আমার দেখা দুর্গোৎসব

বাহারুল আলম :

এই লেখাটির শুরুতেই আমি এমন কয়েকজন মানুষের নাম উল্লেখ করতে চাই, যারা প্রথম থেকেই ঠিকানা’য় প্রকাশিত আমার লেখার অনুরুক্ত পাঠক। প্রতি বুধবার ঠিকানা পত্রিকা প্রকাশের দিনে তারা রীতিমতো চাতক পাখির মতো আমার লেখা পড়বার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। লেখা ছাপা হলে, তা পড়ে তারা ফোন করে বা খুদে বার্তা (Text message) পাঠিয়ে আমাকে সেই লেখা সম্পর্কে তাদের মূল্যবান মতামত দেন। বাড়িয়ে বলবো না, আমার লেখা সম্পর্কে তাদের ফিডব্যাক পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত ও প্রীত হই। কখনো লেখা ছাপা না হলে তারা তাদের আশাহতের কথা আমাকে অকপটে জানাতে ত্রুটি করেন না। আমার মতো নগণ্য একজন লিখিয়ের লেখার জন্য তাদের ভালোবাসা ও আকর্ষণ দেখে আমি অভিভূক্ত হই এবং লেখালেখি চালিয়ে যেতে উৎসাহ বোধ করি। এই কয়েকজন ব্যক্তি হলেন, বাংলাদেশের অগ্রণী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম তাজু মোহাম্মদ মিয়া, ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল অধ্যাপক মিসেস মনোয়ারা বেগম, তরুণ প্রকৌশলী শামস উদ্দিন, নিউইয়র্ক সিটি এজেন্সির কর্মকর্তা মনির আহমদ, রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান সৈয়দা নিলুফার এবং টাঙ্গাইল জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুল কুদ্দুস। শেষোক্তজন কয়েক বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন।

তারা সবাই অত্যন্ত সজ্জন ও সুভাষী মানুষ এবং সম্পর্কের দিক থেকে আমার আত্মীয় হন। তাদের সবার জন্য রইলো আমার অশেষ শ্রদ্ধা ও প্রীতি। এবারে লেখার মূল বিষয়ে আসি।

গত কিছুদিন আগে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে বাঙালি হিন্দুসমাজ অত্যন্ত সাড়ম্বরে শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করেছেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, ধরাধামে অশুভের বিরুদ্ধে শুভ এবং অমঙ্গলের বিপরীতে সমাজে কল্যাণ ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠাই দুর্গোৎসবের অন্যতম মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

১৯৯৮ সালের শেষদিকে স্থায়ীভাবে আমেরিকায় চলে আসার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে প্রতি বছর আমার বসতবাড়ির নিকটবর্তী পূজামন্ডপগুলো সময় পেলে ঘুরে ঘুরে দেখতাম। বাবার চাকরি সূত্রে আমার শৈশব ও কৈশরের অধিকাংশ সময় কেটেছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন থানা শহরে। এসব থানা শহরগুলো হলোÑ ফুলপুর, হালুয়াঘাট, গফরগাঁও, শেরপুর টাউন, নিকলি ও মদন। আশির দশকের শেষদিকে আমি কর্মসূত্রে কয়েক বছর চট্টগ্রামে অবস্থান করি। চট্টগ্রামে আন্দরকিল্লার জেএম সেন হল, কাজীর দেউরির আশকার দীঘির পার এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন প্রবর্তকের মোড় ও চট্টেশ্বরী রোডের পূজামন্ডপে বেশ কয়েকবার পরিবারসহ ঘুরতে গিয়ে যথেষ্ট আনন্দ লাভ করেছি। এসব স্থানে প্রতিবছর বেশ ধূমধামের সঙ্গে শারদীয় উৎসব পালিত হতো। হালুয়াঘাটে আমি শহরের মূল সড়কের অনতিদূরে অবস্থিত মিশনারি স্কুল সেইন্ট অ্যান্ড্রুজ স্কুলের প্রাথমিক শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। বাসা থেকে স্কুলে যাওয়ার পথে সড়কের পাশে স্থানীয় ধনাঢ্য হিন্দু ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে একাধিক পূজা মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হতো। বিশাল প্যান্ডেলের নিচে মানুষের বসার জন্য পাতা চেয়ারগুলোতে বসে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে আমিও কিছুক্ষণ পূজার দৃশ্যবলী অবলোকন করতাম। সারাক্ষণ মাইকে গান ও নানা ধরনের ঘোষণা প্রচার, ঢোল-বাদ্য, কাঁসর ও ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে হিন্দু তরুণ-তরুণীদের নৃত্য-গান পূজা অঙ্গণকে মাতিয়ে রাখতো। পূজা প্যান্ডেলের বর্ণময় সাজসজ্জা ও বহু রঙে রাঙানো প্রতিমাগুলোর দিকে অপলক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম।
পূজা-অর্চনায় অংশ নেয়া নয়, কেবল কৌতূহল মেটানো ও আনন্দ বিনোদন লাভের জন্যই ছিল পূজামন্ডপ ভ্রমণের আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। এসব পূজা মন্ডপে কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষই নন, সব ধর্মের বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করে খুব ভালো লেগেছে। পূজা মন্ডপগুলোকে মানুষের মিলন ও সম্প্রীতির এক অপরূপ ক্ষেত্র বলে মনে হয়েছে। এসব মানুষকে নিজ নিজ ধর্মীয় পরিচয়ের ভিন্নতা সত্ত্বেও উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নিতে দ্বিধান্বিত হতে দেখিনি।

