এবিএম সালেহ উদ্দীন :
ছোট। খুব ছোট্ট ছিলাম তখন। মুখে কথা ফোটার পর চার বছর বয়সে বাড়ির দরজার স্কুলে পড়ার হাতেখড়ি। আমার মা কত রকম কথার কাসুন্দিগাঁথা গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসতেন। আমাদের উঠোনে বাড়িভর্তি নানান কিসিমের (ছোট/বড়) মানুষের দেখা মিলত, বিশেষ করে খাবার-দাবারের প্রাক্কালে।
কাছারি ঘর থেকে খবর আসত। বাড়ির কারবারি কালুর বাপ জানিয়ে দিতেন, আজ বাড়তি মেহমান আছে। ব্যস। মা তার গল্পের ঝুড়ির সঙ্গে পান-সুপারির পিতলা বাটি বন্ধ করে দলবলসহ ঘরে ঢুকতেন। আমিও মায়ের আঁচল ধরে ক্ষীণস্বরে ঘ্যানঘ্যান করে মুখে আওড়াতাম :
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
চিকচিক করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।’
যখন বড় হতে থাকলাম, একটু একটু করে চিনতে শুরু করলাম। কী অপরূপ শ্যামলিময় সবুজে আকীর্ণ আমাদের এই মাতৃদেশ। কবিগুরুর পঙ্্ক্তিমালায় কী সুন্দর অবয়বে আমাদের এই পল্লিবাংলার রূপসৌন্দর্যের বর্ণনা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পৃথিবীর সৃষ্টিকুলের সঙ্গে মানুষের অপরাজেয় শক্তির আনন্দ। মহামহিম স্রষ্টার আনন্দ। স্রষ্টার নির্মিলিত সঙ্গ-সায়নেও সৃষ্টির আনন্দ।
রবীন্দ্রনাথ মনে হয় আমার প্রিয় জন্মভূমি হাসানগঞ্জ গ্রামের রূপসুন্দর ছবির সঙ্গে বহু পূর্ব থেকেই জড়িয়ে আছেন। তাঁর সাহিত্যের বর্ণচ্ছটা পাঠ করলে মনে হয় যেন পৃথিবীর অনেক দেশ পরিভ্রমণের মতো রবীন্দ্রনাথ আমাদের শান্ত গ্রাম হাসানগঞ্জেও ঘুরে গেছেন।
শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর সব সৌন্দর্যের মোহনীয়তার সঙ্গেই কবির অনুভূতিকে মেলানো যায়। কবিরা এমনই হন। এমনই হওয়া উচিত।
ছোটবেলা থেকেই বিশ্বাসের আলো পেয়েছি বাবা-মা এবং গুরুজনের কাছ থেকে। বড় হয়ে বিশ্বাসের আলোতেই মানুষের ভুবন দেখা ও জানার চেষ্টা করছি। মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলি। আবার সংবিৎ ফিরে আসে। আসলে বিশ্বাসের দীপ্তিই জীবনের মূলধন। এখন আমার কোনো অসুবিধা হয় না। বরং হৃদয়ে অনাবিল আনন্দ-তৃপ্তি অনুভূত হয়। নির্মেঘ নীল আকাশের নিচে স্রষ্টার লীলাভূমি।
পৃথিবী ও প্রকৃতির কত সহস্র রকমের স্নিগ্ধতা, শ্যামলিময় সবুজের বর্ণনা যেমন স্রষ্টা দিয়েছেন। দিগন্তজুড়ে শুধু মুগ্ধতা আর মুগ্ধতা। তেমনি পৃথিবীর কবি-সাহিত্যিকদের কাব্য ও সুরের ঐশ্বর্য চিরন্তনভাবে গেঁথে রয়েছে স্রষ্টার অপার সৃষ্টিতে, সৃষ্টিকুলে। বন-বনানী ছায়াঘেরা চিরসবুজে আকীর্ণ শান্ত নদীর বাঁকে বাঁকে সাজানো আমাদের জন্মভূমি। আমার মায়ের নয়নজুড়ানো মাতৃদেশ, আমার প্রিয় মাতৃভূমি।
বড় হয়ে দেখলাম, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টি-সৃজনের অপার আনন্দে প্রকৃতির চিরায়ত সৌন্দর্যের বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন।
