আমার সংগ্রামী মা

জীবন-ভেলার ওবেলা ও এবেলা :

ডা. মেহবুব হোসেন

‘মা’- কত ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্তু কত মধুর আর সুবৃহৎ তার পরিধি! অকৃত্রিম মায়া-মমতা, অফুরান আদর-দয়া-দোয়া, নিঃস্বার্থ স্নেহ-ভালোবাসা- কত শত গুণের সম্ভার মিলেমিশে একাকার এই মায়ের মধ্যে। কি এক অনন্যসাধারণ সৃষ্টি এই মায়ের কূল আর মায়ের কোল! গর্ভধারণ থেকে কবর-গমন পর্যন্ত মায়েরা সর্বদাই সন্তান-প্রদত্ত সব কষ্ট আর যাতনা, ব্যথা আর বেদনা নীরবে-নিভৃতে কিংবা হাসিমুখে সহ্য করে থাকেন। সব মায়েরাই ইউনিক; একেকজন মা একমাত্র নিজেই নিজের তুলনা।

আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখি- মা দিবসে কিংবা মায়ের জন্মদিনে অথবা প্রাত্যহিক দিবসে- মাকে জড়িয়ে ধরে, মার পায়ের কাছে বসে অথবা মায়ের হাত মাথায় নিয়ে- কতজনে কতশত পোস্ট দিচ্ছে! কত সাবলীলভাবে মায়ের প্রতি তাদের মাতৃভক্তি, সুগভীর ভালোবাসা আর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা জাহির করছে! লাইক, লাভ আর কমেন্টের বানের তোড়ে এসব পোস্ট প্রবল বেগে ভেসে যাচ্ছে! মায়ের প্রতি তাদের কি প্রচন্ড টান আর মমতা! আর ওরকম আদুরে ছবি তো দূরের কথা; ফেসবুক পেজ-এ মায়ের সাথে আমার কোনোধরনের কোনো ছবিই নেই। মুখচোরা আমি, ভাষায় বা অভিব্যক্তিতে, আবেগ প্রকাশে চিরকাল চরমভাবে ব্যর্থ। তাই মুখফুটে আজ-অব্দি সামনাসামনি কোনদিন বলতে বা জানাতে পারিনি, মা-কে নিয়ে আমার কি রকম অনুভূতি! আমার মাও বোধহয় জানেন না, আমি তাকে নিয়ে কতটুকু ভাবি বা ভালোবাসি। নিচের কথাগুলো নিজের মাকে নিয়ে আমার সেই অপ্রকাশিত একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনা আর অনুভূতি, অভিজ্ঞতা আর অভিব্যক্তি প্রকাশের একটুখানি প্রয়াস- যার পুরোটাই জীবন থেকে নেয়া।

