার’ জাতি। থাকতেই পারে সমস্যা। ঠিক আছে একটা এনজিওগ্রাম করিয়ে নেন। তখন শিওর হওয়া যাবে। ঠেঁশ দিয়ে কথা বলতে ছাড়লেন না। ‘আপনাদের লাইফ স্টাইলই এইসব রোগের জন্য দায়ী, বুঝলেন। আমার কিন্তু বাঙালি হিন্দু ধর্মের হার্টের রোগী একেবারেই নেই। যত বেশি আমি আপনাদের সমাজের আর ধর্মের রোগী পাই সেই তুলনায়।’
চুপ করে শুনলাম, জবাব দিলাম না কোন কথারই। শুধু কি গরু খাওয়াই মূল কারণ? জেনেটিক কোন বিষয় কি নেই পিছনে? গত ২০০৫ সালে আমার মায়ের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালে। তখন আমি দেশেই ছিলাম। আমার বড় মামা জাস্টিস বিআই চৌধুরী থাকতেন জীবনের শেষের দিকে এসে এই নিউইয়র্কে, ছেলেদের কাছে। লং আইল্যান্ডের জুইস হাসপাতালে তারও ওপেন হার্ট সাজারি হয়েছিল। বাদবাকি দুই মামা লন্ডনে থাকতেন। এবং একমাত্র খালা সিলেটে থাকলেও তারের তিনজনের হার্টে রিং পরানো ছিল। আমার আব্বাও মারা গিয়েছিলেন হার্ট অ্যাটাকে। কাজেই ইন্ডিয়ান ডাক্তারের সাথে আর তর্কে গেলাম না। আসলে ভালো লাগছিল না একেবারেই। ডাক্তার বলে দিয়েছেন এনজিওগ্রাম প্রেস বাইটারিয়াব হাসপাতালেই করাতে হবে, কারণ ঐ হাসপাতালের তিনি কর্মরত চিকিৎসক। শেষ পর্যন্ত জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এনজিওগ্রামের জন্য গেলাম। যথারীতি ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভাগ্যক্রমে যে ডাক্তার আমার উপর ঐ ডাক্তারি প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করবেন, তিনি বাংলাদেশি বাঙালি। কিছু কেস হিস্ট্রি নেয়ার পর লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে মনিটরের উপর চোখ রেখে বসলেন পাশে। আস্তে আস্তে কথা বলছেন, জানতে চাইলেন টিভি স্ক্রিনে কিছু দেখতে চাই কিনা? না করলাম। দেখলে বুঝতে পারব না কিছুই, তার চেয়ে আপনিই বলেন।
খুব মোলায়েম ভাবে বললেন, আপনার যে অবস্থা দেখলাম, অর্থাৎ তিনটা আর্টারিতে পঁচানব্বই শতাংশ ব্লক। এ অবস্থায় সার্জন যা বলবেন, আপনি সেটাই মেনে নিয়েন। আমার মনে হয় এ অবস্থায় রিং পরানোর কোন উপায় আর নাই। আর মন খারাপ করবেন না। এদেশে এই অপারেশন আর ভয়ের কোন ব্যাপার নয়। রোজ কত জনের হচ্ছে। সবাই সার্ভাইব করছেন। ইনশাল্লাহ আপনিও সুস্থ হয়ে উঠবেন।
ফেরত নিয়ে এসেছে রুমে। একটু হলেও শরীরের উপর দিয়ে ধকল গেছে একটা। কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও রেস্ট নেয়া দরকার।
কিন্তু স্ট্রেচার থেকে শরীরটা বিছানায় নামিয়ে রাখতেই দেখি হুড়মুড় কওে রুমে ঢুকছেন কার্ডিওলোজিস্ট বিনোদ প্যাটেল, সার্জন সন্ধ্যা বলরাম, সেই সাথে আমার পিসি পি ডাক্তার আহমেদ। ডা. প্যাটেলের ভূমিকা এখানে সরব। তিনিই আমাকে নিয়ে এসেছেন, অতএব সার্জন ডা. বলরামের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে বলছেন, আমরা ঠিক করে নিয়েছি আগামী পরশু আপনার সার্জারি হবে। বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে আছি। হাতে মাত্র দুইটা দিন! তারপরেই মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাবো আমি? রাজি হলাম না এত তাড়াহুড়াতে।
বললাম, প্রিপারেশনের জন্য হলেও আমার একটু সময় দরকার। শেষ পর্যন্ত এক সপ্তাহের চাইতে একটু বেশি সময় হাতে নিয়ে ঠিক হলো ২৩ তারিখ হাসপাতালে অ্যাডমিশন নেবো এবং পরেরদিন সার্জারি হবে। যথারীতি ২৩ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। শুরু হয়েছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ভর্তির সময়ে ছিলাম পাঁচতলার উপরের কেবিনে। রাতে শিফ্ট করলো করলো তিন তলায়, আইসিইউর একটি রুমে। পাশাপাশি, মুখোমুখি এখানে অনেকগুলো রুম। সবগুলাতেই রোগী আছেন। আটটা রুম এখানে, সদ্য সার্জারী সম্পন্ন হওয়া রোগীদের রাখা হয় এখানে। আমার দায়িত্বে তখন মধ্যবয়সী কালো এক নার্স। সার্জারি শেষ হয়ে গেলে প্রতি রোগীর সাথে দু’জন করে নার্স থাকেন। সারাদিন আমার সাথে আমার পরিবারের যারা ছিলেন, আজকের রাত্রের জন্য তাদের আর কোন দায়িত্ব নেই। কিন্তু আমার মেয়েটা ঘরে ফিরে যেতে চায় না, সে রাতে আমার সাথে থাকতে চায়।