‘ঐ তো আকাশে দেখি স্তরে স্তরে পাপড়ি মেলিয়া
জ্যোতির্ময় বিরাট গোলাপ।’
মানবসভ্যতার উষালগ্ন থেকে মহামানবদের পারস্পরিক আগমন ঘটে চলেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বদৌলতে এই বিশ্ব স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টিকুল সম্পর্কে অবগত হতে পারছে। স্রষ্টার নিঃসৃত প্রেম আর প্রেমের চুম্বক আকর্ষণেই মানুষ অনন্তকাল বেঁচে থাকে মানুষেরই অন্তরে।
মহামানব গালিবের সুরে বলতে হয়। তিনি যেমন বলেন, ‘দুনিয়ার এই ভয়ানক উজাড় মজলিসে প্রদীপের মতো আমি প্রেমের শিখাকেই আমার সর্বস্ব জ্ঞান করলাম।’
কয়েক হাজার বছর আগে আরব্য কবি ইমরুল কায়েস রাজপুত্র হয়েও প্রেমের গভীরতায় মিশে যেতে ঘরছাড়া হয়েছিলেন। প্রেমের পূর্ণতার আকাক্সক্ষায় শহর-বন্দর, মরুপ্রান্তর ঘুরেফিরে কোন এক নিষিক্ত সন্ধ্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমরা সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসলাম, আমার চক্ষু তখন তার সৌন্দর্যের মোহময়তা অনুভব করলো, যা তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেÑতার চোখও অন্যদিকে আকৃষ্ট হয় পরিপূর্ণতার (প্রেম) জন্য।’
তেমনি রবীন্দ্রনাথ অতীত ও বর্তমানের সকল প্রেমের কথাই আমাদের শেখানোর চেষ্টা করেছেন তাঁর বিশাল কাব্যময় ভুবনজয়ী সাহিত্যসম্ভারে :
‘তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলি
সেই পুরাতন প্রেম যদি এককালে
হয়ে আসে দূরস্মৃত কাহিনী কেবলি
ঢাকা পড়ে নব নব জীবনের জালে।’
আরও শুনেছি লাইলি-মজনু, ইউসুফ জোলেখা, চণ্ডীদাসের প্রেমকাহিনি। কিন্তু আসল প্রেম হতে হবে স্রষ্টার সঙ্গে। সৃষ্টিকুলের অমিতধারায়।
কবিগুরুর গভীর প্রেমানন্দ এবং প্রেমের কত রকম দুঃখের কথা তাঁর অসীম কাব্যধারা ‘গীতাঞ্জলি’তে গেয়েছেন। আবার কখনো দেখি মুগ্ধতার ছোঁয়ায় স্রষ্টার অপার সৃষ্টির মহিমায় গেঁথে দিয়ে গেছেন তিনি তাঁর অমোঘ ছন্দময়তায়। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে সবকিছুই সুন্দর, মধুর আলোকের আনন্দে মাতোয়ারা।
‘প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে
প্লাবিত করিয়া নিখিল দ্যুলোক-ভূলোক
তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া।’
উন্মীলিত আকাশজুড়ে সহস্র পাপড়ির মধ্য থেকে উঠে আসা ধূমকেতু দুরন্ত নজরুল নিজস্ব ভক্তির পরাকাষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে তুফান এনেছিলেন। কীভাবে যেন ঈষাণ কোণের মন্ত্রঝটিকা অল্পক্ষণের মধ্যেই তোলপাড় শুরু করে দিলেন। তিনিও রবীন্দ্রনাথের স্নেহছায়ায় বিশ্বস্রষ্টার সৃষ্টির অতল রহস্যের মিলিত সম্ভারে বলেন : ‘এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোলজুড়ে ছায়ায়-মায়ায় তাবৎ মানুষের আসা-যাওয়ার খেলা।’
কাজী নজরুল ইসলামের কথার মতো বিশ্বপ্রভুর প্রেম এবং সৃষ্টির রহস্যময় খেলার কি শেষ আছে?
‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে
বিরাট শিশু আনমনে…’
বিশ্বচরাচরের সহস্রযোজন উপরের ঊর্ধ্বগগনে কোটি কোটি নক্ষত্র নীহারিকার আকাশময় ঘূর্ণন। নিষিক্ত ডিম্বাণুর মধ্য দিয়ে মাতৃকোলে যে শিশুর জন্ম হয়, সে-ই একদিন মহামহিম স্রষ্টার অপার নিদর্শন হিসেবে মানুষের ভুবন জয় করে। মহাপ্রলয়ের আগ পর্যন্ত এই পদ্ধতি ও সিস্টেম চলতে থাকবে।
রবীন্দ্রনাথ সে রকম একজন মহামানব। কত সৌভাগ্যবান আমরা। সাহিত্যানুরাগের তীব্র টানে রবীন্দ্রনাথের ছায়ায় আমরা মায়ার পরশ খুঁজতে পারি। নিজের কথা বলতে পারি। সেই শৈশব থেকে স্বপ্ন ও কল্পনার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে। মাতা-পিতার পরশ কোমল থেকে ক্রমাগত পৃথিবী, মাটি ও মানুষের ভুবনে ঘুরে বেড়ানো। কম কিসের। কম তো দেখা হলো না। এভাবেই মানুষ মানুষের হৃদয়ের গহন গভীরে আস্তে আস্তে জায়গা করে নেবে। মনের আনন্দের জগতে মিশে সর্বব্যাপী প্রস্ফুটিত হতে থাকবে। এটাই তো স্বাভাবিক এবং এতেই আনন্দ। যেমন মহাস্রষ্টার সৃষ্টিশীলতার আনন্দে কবিগুরু অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দেন :
‘আকাশতলে উঠল ফুটে
আলোর শতদল।
পাপড়িগুলি থরে থরে
ছড়ালো দিক্-দিগন্তরে
নিবিড় কালো জল।’
আবার সেই আকাশতলে দাঁড়িয়ে নিবিড়তর শান্ত ছায়ার আঁধারবাহিকায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চান মুক্ত বাতাসের সুখানন্দের নিবিড় ছায়ায়Ñ
‘মুক্ত করো হে মুক্ত করো আমারে
তোমার নিবিড় নীরব উদার
অনন্ত আঁধারে।’
নিষিক্ত আঁধারের মধ্যেই শুভ্রানন্দের সন্ধান পেয়েই যেন মহামানবদের মতো রবীন্দ্রনাথও স্বর্গের আলোপ্রাপ্ত হয়ে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন।
জীবনের পরতে পরতে মহামহিমের প্রবলতর মহিমার শেষ নেই। মানুষ তার কিছুটা বরাদ্দ। ওই আকাশের দিকে যখন তাকাই, পুণ্যবান হই তারই ঝলকে। তাই নিজের আকুতিকে নিজেই ব্যক্ত করি গুনগুনিয়েÑ
‘যদি চাহো, হতে পারো প্রেমময়
তবে, স্বকীয় শতরূপে হয়ে ওঠো পুণ্যবান
পরিপূর্ণ পুণ্যতায়…।’
আর রবীন্দ্রনাথ যখন বিনিদ্র তপস্যায় জীবনসাহিত্যে মানুষের অন্তর্নিহিত মনস্তত্ত্বের চিরন্তনী রূপকে নানান আঙ্গিকে, বিচিত্র বৈভবে রূপ দিয়েছেন। শিল্পসাহিত্যের মহাসমুদ্রে মানুষের জীবনের অনন্ত মায়াকে আনন্দ, বেদনা ও বিরহ-বিদ্রƒপের তুলিতে সুন্দরতম অবয়বে এঁকেছেন।
সেই কথা ভেবে তাঁরই ভাষায়Ñ
‘আমারে ফিরায়ে লহ অযি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে,