মাগো, এই সুদূর প্রবাসে তুলনামূলক অনেক সুখে থাকলেও, আপনার সেই তীব্র কষ্টময় কঠিন দিনগুলোর কথা কিন্তু আজও ভুলে যাইনি। আর বুকের ভিতর অনেক কষ্ট আর বেদনা জমে রয়েছে। আমাদের পুরো পরিবারের চাহিদা মিটাতে গিয়ে আপনাকে কতইনা যাতনা সহ্য, কষ্টভোগ আর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে! আপনার কথা লিখতে বসে, মনে পড়ছে পুরোনো সেই দিনগুলোর কথা- বড়-ছোট-ক্ষুদ্র কত শত কষ্টের কথা।
আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল প্রায় বালিকা-বেলায়; তিনি তার শ্বশুরবাড়ির মেজো পুত্রবধূ। আমাদের দেশীয় কালচারে, মেজো পুত্রবধূর উপর দিয়ে সাংসারিক ঝড়-ঝাপ্টা আর ধকল অনেক ক্ষেত্রেই বোধহয় একটু বেশিই যায়। আমার মাও সংসার চক্রজালের সেই জটিলতায় আটকা পড়েছিলেন।
ছোটবেলায় জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখে এসেছি, এক ছাদের নিচে আমাদের বিশাল এক যৌথ পরিবার। বড়চাচা, ছোটচাচা আর আমার বাবার পরিবার মিলে মোট তিন সংসার-এর সদস্যবৃন্দ, সাথে দাদা-দাদি ও একমাত্র ফুপু (তখনও বিয়ে হয়নি) হলেন এই যৌথ পরিবারের মূল মেম্বার। আর এই সংসার রাজ্যের অর্থমন্ত্রী হলেন আমার বাবা। আমাদের ছিল ‘আনোয়ার ব্রাদার্স’ (আমার বাবার নামে ) নামক একাধিক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। আর ছিল ফ্যাক্টরি, সাথে কমপক্ষে এক ডজন কর্মচারি। আমাদের যৌথ সংসারে প্রায়ই যোগ হতো গ্রাম থেকে আসা আত্মীয়-স্বজন, যারা নানা উদ্দেশ্যে শহরে এসে আমাদের এখানে কিছুদিন অবস্থান করে যেতেন। এর বাইরেও প্রতিদিন সন্ধ্যায় জড়ো হতো মহল্লার কিছু পরিচিতজন, যারা আসতো আমাদের এখানে টিভি-অনুষ্ঠান দেখতে (তখন হাতেগোনা কিছু বাড়িতে টিভি ছিল)। এইরকম রমরমা আর জমজমাট ছিল আমাদের যৌথ পরিবার। তবে এর অন্তর্নিহিত সমস্যারও অন্ত ছিল না!
বিরাটকায় এই সংসারের এতগুলো মানুষের জন্য প্রতিবেলা রান্না হতো এক কিচেনে। বোঝার বয়স হবার পর থেকেই দেখে এসেছি, দুইজন বেতনভোগী বুয়ার পাশাপাশি আমার মা হলেন আমাদের সুবিশাল যৌথ পরিবারের একজন বিনা বেতনের দাসী, যার উপর ন্যস্ত সংসারের গুরুভাগ দায়িত্ত্ব! মাকে সবসময়েই দেখেছি, নিজের সংসারের আর আত্মীয়-স্বজনের সৃষ্ট কোনো না কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে থাকতে। আর এত দায়িত্ব পালনের পরেও, কেন জানি আমার দাদির চক্ষুশূল ছিলেন আমার মা; সাথে বোধহয় আমরা- তার মেঝো ছেলের সন্তানেরাও।
আবছা হলেও মনে পড়ছে, মাঝে-মধ্যে দাদি কর্তৃক মার সাথে দুর্ব্যবহার আর মাকে অভিসম্পাত করার কথা। শারীরিক পরিশ্রম আর মানসিক নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে- সবাইকে চমকে দিয়ে- মা একদিন বিদ্রোহ করে বসলেন! মার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে, দাদি রান্নাবান্নাসহ সংসারের কাজকর্মের দায়িত্ব তার বৌদের মাঝে সমভাবে বন্টন করে দিতে বাধ্য হলেন। অন্যদিকে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসাবে, মার বিরুদ্ধে বড়োসড়ো একটা বিরোধীদল দাঁড়িয়ে গেলো! মার প্রতি দাদির গঞ্জনা আর আমাদের প্রতি সবার অবহেলা বেশ খানিকটা বেড়েও গেলো।

দিন যেতে লাগল। সময়ের সাথে সাথে আমাদের যৌথ পরিবারের সাইজ বৃদ্ধি পেতে থাকল; সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল সব ধরণের খরচ। আর ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকলো সংসারের অর্থনীতি। আমি তখন ‘নারায়ণগঞ্জ শিশুবাগ কিন্ডারগার্টেন’-এ ক্লাস ফাইভে পড়ি। মনে আছে, একদিন মা বললেন, তোমার গলার চেইন আর হাতের আংটিটা খুলে দাও। দেখলাম সবার স্বর্ণের গহনা জড়ো করে আমার বাবা নিয়ে গেলেন। পরে জানলাম, বিশাল অংকের ব্যাংক লোন শোধ করতে গিয়ে, সংসারের সবার সব গহনার বেশিরভাগ বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। তখনও বুঝিনি, আমরা গরিব হয়ে যাচ্ছি। আর আমার মায়ের আরো দুর্দশাময় দিন ঘনিয়ে আসছে। এরই মধ্যে ফুফুর বিয়ে হয়ে গেল। দাদাও প্রয়াত হলেন। কিছুদিনের মধ্যে বিক্রমপুরে আমাদের গ্রামীণ সম্পত্তির সিংহভাগই বিক্রি হয়ে গেল। এদিকে আমাদের যৌথ পরিবারের ফাটলটাও প্রকাশ্যে দৃশ্যমান হয়ে পড়ল; সেটা দ্রুত বাড়তেও থাকল।

