দিল আফরোজ কাজী রহমান চাঁপা
আমার স্বামীর মৃত্যুর পর জীবনে বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটায় আমি ভীষণ ভড়কে গিয়েছিলেম । যেন আলোর জগত থেকে মহা অন্ধকারে আমি পড়ে গেলাম । শোক এবং হতাশা সব মিলে ঘোরতর অন্ধকার আমার চারদিক আচ্ছন্ন করে ফেলে। বাড়ির ছাদ ভেঙ্গে পড়লে বাড়ির যে অবস্থা হয় আমার বাস্তব পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। চারদিকে বেসামাল ও প্রলয়ংকরী অবস্থা । কোন মহিলার জীবনের একমাত্র অবলম্বন স্বামী মারা গেলে তার মানসিক অবস্থা শুধুমাত্র হৃদয়ঙ্গম করা যায়, ভাষায় ব্যক্ত করা যায়না । ডিভোর্স হলেও মহিলাদের খুব কষ্ট হয়, কিন্তু সেটি ভিন্ন রকম কষ্ট ।
সময়ের অগ্রযাত্রায় পুনরায় সাহস সঞ্চয় করতে এবং মহা অন্ধকার থেকে আস্তে আস্তে আবার চলতে শিখলাম আলোর দিকে। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবন । কারো উপর কোন রকম নির্ভর না করে আত্মশক্তিতে পথ চলা। তার উপর আমি থাকি বিদেশের মাটিতে যেখানে কোন রকম কোন সাহায্যকারী নেই। এখানে নেই কোন কাজের মানুষ । নেই গাড়ি চালানোর জন্য কোন ড্রাইভার। আমি চাকরি করি। একা একজন মহিলার পক্ষে সব দিক সামাল দেয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ। একা জীবন কাটাতে হলে কি ধরনের আত্মপ্রত্যয়, আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাস লাগে তা রীতিমত অচিন্ত্যনীয় । একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহই জানেন, একজন স্বামীহারা মহিলাকে কি রকম কষ্ট, যন্ত্রণা এবং সংগ্রাম করতে হয়।
তবে আমার মা বাবার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা আমার বড় শক্তি। মা ছোটবেলায় যখন আমাকে পড়াতে বসাতেন তখন বলতেন – “পড় পড়, নিজের পায়ে দাঁড়াও।” আমি এতো ছোট ছিলাম, ফ্রক পরিহিত একটি ক্ষুদ্র বালিকা । আমি ছিলাম খুব হাল্কা পাতলা আর আমার ছিলো অনেক বড় বড় চোখ । আমি আমার বড় বড় চোখ দিয়ে করুণ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে পড়তে বসতাম । মনে মনে ভাবতাম – নিজের পায়ে দাঁড়ানো আবার কি জিনিস ? আমিতো নিজের পায়ের উপরই দাঁড়িয়ে আছি ।
স্বামীর মৃত্যুর পর আমি বুঝেছি নিজের পায়ের উপর দাঁড়ানো কাকে বলে । কারণ এখনতো সত্যিকার অর্থেই আমি নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছি । বিয়ের আগে মা বাবার সাহায্য পেয়েছি, বড় ভাইয়ের সাহায্য পেয়েছি। এখন কারো সাহায্য ছাড়াই আমার এ জীবন। ব্যাপারটা খুব সহজ নয় ।
আমি চাইলেই আমার ছেলেমেয়েদের সাহায্য নিতে পারতাম । কিন্তু কেন আমি তাদের সাহায্য নেবো ? তাদেরতো এমনিতেই অনেক কষ্ট । তারা তাদের বাবাকে হারিয়েছে । কিন্তু আমারতো আছে আমার মায়ের দেয়া শিক্ষা – নিজের পায়ের উপর দাঁড়ানোর শিক্ষা । যে শিশু ছোটবেলায় বুঝতে পারেনি নিজের পায়ের উপর দাঁড়ানো কাকে বলে কিন্তু এখন এই বয়সে এসে সে সেটা ঠিকই বুঝেছে । ছোটবেলায় আরো একটি কথা আমার মা বলতেন । “যে মহিলার স্বামী নেই সে মহিলার মনে কষ্ট দিওনা । কারণ তার মনে এমনিতেই অনেক কষ্ট ।” এখন আমি ভাবি মাঝে মাঝে, আরে এখনতো আমি সে মহিলাই যার স্বামী নেই এবং যার মনে অনেক কষ্ট ! কিন্তু আমার বাইরের হাসি দেখে কেউ বুঝতেই পারেনা আমার মনে কত কষ্ট । এই পৃথিবীতে সেই মানুষই অন্য মানুষের কষ্ট বুঝতে পারে যার একটি অনুভূতি সম্পন্ন মন আছে ।
প্রতিটি মানুষের জীবন এমনই । বিপদে পড়লে প্রথম প্রথম মাথা ঠিক থাকে না । আবার বিপদে না পড়লে বিপদ কি জিনিস বোঝা যায়না । তারপর অনেক কষ্টে অনেক সাধনায় সেই বিপদ থেকে ধীরে ধীরে একটি উত্তোরণ ঘটে। আর এটাই হচ্ছে মানব জীবন । মানুষের জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে নানান রকম বিপদ আপদ আসে কিন্তু মানুষ এবং তার জীবন কখনো থেমে থাকে না ।
-গেইন্সভিল, ফ্লোরিডা।