বিপুল অঞ্চল-তলে। ওগো মা মৃন্ময়ী, তোমার মৃত্তিকা-মাঝে ব্যাপ্ত হয়ে রই;…’
আজ বিশ্বায়নের ঝোড়ো হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে পৃথিবীর নানা প্রান্তর খুঁজে বেড়াই। কিন্তু কার খোঁজ? সেই মাকে খুঁজি। মাকে পাই না! কত ছন্দময় বিহারে ঘুরে ফিরি। কিন্তু মায়ের মতো স্নিগ্ধ কোমল মোহনীয়তা কোথাও মেলে না। কী করব? ভেবে কূল পাই না। বই নিয়ে বসি। একাগ্রচিত্তে পড়তে পারি না। জীবন নাকি ছন্দময়। তাই লিখতে যাই।
ছন্দের মগ্নতায় মাঝে মাঝে মনে করি, রবীন্দ্রনাথ তো আছেন। মধুর আমার মায়ের কথাগুলো তাঁর পঙ্্ক্তিমালার নিকট থেকে মিলে যাবে। গাম্ভীর্যের মধুময়তায় তিনিও সুরের স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে স্বীকার করবেন : ‘দীপ নিভে গেছে মম নিশীথ সমীরে…’
কী অসামান্য বোধ মানুষের প্রেমের নিষিক্ত আঁধারবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যকল্যাণের কাজে ব্যাপৃত এবং খোলা আকাশকে অবারিত করে রেখেছেন।
‘নাই বা বুঝিলে তুমি মোরে
চিরকাল চোখে
নূতন নূতনালোকে
পাঠ করো রাত্রিদিন ধরে।’
সেই যে শোকাহত্তোর এক নির্লিপ্ত সমাহিতির কবিতা। সোনার তরী। শব্দের সঙ্গে অক্ষর ও ধ্বনি, আর ধ্বনির সঙ্গে অনুভব-অনুভূতি আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে হৃদয়-মন ভরিয়ে ভিজিয়ে সিক্ত করে তোলে। তার কথাও আমাকে ভাবিয়ে তোলে। যাতে তিনি বর্ণনা করেন :
‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাইÑছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরেত
ঘন মেঘ ঘুরেফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়িÑ
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।’
তবু মহামহিম স্রষ্টার অপার সৌন্দর্যের আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তিনি তাঁরই মহিমা গেয়ে যান :
‘হে বিশ্বভুবনরাজ, এ বিশ্বভুবনে
আপনারে সবচেয়ে রেখেছ গোপনে
আপন মহিমা-মাঝে।’
কী চমৎকার অনড় প্রত্যয়বোধ ও রুচি-বৈদগ্ধ্যের নিষিক্ত মায়ার কথনে স্রষ্টার মহিমা প্রকাশ।
সাহিত্যের নির্মল চরিত্রের প্রাণপুরুষ আবু সয়ীদ আইউবের মতে : ‘যে বিশ্বাসটি সব ধর্মমতে বাস্তবিকই পাওয়া যায়, তা আত্মার অমরতায় বিশ্বাস। সব ধর্মের মূল কথা হচ্ছে যে জগৎ শুধু নিয়মের রাজত্ব নয়, জগৎ ন্যায়নীতির রাজত্বও বটে।’
‘যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার
বন্ধ রহে গো কভু
দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর প্রাণে,
ফিরিয়ে যেয়ো না প্রভু!’
