হুমায়ূন কবির
লোকটা একাই ঘুরে ঢুকলো। এসেই ঘোষণা দিলো গম্ভীর গলায়।
– দরজাটা খোলা রাখো ডাক্তার। আমার সঙ্গে আরো একজন আসবে। সেজন্য কিন্তু আলাদা চার্জ করো না।
লোকটার চেহারা সিরিয়াস। ভাবখানাও সিরিয়াস। আমিও সিরিয়াসভাবেই উত্তর দিলাম।
– মোটেও ঠিক বলনি। ডাবল চার্জ হবে তোমার। তিন গুণও হতে পারে যদি সঙ্গের জন মহিলা হয়।
– কেন?
– মহিলারা খুঁত খুঁতে। বেশি সময় নেয়। বেশি ডিস্টার্ব করে। তাই চার্জও বেশি।
আমরা দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলাম একসঙ্গে। কুশল বিনিময় করার পর চেয়ারে বসলো লোকটা। দরজায় তাকিয়ে দেখলাম গজর গজর করতে করতে ঘরে ঢুকছে ছিমছাম কাপড়পরা একজন মহিলা।
– বাহ! খুব তো বলা হলো সঙ্গে একজন আসবে। সাধে কি সঙ্গে আসে কেউ? আমাকে ছাড়া তো হবে না। তাই সঙ্গে আনতে বাধ্য হয়েছে।
এই বলে লোকটার দিকে একটা বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করা হলো। এরপর আমরা দিকে তাকিয়ে একটা হাসি। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমার নাম অনিটা। লোকটার পাশের চেয়ারে বসলো অনিটা। বসেই আবার কথার শুরু।
– বুঝলে ডাক্তার। কিচ্ছু মনে রাখতে পারে না। নিজের কথাটাও গুছিয়ে বলতে পারবে না। আর বাড়ি গিয়ে বানিয়ে বানিয়ে সব বলবে। ঠেকে শিখেছি। তাই একা ছাড়ি না কোথাও।
লোকটা সব কথার সায় দিলো নির্বিকারভাবে।
– একদম খাঁটি কথা।
আমি এ বিষয়ে অভ্যস্ত। প্রায়ই এরকম দেখি। বিশেষ করে বয়স্ক রোগীদের অনেকেই সমস্যার কথা নিজে বলে কম। তার সঙ্গীর কাছ থেকেই বর্ণনাটা আসে বেশি।
প্রথম দিন। তাই কুশলাদি আর পরিচয় পর্বটা দিয়েই শুরু।
– তোমাদের সম্পর্কটা বলবে?
লোকটা দ্রুত উত্তর দিলো।
– আমার এক্স।
মহিলাটি একটু গুছিয়ে উত্তর দিলো।
– বলতে পারো কমপেনিয়ন। আমরা এক সঙ্গেই থাকি। আমি তার দেখাশোনা করি।
লোকটা আমতা আমতা করে সামান্য যোগ করলো।
– সেটা ঠিক। উই লিভ টুগেদার। বাট উই আর ইন লাভ টু।
এটাতেও আমরা খুব অভ্যস্ত। লিভ টুগেদার তো এদেশে খুবই প্রচলিত। প্রাক্তন স্বামী-স্ত্রী বুড়ো বয়সে এক বাড়িতে এক সঙ্গে শেষ দিনগুলো পার করছে, সেটা হরহামেশা দেখি। কথা না বাড়িয়ে সরাসরি স্বাস্থ্য সমস্যার প্রসঙ্গে চলে গেলাম।
সব শেষ হওয়ার পরে মহিলা আবার হাত বাড়িয়ে দিলো।
– তোমার রিসেপসনিস্ট বলেছে তোমার লেখালেখির কথা। আমাদের কাহিনিটা কিন্তু মজাদার। তোমার লেখার জন্য মানানসই। সামনের বার আসলে বলবো।
আমি অবাকই হলাম। এভাবে যেঁচে নিজের গল্প শুনাতে চায়নি কেউ।
– অবশ্যই! অবশ্যই। সামনের বার মনে কওে বলো কিন্তু!