ক্লাস এইটে পড়াকালীন, বাবার ব্যবসা মোটামুটি ফেল করল! বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসায়িক ধার বাড়তে লাগল; আর ঋণের পরিমাণটা চক্রবৃদ্ধিতে ফাঁসতে থাকল। এরই মধ্যে সংসারের সর্বশেষ বটগাছ- আমার দাদি- পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। পূর্বসৃষ্ট ফাটলটা বৃহৎ ও গভীর হয়ে যৌথ পারিবারিক বন্ধনে পূর্ণ ভাঙন ধরিয়ে দিল। স্পষ্ট দেখলাম, আমার মা-বাবা সংসারের অন্যদের শত্রু হয়ে গেলেন। তাদের ধারণা, এই দুজন সংসারের টাকা-পয়সা মেরে তলে তলে অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছে! আগুনে ঘি পড়ল, যখন সংসারের ছোট বৌয়ের প্রভাবশালী বাবা ভুয়া সংবাদ পরিবেশন করলেন : আমার মাকে তিনি দেখেছেন, চাষাঢ়া না চাঁনমারীতে জায়গা কিনতে মাপামাপি করতে! আমাদের পরিবারের প্রতি বিরোধী দলের বিরূপ ব্যবহার চরম আকার ধারণ করল। এতো কিছুর পরেও আমার বাবা তার ভাইবোনদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে বা করতে রাজি হলেন না! সবকিছু একদিন মার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। একসময়ের অতি নীরব আমার মা বাধ্য হয়ে সরব হলেন; বাবার প্রক্সি হিসাবে নিজেই সাফ জানিয়ে জানিয়ে দিলেন, এই সংসারে আর থাকা সম্ভব নয়। ফলাফল, আমার বাবার বাকি তিন ভাইবোন এক হয়ে গেলেন; এমন কি তাদের একজন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় (ব্যবসায়ের লাইসেন্স প্রদানকারী) আমার বাবার বিরুদ্ধে ব্যবসায়িক জালিয়াতির অভিযোগ দাখিল করলেন। বলাই বাহুল্য, আমার মা তাদের দৃষ্টিতে ভয়ংকর ভিলেন হিসাবে চিহ্নিত ও তাদের মাধ্যমে অন্যদের কাছে চিত্রিত হলেন।

আশ্চর্য আমার বাবা; এত কিছুর পরও, নিজ পরিবারের চাইতে নিজের ভাইবোনদের প্রতি তার কেন যেনো বেশি বেশি টান! এমন কি আমার মাকে সবার সাথে মিটমাট করে নিতে বললেন। ভাইবোনদের সাথে লড়াই করে, আমার বাবা, নিজের ন্যায্য পাওনাটুকু বুঝে নিতে একেবারেই রাজি হচ্ছিলেন না! মা ও আমাদের বড় তিনজনের (বড়, তবে তখনো স্কুলপড়ুয়া) মনোভাব ছিল অনড়। অবশেষে আমাদের সংসার, সম্পদ ও সম্পত্তি ভাগ হয়ে গেল, এবং অবশ্যই বঞ্চনামূলকভাবে। ফুফু (এক রাজনৈতিক নেত্রী) আর চাচার (সরকারের একজন ক্যাডার-কর্মকর্তা) পক্ষের প্রভাবশালীদের সাথে আমার অতিসাধারণ বাবা একদমই সুবিধা করে উঠতে পারলেন না! একচোখা ভাগ-বাটোয়ারা শেষে আমাদের সাকুল্যে প্রাপ্তি হলো- ব্যবসার ছোট্ট একটা অংশ; সাথে বোনাস হিসেবে বড় অংকের ঋণের বোঝা!

