
মুক্তারা বেগম নদী :
নেপোলিয়নের সেই বাণী : ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ যার জন্য এই বাক্যটি সার্থক, তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। আমার পথপ্রদর্শক, আমার প্রিয় মানুষ, প্রিয় ব্যক্তিদের একজন, আমার প্রথম শিক্ষক, যিনি ছিলেন মনেপ্রাণে আধুনিক, একজন প্রগতিশীল মানুষ, একজন মমতাময়ী মা, সমাজসেবিকা, দানশীল, অতিথিপরায়ণ, হাসি-খুশি ও প্রাণবন্ত, যাকে কোনো দিন মলিন মুখে দেখিনি, দেখিনি কখনো রাগ করতে; শুধু নারী নয়, যিনি আমাকে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় সচেষ্ট ছিলেন, তিনি আমার দাদি। ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি সোমবার লন্ডনের স্থানীয় সময় ১২টায় তিনি আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে যান। তার প্রচেষ্টা কতখানি সার্থক হয়েছে, কতটা মানুষ হতে পেরেছি, কতটা নারী, জানি না। কিন্তু আজন্ম তার সেই প্রচেষ্টা সার্থক করার চেষ্টা করেছি এবং করব।
আমার জন্ম আর দশটা মফস্বল শহরের মতোই একটি শহর হবিগঞ্জে। আমিও হয়তো বেড়ে উঠতাম আর দশটা মেয়ের মতোই কিন্তু তিনি তা কখনোই চাননি এবং হতেও দেননি। সেই ছোটবেলা থেকেই তার অনেকগুলো মন্ত্রের একটা ছিল : ‘তুমি শুধু নারী নও, মানুষও।’
আমার দাদি, যাকে দাদু বলে সম্বোধন করতাম। তিনি ছিলেন বাহ্যিক ও মানসিক দিক দিয়ে অসম্ভব সুন্দর মানুষ। বুঝতে শেখার আগে থেকেই তিনি আমাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। সব সময় বলতেন, ‘সব সময় মনে রেখো, তুমি আগে মানুষ, তারপর নারী।’ তোমার নারীত্ব তোমার দুর্বলতা নয়, এটা তোমার শক্তি। তিনি চাইতেন প্রত্যেক নারীর কমনীয়তা, রমণীয়তার পাশাপাশি তার মাঝে থাকবে সাহস, শক্তি, বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মান। ঘরকন্নার পাশাপাশি তিনি উৎসাহ দিতেন দেশ-বিদেশের খোঁজখবর রাখতে, যেমন রাজনীতি, সমাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে। তিনি নিজেও অনেক রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন।
দাদির কাছ থেকে সেই ছোটবেলা থেকেই জেনেছিলাম আমার প্রিয় ব্যক্তিদের সাহস, আত্মত্যাগ, উদারতার কথা, যেমন মাদার তেরেসা, নেলসল ম্যান্ডেলা, প্রীতিলতা। আরও জেনেছিলাম মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, মার্গারেট থ্যাচার, চন্দ্রিকা কুমারাতাঙ্গার কথা। তারই ধারাবাহিকতায় আস্তে আস্তে জেনেছি জাহানারা ইমাম, পান্না কায়সার, সুফিয়া কামাল, ভেলরি টেলর এবং আরও অনেক সাহসী নারীর জীবনগাথা। যাদের কাছ থেকে পেয়েছি বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, জীবনযুদ্ধে লড়াই করার সাহস, মানবতা, মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ।
তিনি নিজেকে কখনোই দুর্বল মনে করতেন না। তার ছিল অপরিসীম প্রাণশক্তি। নিজে সুন্দর করে বেঁচে থাকার পাশাপাশি অন্যের বেঁচে থাকাকেও তিনি আনন্দময় করে তুলতেন। তার প্রিয় কবি ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কারণ তার আধ্যাত্মিকতা ও প্রতিবাদী মনোভাব দুটোই দাদুর পছন্দের ছিল। বিদ্রোহী কবির ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ সেই বিখ্যাত দুটি লাইনের জন্যই দাদি বলতেন, সারা জীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব।