তাড়া ছিলো সেদিন। তাই আর দেরি করতে চাইনি।
পরের ভিজিটে আসলো। আবারো দু জন। এবার সবগুলো টেস্ট রেজাল্ট রিভিউ করা হবে। আলোচনা করা হবে। চিকিৎসা পরিকল্পনাটা ঠিক করা হবে। তারপর ওষুধপত্র লেখা হবে। সময় দরকার। তাই আর অন্য কথায় যাইনি।
মহিলাই ঠাট্টা করে মনে করিয়ে দিলো।
– ডাক্তার। তোমার পারমিশন স্লিপে দস্তখত দেবো। ওর জন্য টাকা পয়সা দিবে নাকি কিছু?
– ওটা মুফত। ওই স্লিপেই লেখা আছে। ভালো করে পড়েই তবে দস্তখত দিও। আর তোমার কাহিনীটাও তো শুনা হয়নি। আজ কি সময় হবে? না কি পরের দিনের জন্য উঠিয়ে রাখবো?
– কাহিনী তো প্রত্যেক ভিজিটেই একটু একটু করে শুনবে। আজ একটু শুরু করে যাই।
এই শুরুটাই চমকপ্রদ। মজার কাহিনীই বটে। মহিলা বলে যাচ্ছেন, আমি মন দিয়ে শুনছি আর নোট নিচ্ছি। মাঝে মাঝে লোকটা একটু উসখুস করছে। এক সময় উঠে দাঁড়ালো। স্পষ্ট বুঝলাম বিদায় নিতে চাচ্ছে। মহিলা আমাকে আশ্বস্ত করলো।
– ওর কোমরের ব্যথা। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। একটু পর পর দাঁড়াতে হয়। আমার মনে হলো ঠিক বলেনি কথাটা।
– আজ তাহলে থাক। পরের ভিজিটে আরো কিছু শুনা যাবে।
শুনেই লোকটা হ্যান্ডশ্যাক করে রওয়ানা দিলো দরজার দিকে।
মহিলাটা হই হই করে উঠলো।
– যাচ্ছো কোথায়? তোমার প্রেসক্রিপশন তো নেবে আগে?
আমি দেখলাম প্রেসক্রিপশনের ডুপ্লিকেট কপিটা চার্টে লাগানো আছে। তার মানে প্রেসক্রিপশন ওর হাতে দিয়েছি।
– প্রেসক্রিপশন দিয়েছি ওর হাতে।
লোকটা বুক পকেট খুঁজলো কিছুক্ষণ। পাচ্ছে না। মুখ কাচুমাচু।
– না ডাক্তার। দাওনি। কারণ আমাকে দিলে তো আমি নেবো না। ওকেই সমঝে দেবো।
মহিলাটি উঠে দাঁড়ালো।
– না টম। তুমি আমাকে দাওনি। বুক পকেটে না, প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত দাও। সেখানেই রাখো তুমি কাগজপত্র।
পেছনের পকেটেই পাওয়া গেলো প্রেসক্রিপশনটা। খুবই মলিন একটা লাজুক হাসি দিলো লোকটা। আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো অপরাধী ভাব নিয়ে।
– বুঝছো তো এবার? কেন নিয়ে আসি সঙ্গে ওকে?
মহিলাটাও ঝংকার দিয়ে উঠলো।
– নিয়ে আসি বলো না। বলো কেন সঙ্গে আসে ও।
এই টম আর অনিটার গল্পটা বলার মতোই। টম আমার রোগী। কিন্তু গল্পটা অনিটার জবানিতে। টম বসে বসে শুনেছে। আর মুচকি হেসে মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে সায় দিয়েছে।
অনিটার জন্ম মিশিগানে। আট বছর বয়সে বাবা মারা যায়। মা চলে আসে কেন্টাকিতে। নিজের বাপের বাড়ি। এখানে এসেই মার পরিচয় হয় ববের সঙ্গে। কিছুদিন ডেট করার পরেই বিয়ে। ববের ছোট ভাই টম। বয়স তখন বিশ। অনিটার বয়স দশ।
– বুঝলে ডাক্তার। ওটা ছিলো বাল্যপ্রেম। মা তার নতুন স্বামীকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সারাক্ষণ। আমার দিকে তেমন নজর দেয়ার ফুরসত ছিলো না। আমার দেখাশোনা করতো টম। বাইরে নিয়ে যেতো। সার্কাসে। খেলার মাঠে। আইসক্রিম পার্লারে এইভাবে ওর সঙ্গে ঘেঁষেই আমার শৈশব।
– তোমাদের বয়সের তো বেশ ফারাক। ভালোবাসাবাসিটা শুরু হলো কখন?