শুধু কবিতাই নয়; জীবনালোকের প্রতিটি স্তরের বিশুদ্ধ চরাচরে মানুষের নিয়তালোকের কঠিন বাস্তবতা যাঁর সাহিত্যের পরতে পরতে বিদ্যমান। এমনকি অগ্নিগর্ভ প্রান্ত প্রান্তরের বিস্ফোরণমুখী অগ্ন্যুৎপাত থেকে মানুষকে উদ্ধারের দৃপ্ত প্রয়াসে তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্মকে নিখাদ প্রেমের রঙে সাজিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যবোধ অবিনশ্বর শব্দের নিপুণ সন্নিবেশ ঘটিয়ে সৃষ্টিকুশল শিল্পলোককে চিরন্তন ও অবিনশ্বর করে তুলেছেন। সাহিত্যের আকাশজুড়ে বাংলা সাহিত্যে এমন খোলা প্রান্তর আর কেউ দেখাতে পারেননি।
রবীন্দ্র-সান্নিধ্যের পরমতম সিক্ত প্রাণপুরুষ নজরুলও সে পথে এগিয়েছেন। সাহিত্যের অতুলনীয় পরিসম্ভারে যে অনিঃশেষ মাদকতা ছড়িয়ে গেছেন; তাও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
কোথায় ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যের সকল শাখায় তো বটে, ধর্ম-দর্শনেও তাঁর বিশ্বাস বহুল ছিল। অকপট সুদৃঢ় ছিল।
‘ধর্মের নবযুগ’ প্রবন্ধে তার দৃষ্টান্ত এমনতর; ‘মানুষের জ্ঞান আজ যে-মুক্তির ক্ষেত্রে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, সেইখানকার উপযোগী হৃদয়বোধকে এবং ধর্মকে না পাইলে তাহার জীবনসংগীতের সুর মিলিবে না এবং কেবলই তাল কাটিতে থাকিবে।’ এমন মুক্ত বুদ্ধি ও মুক্ত হৃদয়ই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য।
আমরা যেহেতু কবি নিয়ে বলছি : ধর্মচিন্তার এমন নজির পৃথিবীর আরো কবির কাব্যদর্শনে পাওয়া যায়। ধর্মের অনুপ্রক্রিয়া ও স্থানান্তর ইয়েটসের মাঝেও অধিক হারে লক্ষণীয়। চিন্তা-চেতনায় রবীন্দ্রনাথের কাব্যদর্শনেও তার দৃষ্টান্ত আছে। তেমনি রবীন্দ্রনাথের বিরহী কাব্যধারার সঙ্গে ইয়েটসের অন্তরের ও বাইরের ব্যর্থতা শেষ দিকের কাব্যে তিক্ত নৈরাশ্যের আমেজ দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ও ইয়েটস দুজনই ধর্মবিশ্বাসের কোলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
টিএস এলিয়টের সাহিত্যাদর্শে প্রাকৃতের মধ্যে ভেদরেখা টেনে অতিপ্রাকৃতকে মৌলিক ও চরম জ্ঞান করা হয়েছে। আবার টিএস এলিয়টের সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যাদর্শের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর ‘তীর্থযাত্রী’ কবিতাটি এলিয়টের ‘দ্য জার্নি অব দ্য ম্যাগি’র অনুবাদের সিক্ততায় আকীর্ণ।
উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয়ের আগে যখন ইউরোপে গীতাঞ্জলি নিয়ে চর্চা চলছিল, তখন আটলান্টিক পেরিয়ে মার্কিন দেশেও তার চর্চা শুরু হয়ে গেছে। ১৯১২ সালের ডিসেম্বর মাসে শিকাগোর স্বনামধন্য ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকায় তাঁর একগুচ্ছ কবিতা ছাপানো হলো। অনেক ভক্ত রবীন্দ্রনাথকে মহাকবি বলাও শুরু করেছিলেন।
ইয়েটস গীতাঞ্জলি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তখন একজন তরুণ মার্কিন কবি ইয়েটসের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনিও রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পড়ে ফেলার সুযোগ পান এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত ও প্রেমে আবদ্ধ হন।