যৌথ পরিবার ভেঙে বেরিয়ে এসে, ঋণের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে আমার মা-বাবা যেন পড়লেন শীতলক্ষ্যা থেকে বঙ্গোপসাগরে; কেননা পুঁজির অভাবে ব্যবসায়ের পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে লাগল। আমরা আসলে তখন সংসার-সমুদ্রে চরম হাবুডুবু খাওয়া শুরু করলাম। বাবার ব্যবসায়ে অবনতি চলতেই থাকল; আর চারদিকে সুদে ও বিনাসুদে নেয়া ঋণের বোঝা বাড়তেই লাগল। দেখতাম, আমাদের ছয় ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ জোগাতেও বাবা প্রচন্ড হিমশিম খাচ্ছেন। বাবার কঠিন চেষ্টা সত্ত্বেও, লাভের গুড় ঋণে চেঁটেপুটে খেয়ে যেতে থাকল!

এই সময়টা আমার মা-র জীবনে একটা টার্নিং পয়েন্ট, সংসার চালাতে স্বল্পশিক্ষিত মাকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে পথে নামতে হল। চিরকাল ঘরবন্দী মা ঘর ছেড়ে বের হওয়া শুরু করলেন; ছোট বাচ্চাদের আরবি পড়ানো আর সেলাইয়ের কাজ শুরু করলেন। পয়সা বাঁচাতে, দূর-দূরান্তের পথও আমার মা হেঁটে চলাচল করতেন। এ রকম বিন্দু বিন্দু প্রচেষ্টায় তিনি নিজ সংসারের আর্থিক হাল ধরে রাখার কঠিন প্রচেষ্টায় ব্রতী হলেন। আর বোনেরা সেলাইয়ের কাজে মাকে সহায়তা শুরু করল। অন্যদিকে, অনেক চেষ্টা করেও বাবা তার ব্যবসায়িক ধ্বসে বাঁধ দিতে পারলেন না। সত্যি বলতে, সেই সময়টা ছিল আমাদের জন্য চরম সংকটকাল। এমন কি আমাদের দৈনন্দিন খাবারেও সংকট দেখা দিল। মা আমি কিন্তু ভুলে যাইনি, আপনি কিভাবে সাইজটা বড় করতে, একটামাত্র ডিম ভাতের সাথে মিশিয়ে ভেঁজেছেন এবং ভাগ করে ছয় সন্তানকে দিয়েছেন! আর নিজে একটুখানি পান্তা ভাত কাঁচা মরিচ দিয়ে খেয়ে নিয়েছেন। এখন আফসোস হয়, কেন যে তখন মাংস বা ডিম না থাকায়, অনেক সময় রাগ করে ভাত না খেয়ে উঠে গিয়েছি! এভাবে আপনাকে কত যে কষ্ট দিয়েছি! মা, বিশ্বাস করেন, সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে, এখনো বুকের ভিতর তীব্র যাতনা মোচড় দিয়ে ওঠে।

উপায়ন্তর না দেখে, সদ্য স্কুলের গন্ডী পেরোনো বড় বোনকে অবেলায় বিয়ে দিয়ে দেয়া হল। আমার বাবা, যিনি লাখ লাখ টাকা লেনদেনে অভ্যস্ত, টাকার থলি শূন্য হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে একদম মিইয়ে যাওয়া শুরু করলেন। অন্যদিকে মা দ্রুতই সংসারের মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠলেন। বাবার ব্যবসায় টাকা লাগবে; মা আছে না! আমাদের কারো কিছু কিনতে হবে; মা আছে না! মা তার নিজের ভাই-বান্ধবী, আত্মীয়-স্বজনের আর কিছু সমিতির কাছ থেকে ধার নেওয়া ও শোধের চক্র শুরু করলেন। সংসারের প্রধান চালিকাশক্তি এখন আসলে মা। আমরা ভাইবোনেরা, বাবার কাছে সাধারণতঃ সরাসরি কিছু চাইতে বা খোলাখুলি কিছু বলতে পারতাম না। আমাদের সব আদর-আবদার-চাহিদা বা চাওয়া-পাওয়ার সরাসরি ঠিকানা- মা। আবার শাসনের উদ্দেশ্যে আমাদের পিঠে দু’চারটা ঘা পড়েছে, সেটারও দাতাও আমাদের মা!