– কখন যে শুরু হয়েছে ধরতে পারিনি। তবে হাই স্কুলে যাওয়ার পরেই আকর্ষণটা বুঝতে পারি। টমকে বলায় সে খুব অবাক হয়েছিলো। রাজি হয়নি। কিন্তু আমিই আকড়ে ধরি। ছুটতে দিইনি।
– বিয়ে হলো কখন?
– আমার ষোল। আর টমের ছাব্বিশ। পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। মা রাজি ছিলেন না।
– তারপর?
– তারপর আর কি? বিয়ে করে সংসারি হলাম। একটা ছেলেও হলো। কিন্তু বেশি দিন টিকতে পারলাম না।
– মানে?
– মানে, আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো।
– বলো কি? এভাবে ভালোবেসে বিয়ে করলে, আর কয়েক বছরেই ছাড়াছাড়ি!
– হ্যাঁ। তাই হয়েছে।
– এরপর কি হলো?
– টম আর বিয়ে করেনি। একাই থাকলো। আর আমি চলে গেলাম ফ্লোরিডা। ওখানে গিয়ে স্কুলে মাস্টারি শুরু করলাম। বছর কয়েক পরে আবারো প্রেমে পড়লাম।
– তাই নাকি?
– হ্যাঁ। এবার আরো বয়স্ক
একজন। আমার চেয়ে প্রায় তিরিশ বছর বড়। তখন অলরেডি রিটায়ার্ড।
– আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
– লোকটাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। কিন্তু বেশিদিন বাঁচলো না।
অনিটার মুখে গভীর বিষাদ।
– আশ্চর্যের কথা কি জানো ডাক্তার? আমার ছেলে আর স্বামী এক মাসেই মারা গেলো। ছেলেটা অ্যাক্সিডেন্ট করে আর লোকটা হার্ট এ্যাটাকে। আমার আর কেউ থাকলো না।
অনিটার গলা ভারী হয়ে এসেছে। চোখে জল আসেনি এখনো। তবে ন্যাপকিনটা হাতে নিয়ে রাখলো। ভাবলাম প্রসঙ্গটার পরিবর্তন দরকার।
– টমের কাছে ফিরে আসলে কখন?
– ওরা মারা যাওয়ার পর ফ্লোরিডায় দম বন্ধ হয়ে আসতো আমার। তাই আবার ফিরে আসলাম কেন্টাকিতে। এসে দেখলাম টম অসুস্থ হয়ে বিছানায়। তাকে দেখার কেউ নেই। কি আর করা। আমিই দেখভালের দায়িত্বটা নিয়ে নিলাম। কিছু একটা করে তো সময় কাটাতে হবে!
– আর টম রাজি হলো?
এবার টম একটু উৎসাহ সহকারেই আলোচনায় ঢুকলো।
– রাজি হবো না কেন? আমি তো ওকে ভালোবাসি। আগেও বেসেছি। এখনো বাসি।
– ওটা বলো না টম। আমাদের কোন লাভ রিলেশন নেই এখন। উই আর জাস্ট কমপেনিয়ন।
– ঠিক আছে, ঠিক আছে। ওভাবে বলতে চাইলে বলো। তবে আমরা তো একজন আরেকজনকে পছন্দ করি? সেটা তো সত্য। না কি?
আমার মনে হলো এই তর্কে জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না। গল্পের উপাদান তো যথেষ্টই পেয়ে গেছি। বাইরে অনেক রোগী। এবার সমাপ্তি টানতে হবে আজকের জন্য।
বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম অনিটা টমের হাত ধরলো। বয়সের ফারাক থাকলেও দেখতে একই বয়সি মনে হচ্ছে আমার কাছে। আর স্বামী-স্ত্রী না হলেও ভালোবাসার বন্ধনটা স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে। পৃথিবীতে কতো অদ্ভুত সব গল্পের কাহিনী।
খ্যাতনামা চিকিৎসক ও মননশীর সাহিত্যিক, টেনেসি।