২৭ বছরের সেই মার্কিন যুবক কবির নাম এজরা পাউন্ড। এজরা পাউন্ড যৌবনে স্বেচ্ছায় মার্কিন দেশ ত্যাগ করেছিলেন। আর তিনি কখনো স্বদেশে ফিরে যাননি। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ‘আধুনিক কবিতা’র ধারণা যারা গোটা বিশ্বের সাহিত্যসমাজে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁদের অন্যতম পুরোধা আধুনিক কবি এজরা পাউন্ড। যদিও আধুনিক কবিতার ধোঁয়া তুলে মাঝে মাঝে কারো কারো অর্বাচীন উক্তি শোনা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি আধুনিক কবি নন। কবিতায় দুর্বোধ্যতার মাশুল দিতে গিয়ে রবীন্দ্র-নজরুল আধুনিকতার গণ্ডিতে পড়েন না! তেমনি রবীন্দ্রভক্তিতে অতিমাত্রিক নিদর্শন দেখাতে গিয়ে অনেক ভক্ত নজরুলকেও আধুনিক কবিরূপে স্বীকৃতি দিতে চান না। আসলে এমন সংকীর্ণতা অনুদার কৌলিন্য ও বালখিল্যপনা বাংলা সাহিত্যে কাম্য নয়। নিতান্তই কষ্টদায়ক এবং গ্লানিকর।
অথচ রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে কী পরিমাণ স্নেহ-মায়ার পরশে ভালোবাসতেন, সেটি ওদের বোধগম্য নয়। কী প্রবল উচ্ছ্বাসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নজরুলের ভাষায় ‘গুরুদেব’ কাজী নজরুল ইসলামকে উদ্দেশ করে কত চিঠি, কত কথা ও মায়ার জালে অঙ্গীভূত করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি নজরুলকে ‘ধূমকেতু’ সম্বোধন করে যিনি নিঃসংকোচে অকপটে বলতে পারেনÑ
‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন…’
বাংলা সাহিত্য বলতে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠত্ব স্তরে স্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সপ্রমাণিত। এখানেই রবীন্দ্রনাথের জীবনের পূর্ণতা। সার্থকতা। জগতের সৃষ্টিকুশলতায় তিনি অনেকটা তৃপ্ত ও আনন্দিত। যে কারণে রোগশয্যায় থেকেও তিনি অকুণ্ঠচিত্তে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান :
‘লক্ষ কোটি গ্রহতারা। আকাশে আকাশে
বহন করিয়া চলে প্রকাণ্ড সুষমা।’
ধর্মতত্ত্বের নিরিখে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে দেখেছেন মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে। আর টিএস এলিয়ট ধর্মকে দেখেছেন সাহিত্য শৌখিনতার মধ্যে। আবার তিনি (এলিয়ট) ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন মধ্যযুগের চার্চতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের নিষ্প্রাণ আত্মনির্ভরতাহীনতায়!
আমার আজকের আলোচনার শেষার্ধের কথা হলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অনেক পথ ও প্রান্তরের পথ পাড়ি দিয়েছেন। নির্ভীক, নির্জন একাকিত্বের ট্র্যাজিক ও বেদনাগ্র চেতনার কাব্যে আত্মশুদ্ধির বিষয়টির মাধ্যমে কবিগুরুর জীবন উপাত্তে প্রকট হয়ে উঠেছে।
সত্য-সুন্দর, পরিমার্জিত, পরিশীলিত জীবন ও পথের সন্ধানে তাবৎ দুনিয়ায় সেরা মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র-নজরুলের কাব্য ও শিল্পভাবনায় তার আলোকপ্রভা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। পৃথিবীর সকল প্রান্তের সকল ভাষায় এই পথের সন্ধানের কথা রয়েছে। তবে এ পথ মসৃণ নয়, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংকটসংকুল। তবুও ধরিত্রীর বুকে পথের যাত্রা বন্ধ করা যাবে না। অনাদিকাল চলছে, চলবে।
‘বিশ্বজগতের তরে, ঈশ্বরের তরে
শতদল উঠিতেছে ফুটে।’
আমি থাকব না কিন্তু পৃথিবী থাকবে মানুষ থাকবে। পথের সন্ধান থামবে না। অনাদিকাল ভরে পান্থ আসবে এবং পথের সন্ধানে ব্যাগ্র-ব্যাকুল ব্যস্ত থাকবে।
জীবনের প্রতিটি স্তরের সাফল্যের স্বর্ণচূড়ায় আরোহণ করলেও সেই পথের সন্ধান চলবে।
রবীন্দ্রনাথের মতো শেষান্তে আমরাও যেন বলতে পারি :
‘হৃদয় আমার প্রকাশ হল অনন্ত আকাশে।
বেদন-বাঁশি উঠল বেজে বাতাসে বাতাসে ॥’
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।