কর্তব্যরত নার্স তার আবেদনে সাড়া দিলেন না। বললেন, এখানে বাইরের কাউকে এলাও করা হয় না। কিন্তু নাছোরবান্দার মতো অনুনয়ে ভেঙে পড়া অবস্থায় বললো, আমাকে কেউ দেখবে না, পিছনের দিকের একটা চেয়ারে বসে থাকবো চুপ করে। নার্সের মাতৃ হৃদয়ের তাতে সাড়া দিলো। কিন্তু সেই কন্যাটির সাথেও আমার কোন কথা হবে না সারারাতের ভিতরে। দু’জন দুই রুমের বাসিন্দা এখন। জানি না আজকের রাতটা আমার শেষ রাত কিনা! চুপ করে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিলাম। সকাল সাতটার সময় ওটিতে যেতে হবে, নার্স আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। সেজন্য আমার স্বামী এবং ছেলেÑ দু’জনই ভোর থাকতেই হাসপাতালে চলে এসেছে। আমার তিন আপনজন চুপ করে বসে আছে। কারো সাথেই কোন কথা হলো না, শুধু চোখ তুলে তাকালাম। আইসিইউর পাশেই অপারেশন থিয়েটার। সকাল সাতটা বাজতেই একজন নার্স বড় একটা টাওয়েল দিয়ে আশার শরীর পেছিয়ে দিয়ে আস্তে করে বললো, এবার আপনাকে যেতে হবে! এখনও আমি কারোর দিকে তাকাচ্ছি না। এমন কি বিদায়ও নিলাম না, যদি দুর্বল হয়ে পড়ি। আজ যিনি আমার অপারেশন করবেন, তার নাম সন্ধ্যা বলরাম।
ভারতীয় বংশোদ্ভুত এই মহিলা ডাক্তার প্রেস বাইটারিয়ান হাসপাতালের কার্ডিওলজি সার্জারি ডিপার্টমেন্টের হেড। তিনি এমডি ছাড়াও চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর পিএইচ ডিগ্রি নিয়েছেন। এক সময়ে মাউন্ট সাইনাই হাসপাতালে কাজ করলেও বর্তমানে ব্রুকলিন প্রেস বাইটারিয়ান মেথোডিস্ট হাসপাতালের কার্ডিওলজি সার্জারি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। বয়স কত হবে ঠিক বোঝা যায় না। হালকা পাতলা গড়নের ঐ মহিলা তার রোগীদের বিষয়েও খুব যত্নবান। সার্জারির পরে প্রায়দিন সকালে এবং বিকালে দু’বার করে দেখে গেছেন।
আইসিইউ থেকে ওটির দূরত্ব মাত্র কয়েক কদমের হাঁটা পথ, কিন্তু হাঁটতে গিয়ে পা ভারি হয়ে উঠল! মনে হচ্ছে কোন দূরের যাত্রায় রওয়ানা হয়েছি। বড় প্রশস্ত একটা রুম। পা রাখতেই নজর গেল, প্রায় সবাই ব্যস্ত এখানে, তারপরও চোখ তুলে তাকালেন দু’একজন। একজন এগিয়ে এসে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় উঠতে সাহায্য করলেন। তারপর বেহুঁস করার পালা। মনে মনে বললাম, অনেকবারইতো এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গেছি। তাই খুব একটা ভয় পাচ্ছি না। অ্যানেসথেসিয়ার ইনজেকশন পুশ করার পরে এতো আরামের একটা ঘুম নামে দু’ চোখজুড়ে। কিন্তু এবার একটু অন্যরকমের মনে হলো। ইনজেকশন দেয়ার সাথে সাথে সারা শরীরজুড়ে এক অন্য ধরনের জ¦লুনি টের পেলাম, যেন আগুন লেগেছে সবখানে। তারপর আর কিছু মনে নেই। এক নিঃসীম অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে জগৎ-সংসার সবকিছু পড়ে রইলো পায়ের কাছে।