এত সমস্যার মাঝেও, ক্লাস নাইনে উঠে, আমি স্কুলের দুই স্যার-এর কাছে ব্যাচে পড়তে শুরু করলাম। প্রয়োজনের তুলনায় আমার জুনিয়র বৃত্তিতে প্রাপ্ত মাসিক ১২৫ টাকা ছিল বেশ অপর্যাপ্ত। অবশিষ্ট যা লাগত, সবটাই মা-ই আমাকে প্রতিমাসে যোগান দিতেন। কিভাবে দিতেন, সেটা তখন তেমন করে ভাবিনি। আর্থিক সমস্যার কারণে, কয়েক মাস পরে আমি খন্দকার (আমিনুল হক) স্যারের কাছে ব্যাচে পড়া বাদ দিলাম। আমার বড় দুই বোনের সাথে আলাপ করে, মা বললেন : তুমি নুরুল আমিন স্যারের কাছে পড়াটা চালিয়ে যাও; টাকার ব্যবস্থা আমি করছি। এবং এসএসসি পর্যন্ত সেই অর্থের যোগান মোটামুটি নিয়মিতই ঘটে এসেছে!

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, আমরা অতি সযতনে আমাদের বিপর্যস্ত বাস্তব অবস্থা বাইরের লোকদের কাছে আড়াল করার চেষ্টা করেছি। সক্ষমও হয়েছি। নিশ্চয়ই আমরা সংসার নামের থিয়েটারের ভাল অভিনেতা ছিলাম! আমরা ভাইবোনেরা স্কুলের বার্ষিক পিকনিক বা অন্য কোন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ পারতপক্ষে কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছি! অতি ঘনিষ্টজন ব্যতীত বাইরের তেমন কেউ, এমন কি আমাদের কাছের বন্ধুরা কিংবা বোনদের কাছের বান্ধবীরা- কেউ কোনদিন বিন্দুমাত্র টের পায়নি আমরা কি রকম সংকটের মাঝ দিয়ে সময় পাড়ি দিচ্ছি; কিভাবে জোড়াতালি দিয়ে চলছে আমাদের সংসার! শত কষ্টের মাঝেও মা চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন, তার পক্ষে সম্ভবপর সবকিছু ম্যানেজ করে নিতে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। তখন নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি। ‘র’ আদ্যাক্ষরের এক স্কুল-বন্ধু একদিন বাসায় এসে বললো : সপ্তাহ দু’য়েকের জন্য একশত টাকা ধার দে। সেতো আর জানে না, বাইরে ফিটফাট দেখা গেলেও ভিতরটা আমাদের একদম পুরোনো সদরঘাট! মান রক্ষার্থে, মা-কে গিয়ে টাকার কথা বললাম। ছেলের ইজ্জত রক্ষার্থে, মা তার অতি-কষ্টার্জিত জমানো টাকা থেকে বের করে দিলেন। তবে আমার বন্ধু সেই টাকা আর কখনোই ফেরৎ দেয়ার ফুসরত পায়নি। হে বন্ধু, একশত টাকা ’৮২ সালে আমার কাছে অনেকগুলো টাকা; তোমার নেয়া ওই টাকার মধ্যে আমার মায়ের অনেক কষ্ট আর অশ্রু মেশানো!

উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। বিআরটিসি বাসে (হাফ ভাড়া) কলেজে যেতাম মাঝে-মধ্যে। যেদিন যেতাম, মা-র কাছ থেকে প্রতিদিন পাঁচ-ছয় টাকা নিয়ে রওনা দিতাম। আর জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য, সিক্রেট রিজার্ভ হিসাবে থাকত মায়ের দেয়া আরো গোটা দশেক টাকা (যেটা সংরক্ষিত ছিল কেবলমাত্র অতিজরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য)। আমি দেখতাম, আমার বন্ধুরা চার-পাঁচ সাবজেক্টে স্যারদের কাছে ব্যাচে পড়ছে। মা আমাকে বললেন, তুমিও ব্যাচে পড়; যত কষ্টই হোক, বেতনের ব্যবস্থা করে দেব। আমার টিউশনির টাকায়ও হয়ত বেশ কিছুটা কাভার হয়ে যেত। মা, কাউকে কখনো বলিনি, আপনাদের সবার কষ্টের কথা চিন্তা করেই, আমি কলেজে থাকতে ব্যাচে পড়িনি; কোন ভর্তি-কোচিংয়েও যাইনি। মা, এখন বলি, নোট বা সাজেশন চাইতে গিয়ে, কাছের বন্ধুদের কাছে রিফিউজড হয়েছি। আসলে তাদের ভাব ও ভাষাটা ছিল যেন ‘আমরা টাকা দিয়ে স্যারের কাছে পড়ি, আর তুই ফাউ ফাউ সব পেয়ে ফেলতে চাস’! মা, ভেতরে ভেতরে তখন ভীষণ খারাপ লাগত; সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা হতো! যাই হোক, যেভাবেই হোক মা- দূরে তো গিয়েছিই!

উচ্চ মাধ্যমিকের পরে আমি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ-এ ভর্তি হলাম। ভর্তি-সংক্রান্ত সামান্য কিছু টাকা লাগবে। কার কাছে আর দ্বারস্থ হবো; সেই আমার মা। কলেজে যাতায়াত করতাম বাসা থেকে। একটা প্রাইভেট টিউশনি করতাম; বেতনটা অবশ্য মার কাছেই দিতাম। আর প্রতিদিন মার কাছ থেকে দশটা টাকা নিয়ে গুলিস্তান হয়ে বাবুবাজার যেতাম। এক সময় এৎধুং অহধঃড়সু-সহ অল্প কয়েকটা বই কেনার প্রয়োজন হলো। সাম্প্রতিক সংস্করণের অনেক দাম! টাকা আসবে কোত্থেকে? এসে গেল মা-নামক সেই গরিব গৌরী সেনের কাছ থেকে! মা ধার করে বই কেনার টাকা দিলেন। দেখলাম, এভাবে ডাক্তারি পড়া আমার দ্বারা সম্ভব নয়! শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটা বিদেশী স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম; মেডিসিন পড়তে দেশত্যাগ করলাম। কাউকে বলিনি, আসলে ভিতরে ভিতরে, এই জীবন থেকে আমি পালাতে চেয়েছি! মাগো নিজেকে আজ বড়ই স্বার্থপর বলে মনে হয়। কেননা, নিজে তো পালালাম; কিন্তু আপনাদের সবাইকে তো ছেড়ে গেলাম এক অসীম দরিয়ার মাঝে। আমি জানি মা, এই সময়টা আপনাদের কেটেছে প্রচন্ড কষ্টের মধ্যে, ছোট্ট দুই রুমের এক ভাড়া বাসায়। আপনার সাথে বোনেরা তখন সেলাইয়ের কাজ করেছে। পাশাপাশি চলেছে ভাইবোনদের টিউশনি। আমি অনুভব করি, মেজো বোন আর ছোট ভাই কত কষ্ট করে, কিভাবে কোনরকমে ঢাকা ইউনিভার্সিটি-তে তাদের পড়াশুনা চালিয়ে গিয়েছে।

ডাক্তার হয়ে দেশে ফিরলাম! বাকি দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেল। বিসিএস দিয়ে চাকুরিও পেয়ে গেলাম। ভাবলাম, বোধহয় আমাদের জীবনে স্থিতি এসেছে; আর বাবা-মার সারাজীবনের কষ্ট বোধহয় শেষ হতে চলেছে! কিন্তু নিয়তির অভিপ্রায়টা যে ছিল একদমই ভিন্ন!

