হুমায়ূন কবির
লোকটা বকলম। কিন্তু মেকানিকের কাজ থেকে শুরু করে কাঠমিস্ত্রির কাজ- এসব টুকিটাকি কাজ করতে পারে নিখুঁতভাবে। সেই সূত্রেই আমার কাছে আসা। কাজ খুঁজছিলো। শ্বাসকষ্টের রোগী। শরীরে কুলায় না। তাই কেউ ভালো কাজ দিচ্ছিলো না। আমাদের সহকর্মী এক ডাক্তারের সুপারিশ নিয়ে আসে আমার কাছে। গাড়িগুলোর যত্ন নিতো, আঙিনাটা পরিষ্কার রাখতো, আর বাড়ির টুকিটাকি এটা সেটা সারানোর কাজ করতো। সেবার বাড়ির পেছনের জঙ্গলটা সাফ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রচ- শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। আমার অনুতাপ হতে লাগলো। এ রকম একটা অসুস্থ লোককে দিয়ে কাজ করাচ্ছি! মোটেও ঠিক হচ্ছে না। ভালো হওয়ার পরেই কথাটা পাড়লাম।
-কারেন্স, তুমি বরং কাজ ছেড়ে দাও। শরীরে কুলাবে না।
– কাজ না করলে চলবে কীভাবে ডাক্তার?
– স্যোসাল সিকিউরিটির জন্য দরখাস্ত করো। আমরা সাহায্য করবো। আর তোমার বউতো শেষ করে এনেছে পড়াশোনা। তাই না?
কারেন্স মাথা নিচু করে থাকলো অনেকক্ষণ।
– তুমি ঠিকই বলেছো ডাক্তার। বউও অনেকদিন ধরে এই উপদেশ দিচ্ছে। কারেন্স যখন কাজ করতো, দেখতাম ও এসে লাঞ্চ দিয়ে যায় নিয়মিত। মাসের শেষে বউটা আসতো আমার কাছে খাতা নিয়ে। কারেন্সের কাজের ঘণ্টার হিসাব। সেইমতো বেতন বুঝে নিতো। কারেন্স নিজে যে লেখাপড়া জানে না, তাতে মোটেও লজ্জা নেই। বরং বউকে নিয়েই গর্ব তার।
– জানো ডাক্তার। আমার বউ নার্সিং স্কুলে যাচ্ছে। আর কয়েকদিন। ও কাজ শুরু করলেই আমার আর কাজ করতে হবে না।
কারেন্সের চোখে যেনো স্বপ্ন উপচে পড়ছে।
একদিন পাশে এসে আমতা আমতা করতে লাগলো! বুঝলাম কিছু একটা বলবে।
– ডাক্তার। তোমার ওই পুরোনো টয়োটাটাতো পড়ে আছে গ্যারেজে। আমাকে দাও না, মাসখানেকের জন্য।
– কেন কী করবে ওটা দিয়ে?
– আমার মেয়েটা কলেজে যাওয়া শুরু করেছে। ওকে পুরোনো একটা গাড়ি কিনে দেবো বলে কথা দিয়েছিলাম। টাকা যোগাড় হয়ে উঠেনি এখনো। মাসখানেকের ভিতরে হয়ে যাবে আশা করি।
ওই গাড়িটা বেশ পুরোনো। তেমন কাজে আসে না। দীর্ঘদিন না চালানোর কারণে ঠিকঠাক আছে কিনা, কে জানে? সারাতে খরচ হবে। ফেলতেও খরচ হবে। তার চেয়ে নিক না। মেয়েটার কাজে আসবে।
– কারেন্স, গাড়িটা নিয়ে নাও। তবে শর্ত আছে। কথা দিতে হবে মেয়েটাকে পড়াশোনা শেষ করাবে। ক্লাসে না গেলে গাড়িটা ফেরত দিয়ে যাবে।
কারেন্স কথা রেখেছিলো। মেয়েটাও কথা শুনেছিলো। শেষ করেছিলো পড়াশোনা।
এই কারেন্সের জীবনটা এপালেচিয়ান জীবনসংগ্রামের বাস্তব উদাহরণ। সাত বছর বয়েস থেকে বাবার সঙ্গে কয়লার খনিতে কাজ শুরু করে। রোজ সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে বাবা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকতো। হুঁশ আসলেই নানান ছুঁতোয় ছেলেদের পেটাতো, যাকেই হাতের কাছে পায়। সাত ভাই পাঁচ বোন। কাউকে না কাউকে তো কাছে পেতোই।
– জানো ডাক্তার, আমার পিঠে এখনো মারের দাগ। খুব মার খেয়েছি ছোটবেলায়।
– আর তোমার মা কি করতো? মা’ও কি পেটাতো?