পুরো সেন্স যখন ফেরৎ এসেছে, তখন চোখ খুলে তাকালাম। আইসিইউ রুমের বিছানায় শুয়ে পায়ের দিকে ওয়ালে চোখ গেল। বড় একটা ঘড়ি, সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তখন চারটা বেজেছে। বুঝতে চেষ্টা করলাম, এই সময় কোন সময়, বিকাল চারটা, না ভোর চারটা? নার্স এগিয়ে এসে কপালে হাত রাখল, এখন ভোর চারটা। তোমার সার্জারি করতে সাড়ে সাত ঘন্টার মতো লেগেছে। এখন তুমি পুরোপুরি ভালো আছ। একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। কিন্তু ঐ আধো ঘুম আর আধো জাগরণের ভিতরে টের পেলাম, সারা শরীরজুড়ে আমার ব্যান্ডেজ করা। পুরো বুকজুড়ে ব্যান্ডেজ। বাম পায়ের দুই জায়গা থেকে শিরা কেটে নেয়া হয়েছে, সেই পাটা গোঁড়ালী থেকে উপরের পুরো অংশজুড়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। গলার ডান দিকে মনে হলো হোল করে একটা পাইপ ঢূকিয়ে রাখা, অপারেশনের পরে যাতে জখমের জায়গায় পানি না জমে। এক হাতে স্যালাইনের সূঁচ, সেখান দিয়ে এন্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে। পুরোপুরি এক মমির মতো আপাদমস্তক ব্যান্ডেজের ভিতরে বন্দী হয়ে আছে আমার সারা শরীর। এই আইসিইউতে কাটলো আটদিন, বাকি আটদিন কেবিনে। মোট ষোলদিন কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত বাসায় ফিরে এসেছি। কিন্তু পুরোপুরি ভাল আর হওয়া হলো না, এত এত সমস্যা কেউ শুনলেই উপদেশ দেন, এতবড় সার্জারি হলো তার ধকল তো অনেকদিন পর্যন্ত থাকারই কথা।
রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর জন্য পবিত্র এক মাস। ঐ মাসটাও আমার ভালোভাবে কাটলো না। হঠাৎ করে মনে পড়ল ১৯৬১ সালের কথা। আমর পিঠাপিঠি বয়সের ভাইটা গুরুতর ম্যানেনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। অফুরন্ত এক প্রাণশক্তির অধিকারী সেই শিশুটি মাত্র চার বছর বয়সের সময়ে একদিনের জ¦রে মারা গিয়েছিল। ম্যানেজটাইটিস হয়েছিল। সেই সময়ে অজপাড়াগাঁয়ে থেকে এত বড় অসুখের চিকিৎসা করানোর কোন উপায় ছিল না, ফলে মারাই গেল ভাইটি! সন্ধ্যার আঁধার নামার সাথে সাথে যখন বাড়ির মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসছিল ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ, হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ নামাজের জন্য আসো, কল্যাণের জন্য আসো। অবুঝ সেই শিশুটি তখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। পাকঘরে কাজের মানুষেরা ইফতার তৈরিতে ব্যস্ত। রমজান মাস ছিল সেই সময় সাতাশে রমজানের পবিত্র প্রহর। আর আমরা যারা নিকটজনেরা তার কাছে ছিলাম, সবাই তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি।
বিষয়টি কিন্তু কি ঘটছে, কেবল সেটাই বুঝতে পারছি না। সারাদিনের উপবাসের পরেও কাউকে মুখে ইফতার তুলতে দিচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত এক পর্যায়ে এসে বন্ধ হয়ে গেল তার তড়পানি। পরম নিশ্চিন্তে ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে আমাদের রাজপুত্র। এতদিন সে ছিল আমার খেলার সঙ্গী। সেই আজ সবকিছু হেলায় তছনছ করে দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে সবার চোখের সামনে। বুঝতে পারছি এই ঘুমই কাল ঘুম তার। ক্রমশ একটা অসহ্য যন্ত্রণা টের পাচ্ছি বুকের ভেতর। কেউ একজন আট বছর বয়সী এক কিশোরীর পিঠে হাত রেখে বললেন, তোমার ভাই চলে গেল আল্লাহর বাড়ি। কোথায় সে বাড়ি, যেখানে আল্লাহ থাকেনÑ জানতে চেয়েছিলাম কি তখন? আজ আর সে কথা মনে নেই। তবে অনেককে ফিসফিস করে বলতে শুনলাম, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন।
সারাজীবন দিয়ে এই কথাটিই জেনেছি খাঁটি, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেনÑ আমার কি সাধ্য আছে মাবুদ প্রতিবাদ জানাই এই কথার? সারাটি জীবন ধরে নিজে যা চাইলাম, সব সময় তার উল্টো ফল হলো। আমার বয়সী অনেক স্বজন-প্রিয়জনকে যখন দাপটের সাথে পথ চলতে দেখি, তখন কেবল নিজের অসহায়ত্বের কথাই মাথায় ঘুরপাক খায়।