আমার দাদা ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করেছেন। দাদু একাই তার আট ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন। সহায়-সম্পত্তি শুধু রক্ষাই করেননি, সেটাকে সমৃদ্ধও করেছেন। দাদুর যদিও নিজের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু তিনি খুব গোড়া ধার্মিক ছিলেন না। তার মাঝে আমি কখনোই কোনো কুসংস্কার দেখিনি। যার প্রতিফলন আমাদের মাঝেও ছড়িয়েছেন। তিনি তার নিজ সন্তান, পরবর্তী সময়ে আমাদের ভাইবোনদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষায়ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তার উৎসাহে আমি ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়েই কোরআন তেলাওয়াত করতে শিখি।
তিনি তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন মানসিকতায়, চলাফেরা ও পোশাক-আশাকে। আমাদের জবুথবু হয়ে চলাফেরা পছন্দ করতেন না। বলতেন, যা-ই পরো না কেন, সেটা যেন ফিটফাট, রুচিসম্পন্ন, আধুনিক এবং একই সঙ্গে মার্জিত ও শালীন হয়। দাদু খুব ম্যাচিং করে পরতেন। ছোটবেলা থেকেই আমার জন্য নিজে ম্যাচিং করে কাপড়, জুতো, গয়না কিনে আনতেন। যার জন্য আমার এখন খুব ম্যাচিং করে সবকিছু পরার অভ্যাস।
বাল্যবিবাহ তার একদম পছন্দ ছিল না। বলতেন, আগে লেখাপড়া, তারপর ক্যারিয়ার, তারপর বিয়ে। এর ফলে আমার ঢাকায়
এসে একা একা পড়াশোনা, চাকরি ইত্যাদি। মনে আছে, ঢাকায় এসে যখন ভর্তি হলাম, দুই মাস টানা ক্লাস করার পরই ক্লাস বন্ধ হয়ে গেল ছাত্ররাজনীতি-সংক্রান্ত ঝামেলায়। বাসায় ফোন করলাম আমাকে এসে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ফোনটা দাদুই রিসিভ করেছিলেন। আমি বললাম, আব্বাকে পাঠাও আমাকে নেওয়ার জন্য। বললেন, তুমি তো মানুষ হওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে গেছ, তাই না? তাহলে মেয়েমানুষের মতো আচরণ করছ কেন! তুমি যদি সারা জীবন দুর্বল, অবলা নারী হয়ে থাকতে চাও, তাহলে তোমার বাবাকে পাঠাব। আর যদি আত্মসম্মান, জ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষ হতে চাও, তাহলে একা এসো। দাদুর কথা শুনে সেই একা ঢাকা থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিই। তারপর আর কোনো দিন কেউ আমাকে নিতে আসেনি। আমি একা একাই সব জায়গায় চলাফেরা করি নির্ভয়ে।
ছোটবেলা থেকেই দেখেছি বাড়িভর্তি মেহমান, সব সময় লোকজন লেগেই থাকত, কত দূরদূরান্ত থেকে পরিচিত-অপরিচিতরা আসতেন। কেউ বেড়াতে, কেউ সাহায্য চাইতে, কখনোই তিনি কাউকেই ফিরিয়ে দিতেন না।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, যে আমি লিখতে গেলে এক লাইন লিখে চুপ মেরে বসে থাকি, সেই আমি অকাতরে কেবল লিখেই যাচ্ছি। আমার কথা অফুরন্ত কিন্তু আমার আবেগ অতৃপ্ত, অনেক লিখেও মনে হচ্ছে আমি আরো অনেক কিছুই বোঝাতে চেয়েছি কিন্তু কিছু ভাষা প্রকাশ করতে পারিনি। ঝড়ের ছবি যেমন অনেক রং থেকে মানুষ বুঝে নেয় কিন্তু কেবল শিল্পী বোঝেন সে ঝড়ের উদ্দাম তার বুকে বাজে। দাদুকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার সে রকম কোনো ছবি আকার মতোই উপলব্ধি হচ্ছে।
দাদু, মানুষ হও বলতে তুমি কী বোঝাতে, আমি কতটা তা ছুঁতে পেরেছি, জানি না কিন্তু মানুষ বলে কাউকে দেখার সৌভাগ্য আমাকে অন্য দশজন থেকে আলাদা করে। কারণ, আমি তোমাকে দেখেছি।