হুমায়ূন কবির
এই লোকটিকে চেনে না এমন মানুষ শহরে কম। সারাক্ষণ সাইকেল নিয়ে ঘুরবে। পেছনে ব্যাকপ্যাক। সবসময় একই রংয়ের টি-সার্ট। আমার এখানে পাঠিয়েছিল তার ডাক্তার ঘুমের সমস্যা আর রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম নিয়ে। ওগুলো এখন নিয়ন্ত্রণে। বছরে একবার করে আসতে বলেছি। কিন্তু তাতে কি? মাস কয়েক পরে পরেই নানা উছিলায় এসে হাজির হয়। ওর ভিজিট শুরু হয় জোকস দিয়ে।
-ডাক্তার, তোমাকে নতুন একটা জোকস শুনাবো। হাসবে কিন্তু। না হাসলে জোকস বলে সুখ নেই।
জোকসগুলো প্রায়ই বাচ্চাদের বিষয়ে। হাসার কিছু পাই না। তবুও হাসি।
-ডাক্তার, তোমাকে এজন্যই আমার পছন্দ। তুমি জোকস বুঝ। ডরোথি আমাকে বলে, জোকস বুঝতেও বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। সবার সেই বুদ্ধি নেই।
জানি এরপরই ডরোথির কথা শুরু হবে। তাই তাড়াতাড়ি রোগের প্রসঙ্গে কথা শুরু করি।
বয়স চল্লিশের ওপরে। কিন্তু বাচ্চাদের মতো ব্যবহার। প্রথমে বুঝতে পারিনি। একদিন ভিজিট শেষ করে চলে যাওয়ার সময় আবার ফিরে এসে কথা শুরু করলো খানিক আমতা আমতা করে।
-ডাক্তার তোমার ছেলে-মেয়েরা তা বড় হয়ে গেছে। তাই না?
-হ্যাঁ। কলেজে যায়। কেন?
-ওদের লেখাগুলো কি ফেলে দিয়েছো? না এখনো আছে?
অবাক হলাম ওর প্রশ্নে।
-বুঝলাম না। একটু ভেঙে বলবে কি?
-এই মানে, আমি লেগোগুলো কালেক্ট করি। তাই ভাবলাম তোমাকে জিজ্ঞেস করি। থাকলে আমাকে দিও। খুব খুশি হবো।
-লেগো কালেক্ট করো? বাহ! বেশ সুন্দর শখ তো।
প্রশংসা শুনে খুব সুন্দর একটা হাসি দিলো। তারপর মাথা চুলকাতে লাগলো।
-আসলে আমি লেগো দিয়ে খেলি এখনো। আর জানো, অনেক পুরোনো দিনের লেগো আছে আমার কাছে। দেখবে নাকি? আমার ব্যাগেই আছে একটা।
এই বলে সত্যি সত্যি ব্যাগ থেকে বের করে দেখালো একটা খেলনা। লেগো দিয়ে তৈরি খেলনা। বিশদ বর্ণনাও শুরু করলো। এই লেগোটার ওপর গত পনের বছর কাজ চলছে তার। ভাঙাগড়া চলছে অনবরত। যুতসই নতুন একটা পেলেই এনে লাগায়। লেগোর কথায় মুখটা তার উজ্জ্বল। ছবি তোলার কথা শুনে আরো খুশি।
-সমস্যাটা হলো কি জানো? সব সময় জোড় দরকার। একটা পেলে জমিয়ে রেখে দিই। পরে আরেকটা পেলে তবে লাগাই।
আমি চুপ করে শুনছি তার কথা। আর ভাবছি। বাচ্চাদের দেখেছি লেগো নিয়ে খেলতে। কিন্তু এই বয়েসের একজন এতো উচ্ছ্বল হয়ে উঠবে লেগোর কথায় সেটা না দেখলে বুঝতাম না।
-এই দেখো। বিড়াল দুটো দুই রংয়ের ছিলো। তাই লাগাতে পারিনি। লাগাবার বড়ই শখ ছিলো। ডরোথি বুদ্ধি দিলো দুটোকেই সাদা রং করে ফেলো। তাই করলাম। এখন দেখো, কি মানিয়ে গেছে। ডরোথির বুদ্ধি আছে। ঠিক কিনা?
-ঠিক। অবশ্যই ঠিক।
এই ডরোথিটা কে জানার আগ্রহ হলো। কিন্তু কিছুতেই ওই কথায় নেয়া গেলো না। শুধু লেগো নিয়েই কথা বলে চললো। পরে এ্যামিলির কাছে জানলাম ডরোথি ওর বোন। নিজের কোনো বান্ধবি নেই। বোনটার ওপরেই নির্ভর করে ও। কাজ শেষে প্রতিদিনই বোনের কাছে গিয়ে হাজির হয়। শলাপরামর্শের জন্য বোনটাই ভরসা। বোন তার স্বামী নিয়ে আলাদা থাকে। একটা দোকানে কাজ করে। আর সরকারি ভর্তুকি দেয়া হাউজিং প্রজেক্টের একটা অ্যাটার্টমেন্টে থাকে।
-নিজের কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিলো না কোনো দিন?
-ছিলো একবার। মাস কয়েক পরেই ছুটে যায়। খাপ খাওয়াতে পারেনি। এই বাচ্চা মনের একজনের সঙ্গে কোনো মেয়ে থাকবে।
এ্যামিলি হয়তো ঠিক কথাই বলেছে। শিশুদের ভালোবাসা সহজ। কিন্তু শিশু মনের কারো সঙ্গে কি ঘর করা যায়?
খ্যাতনামা চিকিৎসক ও মননশীল সাহিত্যিক, টেনেসি।