আমার মায়ের জীবনটা আসলে একটা সকরুণ শোকগাঁথা! মহাকালের এই ক্ষুদ্র জীবনকালে, আল্লাহতায়ালা কেবল একটার পর একটা পরীক্ষা নিয়েই চলেছেন। দুঃখ আর বেদনা প্রায়শঃই কেড়ে নিয়েছে তার জীবনের সুখ। জীবনটা যখনি থিতু হতে চলেছে, তখনি তার জীবনটা হঠাৎ-দুর্বিপাকের তীব্র ঝাঁকুনিতে প্রবলভাবে দুলে উঠেছে। আমি কখনো ভুলতে পারি না টেলিফোনে মার সেই কান্না বিজড়িত হৃদয় দুমড়ানো-মোচড়ানো কথা : ‘বাবা, তোমার জুয়েল ভাই আর নাই’! অকালপ্রয়াত জুয়েল ভাই হলেন আমার মেজো বোনের স্বামী; দুবাইতে কর্মরত থাকাকালীন হার্ট অ্যাটাকে অকালে মৃত্যবরণ করেন। এর কয়েক বছর পরে আমার ছোট বোনের স্বামী নাপোলিতে এক গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যান। আমার বাবা ইন্তেকাল করেন ২০১৭ সালে। এভাবে সারাটা জীবন চোখের অশ্রু ঝরিয়ে আর বুকের বেদনা জড়িয়ে, আমার মা কতই না কঠিন চ্যালেঞ্জ, দুর্যোগ আর দুর্ভোগের নিদারুণ করুণ-কঠোর ভার বহন করে চলেছেন। এরপরও যদি মাকে জিজ্ঞেস করা হয়, কেমন আছেন? উত্তর দেবেন- আল্লাহ্তায়ালা ভালোই রেখেছেন!

মা আমরা কি আপনার মতো চাহিদাহীন, নির্লোভ, পরোপকারী আর সহনশীল হতে পেরেছি? কঠিন মা, সেটা পারা ভীষণ কঠিন! নিজের জায়গা-জমি না থাকা সত্ত্বেও, মাকে দেখেছি, কী অবলীলায় নিজের ভাড়া বাসায়- বাবা-মায়ের বিরাট ভূ-সম্পত্তি- ভাইদেরকে ছেড়ে দিলেন। সুসময়-কালে কাছের ও দূরের কত আত্মীয়-স্বজন আপনার দ্বারা উপকৃত হয়েছে। দুঃসময়কালে তাদের কেউ কেউ পরে আমাদের অপকার করার চেষ্টা করলেও, আপনি কখনোই তাদের কিছু বলেননি। সবসময় বলেছেন, সবই আল্লাহ্ দেখছেন! আমাদের কাছের কোন কোন আত্মীয় লজ্জা পেতেন, যখন পরম হিতৈষী কোনো পরিচিতজনের কাছে শুনতেন : আমার মা পাড়া-বেড়িয়ে তার সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। আমিও নিজ কানে শুনেছি : কেউ তাদেরকে এ কথা বললে, তারা ভীষণ বিব্রত বোধ করেন!!! মা, আমার বড় ব্যর্থতা, আমি তাদের মুখের উপর কড়া ভাষায় কখনোই কিছু বলতে পারিনি (যদিও নিজের রাগ কমানো আর ঝাল মিটানোর জন্য কিছু অপ্রকাশযোগ্য বুলি, মনে মনে আউড়ে নিয়েছি)। তবে বিশ্বাস করেন মা, এভাবে হলেও, আমাদেরকে মানুষ করার প্রচেষ্টার জন্য আমি ভীষণ প্রাউড ফিল করি! কেননা ওরকম কথা বলা অনেকের মতো, ঘুষ বা বাটপারির টাকায় আমরা বেড়ে উঠিনি! মা, আমি আমরণ দ্বিধাহীনভাবে বলে যাবো, আমাদের পরিবারের জন্য আপনার ও বোনদের সীমাহীন ও স্বার্থহীন ত্যাগের কথা! আর আপনার এই কঠিন ত্যাগের কারণেই, অনেক বছর পরে হলেও, আমার জ্যাঠাতো ভাইয়ের মুখে শুনতে পেয়েছি : ‘আমার মা-বাবার অবিচারের ফল আল্লাহ্ আমাদের দিয়েছেন; দেখেন না আমাদের বর্তমান অসহায় অবস্থা!’ আর আমার মা তো, অনেক আগেই, তার শ্বশুরপক্ষের সবার প্রতি তার সব ক্ষোভকে ‘আলবিদা’ বলে দিয়েছেন!

