আমার রোগী বন্ধুরা: বাবার জন্য শোক

হুমায়ূন কবির

ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টের চার নম্বর রুম থেকে ডাক আসলো। কী ব্যাপার? অসুস্থ একজন রোগী ভীষণ হৈ চৈ করছে।
-কী অসুবিধা?
-খুব সম্ভব নিউমোনিয়া।
গিয়ে দেখি বেশ হৈ চৈ হচ্ছে। কিন্তু হৈ চৈ রোগীকে নিয়ে নয়; বিছানার বদলে রোগী বসে আছে চেয়ারে। আর বিছানায় দিব্যি বসে আছে একটা একচোখা কুকুর। কেউ রুমে ঢুকলেই ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসে। এক্সরে করতে এসে ফেরত গেছে টেকনিসিয়ান। রক্ত নেয়ার জন্য দরজার ফেবোটমিস্ট দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। লোকটা কুকুর শান্ত করতে ব্যস্ত। ভেতরে ঢুকতে পারছে না কেউ।
নার্সদের সঙ্গে কথা বলতেই সবাই একসঙ্গে বিরক্তি প্রকাশ শুরু করলো।
-এভাবে কি কাজ করা যায়?
-কেন কি হয়েছে?
সবাই মিলে দলবদ্ধভাবে বর্ণনা দিলো ঘটনার।
সাঁই করে একটা ট্রাক এসে থামলো ইমার্জেন্সির সামনে। থামার পরেই তার স্বরে হর্ন। মেয়েরা দৌড়ে গেলো। স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে বসা একটা লোক চিৎকার করছে আর বলছে, ‘আমাকে নামাও তাড়াতাড়ি’। নামাতে গিয়েই বিপত্তি। গাড়ির ভেতরে যাওয়া যাচ্ছে না দুর্গন্ধে। মলমূত্রের গন্ধ। একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে জানালা দিয়ে। লোকটাকে নামানো হলো টেনে হিঁচড়ে। হুইল চেয়ারে বসেই ঘোষণা দিলো কুকুর ছাড়া ভেতরে যাবে না সে। কুকুরটাও ধরা দেবে না। হাসপাতালের গার্ডদের ডাকা হলো। বেশ কসরত করে শেষে কুকুরটাকেও নামানো হলো।
এরপর থেকেই সমস্যা। কুকুর সামলাবে না রোগী সামলাবে। লোকটার মেজাজ তুঙ্গে উঠে আছে। সবাইকে অতিষ্ঠ করে মারছে। প্রথমেই বললো, সে খুব ক্ষুধার্ত আগে খাবার দিতে হবে। এরপর চাইলো কুকুরের জন্য খাবার। প্রাথমিক বিবেচনায় অনুমান করা হয়েছে লোকটার নিউমোনিয়া বা এই জাতীয় কিছু। হয়তো ভর্তি করতে হবে। কিন্তু তার ব্যবহারে সবাই ইতোমধ্যেই বিরক্ত। আসল কাজগুলো শুরুই করা যাচ্ছে না।
লোকটাকে দেখে ক্ষুধার্তই মনে হলো। আমি আশ্বস্ত করলাম তাকে।
-খাবার আনাচ্ছি। ততক্ষণে অন্তত এক্সরেটা করতে দাও। সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাজি হলো সে। এক্সরের পর খাবার আসলো। কুকুরটাকেও খাওয়ানো হলো। দেখলাম কুকুরটা একটু শান্ত হয়ে এসেছে। লোকটাও সংযত এখন। আলাপ শুরু করলাম।
বয়স তিয়াত্তর। একা থাকতো একটা বাড়িতে। পুরোনো বাড়ি প্রায় ধসে পড়ছিল। তাই বিক্রি করে দিয়ে নতুন ছোট একটা ট্রেইলরে উঠার পরিকল্পনা। বিক্রি করলো ঠিকই কিন্তু মন মতো ট্রেইলর পাচ্ছিলো না ওই দামে। তাই ভাবলো সপ্তাহ কয়েক সস্তা একটা হোটেলে থাকবে আর ট্রেইলর খুঁজবে। পিকআপ ট্রাকের পেছনে সামান্য যা মালপত্র তা তুলে হোটেলে গিয়ে উঠলো। দুর্ভাগ্য, এক সপ্তাহ পরেই তার বাড়ি বিক্রি করা সব টাকা চুরি হয়ে গেলো হোটেল থেকে। কে নিলো কোনো হদিস নেই। সবাই বললো, সে আগেই হারিয়ে ফেলেছে হয়তো। এখন হোটেলের ভাড়া পরিশোধেরও টাকা নেই। গতকাল বের হয়ে এসেছে হোটেল থেকে। রাতটা কাটিয়েছে গাড়িতে। কিছুই খায়নি। সে জন্যই মেজাজ তিরিক্ষি। কুকুরটারও একই অবস্থা।
কাহিনীটা শোনার পর লোকটার প্রতি মায়া হতে লাগলো। বয়সের কারণে সামান্য ডিমেনসিয়া তো আছেই। তার উপরে ক্ষুধা। সেই সঙ্গে টাকা-পয়সা হারিয়ে আরো উচাটন। নার্সরা তাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করলো। খাওয়া-দাওয়ার পর বেশ প্রসন্ন এখন। এক্সরেতে দেখা গেলো নিউমোনিয়া নেই। রক্ত পরীক্ষায়ও তেমন বড় কোনো সমস্যা নেই। একরাত অবজারভেশনে রাখার জন্য ভর্তি করা যায় কিন্তু লোকটা হাসপাতালে থাকতে চাইলো না।
তাহলে যাবে কোথায়? পাশের শহরেই এক জ্ঞাতি ভাই থাকে সেখানে গিয়ে উঠবে। পুলিশকে খবর দেয়া হলো। সবাই মিলে গাড়িতে তুলে দিলো তাকে। পুরোনো পিকআপ গাড়িটা কসরত করে স্টার্ট দিয়ে ভটভট করতে করতে বিদায় নিলো হাসপাতালের পার্কিং লট থেকে।
সপ্তাহ কয়েক পরেই খবরটা আসলো। শার্লির টেলিফোন।
-শুনেছো খবরটা?