– না, মা ছিলো তার উল্টো। আমাদের আগলে রাখতো সব সময়। বাবার হাবভাব খারাপ দেখলে আমাদের বলতো পালিয়ে যা।
এই পালিয়ে বাঁচতে হলো শেষমেষ। সতের বছর বয়েসে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে কারেন্স। ততোদিনে সুঠামদেহী যুবক। কাজ পেতে অসুবিধা হলো না। আর যা হোক বাবার কাছে কাজ শিখেছে ভালো। কয়লা খনিতে কাজ করতে কাজ ভালো জানতো। ওই সময়েই কাকতালীয়ভাবে এলাকার এক ধনাঢ্য ব্যক্তির চোখে পড়ে সে। এলাকার কয়লার ব্যবসায় ভাটা শুরু হয়ে গেছে তখন। বড় বড় কোম্পানিগুলো একে একে হাত গুটিয়ে চলে যাচ্ছে। দুর্বল ব্যবসার খনিগুলো নিলামে তুলছে একের পর এক। এ রকমই একটা খনি নিলামে কিনে নেয় সেই ভদ্রলোক। কিন্তু খনির কাজের অভিজ্ঞতা নেই তার। অভিজ্ঞ লোক দরকার। পঞ্চাশ পার্সেন্ট শেয়ার দিয়ে কারেন্সকে পার্টনার হিসেবে নেয়ার প্রস্তাব দিলো সে। কারেন্স এখন ওই খনির দেখাশোনা করে। খনির ভিতরে শ্রমিকদের সঙ্গেই কাটে রাতদিন। খনির কাজ দ্রুত ভালো হতে লাগলো। সমস্যা দেখা দিলো অন্যত্র। কারেন্স এলিমেন্টারি স্কুলও শেষ করেনি। আদতে বকলম। হিসাবপত্র সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে।
এ সম্যসারও সমাধান হয়ে গেলো। খনিতে কাজ করার জন্য এসেছে একটা নতুন মেয়ে। তখনকার দিনে খনিতে মেয়েরা কাজ করতো না। অনেকেই আপত্তি করলো। কিন্তু কারো মানা না শুনে কারেন্স তাকে কাজ দিলো। মেয়েটা অংকে পটু। কারেন্সের নথিপত্র আর হিসাব-নিকাশ রাখা শুরু করে সে। সেই যে শুরু, এখনো তাই চলছে। মেয়েটার নাম লরেটা। এখন কারেন্সের বউ। কাজের সূত্রেই প্রেম। পরে বিয়ে।
তবে সুদিন বেশিদিন টিকলো না। খনির একটা অ্যাকসিডেন্টে কোমর ভেঙে কারেন্স বাড়িতে বসে থাকলো অনেকদিন। ব্যবসায় মার খেলো দারুণভাবে। খনি বন্ধ করে দিতে হলো। আবার রাস্তায়। আবার আগের মতো টুকিটাকি কাজ করে। কিন্তু এখন বউ আছে তার জীবনে। তাই জীবন আর অগোছালো নয়। লরেটা বাচ্চাগুলোকে মানুষ করতে লাগলো। নিজেও স্কুলে ভর্তি হলো। প্রথমে হাসপাতালের আয়ার কাজ। পরে ডিপ্লোমা নিলো নার্সের সহকারি হিসেবে। সব শেষে নার্সিং কলেজ।
সেদিন আমার অফিসে এসে দেখা করলো কারেন্স। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমার রোগী সে। কিন্তু আজ এসেছে শুধু দেখা করতে।
– ডাক্তার আমার বউ পাশ করেছে। এখন সে পুরোদস্তুর নার্স।
– সাবাস! আমাদের হাসপাতালে কিন্ত ভেকেন্সি আছে এখন। দরখাস্ত করতে বলো না?
– না ডাক্তার। ও তো নক্সভিল হাসপাতালে কাজ করছে। ওখানেই থেকে যাবে।
কারেন্সের চোখ চকচক করছে। আবেগে গলার স্বর কাঁপছে তার!
– আরো একটা সুখবর আছে। সেটা আরো বড় খবর।
– তাড়াতাড়ি বলো।
– আমার মেয়েটা আর্মিতে চান্স পেয়েছে। ছেলেটা তো আগেই গেছে নেভিতে। এখন আমি চিন্তামুক্ত!
– বাহ্! তোমারতো তাহলে সুদিন এখন। লরেটাকে নিয়ে সুখে কাটবে সময়। হাত টানাটানি থাকবে না আর।
– ঠিকই বলেছো ডাক্তার। তবে সুখটা বড্ডো দেরিতে আসলো। সুদিনের অপেক্ষায় বুড়োইতো হয়ে গেলাম।
কারেন্সের এই শেষ কথাটা কানে গেঁথে থাকলো দীর্ঘক্ষণ। পয়ষট্টি বছর বয়েস এখন। প্রথম জীবনে নিজে আর পরে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে সুখের সন্ধানে হেঁটেছে। অবশেষে সুখের দেখা মিলে তার। জানি, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সুখের সংজ্ঞা বদলায়। ভোগবাদী মার্কিন সমাজে এর প্রকট চিত্র দেখেছি। কিন্তু এও দেখেছি বিত্তহীনের জীবন সংগ্রামের চালচিত্রের কোন স্থান-কাল-পাত্র ভেদ নেই। কারেন্সের সঙ্গে কথা বলায় সময় কেন জানি হঠাৎ আমার নিজের গ্রামের চেহারা ভেসে উঠলো। মনে হলো তার এই সুখ-স্বপ্ন ঠিক আমাদের গ্রামের খেটে খাওয়া নিম্নবিত্তের স্বপ্নের মতো। বাংলাদেশের নিম্নমধ্যবিত্তের সুখ বলতে তো একটাই। পেট পুরো দুবেলা খাওয়া, আর ছেলেমেয়েদের উন্নতি। বকলম অশিক্ষিত কারেন্সের একটা মেয়ে নার্স, একটা মেয়ে আর একটা ছেলে মিলিটারিতে। এটুকু গর্বইতো তার সব সুখের উৎস। ছবি তুলতে বলায় লাফিয়ে উঠে প্রস্তুতি নেয়। বুক টান টান করে দাঁড়ায় আমার পাশে। পরে ওর বউ হাসতে হাসতে জানিয়েছিলো একটা মজার কথা।
– জানো ডাক্তার, বললে তোমার বিশ্বাস হবে না। সেদিন অতি গর্বে অতিরিক্ত সিনা টান করে দাঁড়িয়ে পরের কয়দিন পিঠের ব্যথায় কুঁকড়ে থেকেছে। প্রচুর মালিশ করতে হয়েছে আমার!
খ্যাতনামা চিকিৎসক ও মননশীল সাহিত্যিক, টেনেসি।