আমার মা চিরকাল আমাদের দিয়ে এসেছেন, হৃদয়ের ভান্ডার নিঃশেষ করা স্নেহ-মায়া-মমতা। আর সেই মায়ার টানে, নিজের কৈশর-যৌবন-জীবন আমাদের জন্য আত্মত্যাগ করে, আজ অনিবার্য প্রৌঢ়ত্বে স্বীয় জীবনের সন্ধ্যাবেলা কাটাচ্ছেন ‘পারকিনসন্স ডিজিজ’ নামক অনিরাময়যোগ্য একটা রোগ সাথে নিয়ে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে আর সময়ের ঘূর্ণাবর্তে, আজ তার চলার পথের একমাত্র সাথী আমার মেজো বোন, যে নিজের সাধ্যমতো জন্মদাত্রী মায়ের সেবা-শুশ্রুষা করে চলেছে। আমি নিশ্চিত মা, আপনার আজকের এই রোগের মূল কারণ- যাপিত জীবন থেকে প্রাপ্ত বড়সড় মানসিক স্ট্রেস, আর সেইসাথে আমাদেরকে ভালো রাখার দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টার অব্যাহত কঠোর চাপ। মা, কী স্বার্থপর আমি! আপনার প্রয়োজনের সময় আমি সরাসরি পাশে নেই; দূর-প্রবাসে শিকড় গজিয়ে পড়ে রয়েছি। সারাটা জীবন আপনি আমাদের আগলে রেখেছেন, উজাড় করা চরম ত্যাগ আর পরম মমতায়! কিন্তু বাস্তব জীবন আর ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! আজকে আপনার নিজ ছেলে ডাক্তার হলেও, আপনার অসুস্থতায়, আপনার কাছে এসে সেবা করতে সম্পূর্ণ অপারগ! মা মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমি আপনাকে ‘বিষাদ সিন্ধু’ উপন্যাসটা পড়িয়ে শোনাতাম! তখন বইয়ের কোন জায়গা আপনি একবারের জায়গায় দুইবার শুনতে চাইলে, বেশ বিরক্তই হতাম। চাইতাম, বড়সড় এই বইটা যেন তাড়াতড়ি শেষ হয়ে যায়। এখন ভীষণ আফসোস হয় মা, কেন যে তখন আরেকটু বেশি সময় আপনাকে দেইনি!

স্বীয় জীবনের সুখ-শখ-স্বপ্ন আর আনন্দ-বিনোদন-আহ্লাদ- সবকিছু বিসর্জন দিয়ে- আজীবন আমার মা শুধু তার সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। আমাদের ব্যর্থতা, আমরা তার হৃদয় নিংড়ানো অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকু নিজেদের মাঝে সঠিকভাবে ধারণ করতে পারিনি। সবশেষে, আমার মার মতো আমিও বলি- আল্লাহ্ যা চেয়েছেন আর করেছেন- আমাদের ভালোর জন্যই চেয়েছেন, ভালোর জন্যই করেছেন!
পৃথিবীর সব সংগ্রামী মায়ের সুস্বাস্থ্য, সুখ ও মঙ্গল কামনা করছি!

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইয়ামাগুচি ইউনিভার্সিটি গ্রাজুয়েট স্কুল অব মেডিসিন, জাপান।