সাম্প্রতিককালে পূজা মন্ডপগুলোর পরিবেশ কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। আনন্দ-উল্লাসের বদলে সেখানে স্থান হয়েছে এক ধরনের শঙ্কা ও ভীতির। বিগত বছরগুলোতে এমন সময় খুব কমই গেছে, যখন দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে কোনো না কোনো অজুহাতে দুর্বৃত্তদের দ্বারা পূজা মন্ডপে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা সংগঠিত হয়নি। বিচারহীনতার রেওয়াজ চালু থাকায় দুর্বৃত্তরা দুষ্কর্ম করে বিচার ও শাস্তি পাওয়া থেকে বেঁচে যাওয়ায় এ ধরনের ঘটনার পুনারাবৃত্তি হচ্ছে।

একটি শিক্ষিত সমাজ হলো সেই পরিপক্ব সমাজ, যা শিল্পকলা ও বিজ্ঞানকে উৎসাহিত (Promote) করে মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা ও সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে তোলে। শিক্ষিত সমাজ সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা ও লিবারেলিজম বা উদারনৈতিক নীতি-আদর্শকে সমুন্নত রেখে গর্ববোধ করে থাকে। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ধর্মকে অস্বীকার করে না, বরং তা বৈচিত্র্য (Diversity) ও অন্তর্ভুক্তিকে (Inclusion) উৎসাহিত করে। আর উদারনীতির অর্থ অনৈতিকতা নয়, বরং তা স্বাধীনতা এবং ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষের সমতাকে সমুন্নত করে। এটা আইনের চোখে সব নাগরিকের সম-অধিকার। তাদের মৌলিক অধিকার, যেমন- কথা বলা, মত প্রকাশ ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেয়।

এক শ্রেণির ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, যারা নিজেদেরকে ‘ধর্মপ্রাণ’ বলে দাবি করেন, তাদের নিজেদের অনেক কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য-বিবৃতি যে ধর্মসম্মত নয়, সেটা তারা বুঝতে অক্ষম বলে প্রতীয়মান হয়। যে কারণে তাদের আচরণ কোনো কোনো সময়ে সমাজে অশান্তি, বিভেদ ও অস্থিরতার জন্ম দেয়।

সাম্প্রতিককালে ইরানে জনৈক মহিলার কথিত সঠিকভাবে হিজাব না পরার অভিযোগে তাকে থানায় নিয়ে তথাকথিত নীতি পুলিশ (Morality Police) কর্তৃক বেধড়ক মারধরের ঘটনায় পরে তার মৃত্যুর ঘটনা এ ধরনের অজ্ঞানতার একটি নিদর্শন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশব্যাপী সৃষ্ট প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে ইরানী কর্তৃপক্ষের হাতে ইতোমধ্যে শতাধিক মানুষ হতাহত হয়েছেন এবং বহুসংখ্যক মানুষকে জেলে প্রেরণ করা হয়েছে। দু-একটি ক্ষেত্রে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী কিছু মহিলা তাদের হিজাব-নেকার রাস্তায় ফেলে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে উক্ত পুলিশি সংস্থার বিলুপ্তি ও তাদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সরকার পতন আন্দোলনের একটি টিপিং পয়েন্ট (Tipping Point) হওয়ার আগেই ইরান সরকারের নারীর প্রতি যথাযথ সম্মান ও বিক্ষোভকারী জনতার প্রতি সংযত আচরণ প্রদর্শনে মনযোগী হওয়া উচিৎ বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।

লেখক : কলামিস্ট।