-কী খবর?
-সেদিনের একচোখের কুকুরটার কথা মনে আছে? ওই যে ইমার্জেন্সি রুমে দেখেছিলে?
-হ্যাঁ মনে আছে। কী হয়েছে?
-আজ সকালে টিভির খবরে কুকুরটাকে আর লোকটাকে দেখিয়েছে।
-মানে? কিছু কি হয়েছে তার?
শার্লির কাছে বিশদ শোনা গেলো বিষয়টা।
লোকটা ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছিল। হয়তো টিকতে পারেনি। এরপর সত্যি সত্যিই অসুস্থ হয়ে পড়ে। অ্যাম্বুলেন্স ডাকলো। এখানকার নিয়ম হলো অ্যাম্বুলেন্স ডাকলে সবচেয়ে কাছের হাসপাতালেই নিয়ে যাওয়া হয়। তাই নিয়ে গেলো পাশের শহরের হাসপাতালে। সেই হাসপাতালে কুকুর নিয়ে ঢুকা নিষেধ। প্যারামেডিকসের লোকরা কুকুরটাকে পাঠিয়ে দিলো অ্যানিমেল শেল্টারে।
লোকটাকে ভর্তি করা হলো। চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে কিন্তু কথাবার্তা আর খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। শেষের দিকে দস্তুরমতো অনশন ধর্মঘট। নার্সদের একজনের মাথায় আসলো চিন্তাটা। সে শুনেছে লোকটা ‘বাবা বাবা’ করে কাঁদে মাঝে মাঝে। একটু খোঁজ করতেই বের হয়ে আসলো রহস্যটা। ‘বাবা’ হচ্ছে তার কুকুরের নাম। লোকটা তাহলে কুকুরের শোকে ভুগছে? এদেশে কুকুরপ্রেমীর অভাব নেই। অ্যানিমেল শেল্টারে গেলো একজন। জানা গেলো কুকুরটারও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। ওকে ইতোমধ্যেই ভেটেরেনারি ডাক্তার পরীক্ষা করেছে। তেমন কিছু পায়নি। এখন বুঝা গেলো কুকুটাওতো তার মনিবের শোকেই অসুস্থ। অ্যানিমেল রাইটিস্টরা সবাই দল বেঁধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ নিয়ে গেলো। ইতোমধ্যে খবরটা শহরের সাংবাদিকদেরও নজর কাড়ে। বিষয়টা বড় হয়ে যাচ্ছে দেখে হাসপাতাল বাধ্য হলো নিয়ম ভেঙে কুকুরটাকে ফিরিয়ে আনতে। আর এর পরেই লোকটার খাওয়া-দাওয়ার শুরু। কুকুরটাও সুস্থ হয়ে উঠে ধীরে ধীরে। টিভি স্টেশন থেকে ক্যামেরা এসে হাজির হয়েছিল কুকুর আর মনিবের মিলনের মুহূর্তটা ধরে রাখতে। সকালের খবরে ঘটা করে দেখানো হলো সেটা।
শার্লির আফসোস, খবরে আমাদের হাসপাতালের কথাটা একবারও উল্লেখ করলো না কেউ। পাশের শহরের ওই হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের হাসপাতালের একটা চাপা প্রতিযোগিতা কারো অজানা নয়। শার্লির কণ্ঠেও সেই উষ্মা!
-আমরাও যে লোকটা আর কুকুরটার সেবা শুশ্রƒষা করেছি কেউ তার খোঁজও নিলো না।
আমি টেলিফোনের ওই পাশে শার্লির চেহারাটা অনুমান করে হাসি থামাতে পারছিলাম না। একটা টিপ্পনি দিলাম।
-ঠিকই বলেছো শার্লি। তোমাদের টিভিতে যাওয়ার সুযোগটা নষ্ট করে দিলো ওই হাসপাতাল।
-আর সাংবাদিকরাই বা কেমন? একটু তলিয়ে দেখবে না?
কথা ঘুরানোর জন্য এবার অন্য কথা জিজ্ঞেস করলাম।
-কুকুরটার একটা চোখ কীভাবে নষ্ট হলো? জানো কি?
শার্লি হঠাৎ উৎসাহী হয়ে উঠলো।
-সেটা তো জিজ্ঞেস করিনি। খোঁজ নেবো না কি?
-না থাক। আর নিয়ে হবে কি? টিভিওয়ালারা তো আর আসবে না।
খ্যাতনামা চিকিৎসক ও মননশীল সাহিত্যিক, টেনেসি।