আমি আ.লীগ-বিএনপি-জামাতি-বামাতিও?

মোস্তফা কামাল : রাজনৈতিক বৃত্তে উজবুকরাই সেরা। চাতুরিতে সেরার সেরা। আছি, থাকি, চলি-ফিরি তাদের সাথেই। হাছি, হাসি, কাঁশি, ঘেঁষাঘেষিসহ জীবনাতিপাত এ রথী-মহারথীদের আশপাশে। আওয়ামী লীগের কথায় একমত না হলেই আমি বিএনপি-জামায়াত। আর বিএনপি-জামায়াতের পছন্দ না হলে সেই আমিই আওয়ামী লীগার-বাকশালী। তাদের চিন্তা ও বুদ্ধিতে এর বাইরে আর কিছু নেই। থাকতেও নেই?
সাংবাদিকতার পাশাপাশি লেখক জীবন বড়ই বিচিত্র! অন্যরকম অভিজ্ঞতার। আনন্দের, বিষাদেরও। উচিৎ কথায় বামন বেজার বলে একটা গেঁয়ো প্রবাদের কী যে বাস্তবতা এখানে! লেখা বা টকশোর কোনো কোনো বক্তব্য নিয়ে প্রায়ই মজার অভিজ্ঞতা। একই লেখা বা বক্তব্যের কোনো অংশ ক্ষমতাসীনদের পক্ষে গেলে ক্ষেপে যায় তাদের প্রতিপক্ষ। তাৎক্ষণিক বিচারে রায় দিয়ে ফেলে, আমি একটা আস্ত আওয়ামী-বাকশালী। ওই লেখারই আরেক অংশে আওয়ামী লীগ ভীষণ বেজার হয়ে যায়। সাথে সাথে তারা আমাকে লাগিয়ে দেয় বিএনপি-জামায়াতি ট্যাগ। কী ইন্টারেস্টিং না? লেখক-কলামিস্ট না হলে নসিবে তা জুটতো? উপভোগ করা যেত এ সার্কাস?
হাল সময়ে লুটপাট, অর্থ পাচার, খেলাপি ঋণ নিয়ে কয়েকটা লেখা প্রকাশ হয়েছে আমার। টক শোতেও টুকটাক কথা বলতে হয়েছে। এর সুবাদে মজার সঙ্গে কী ছিদ্দতটাই না যাচ্ছে আমার। ক্ষমতাসীন মহলের চেনাজানারা বুঝ দিচ্ছেন- দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, খেলাপি ঋণ, অভাব, নিত্যপণ্যের চড়া দাম, গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট আসলে ততো নয়; যতো প্রচার হচ্ছে। এর বেশিরভাগই গুজব। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে, তা কেন গুছিয়ে বলি না? এর বিপরীতে বিএনপিমনা পাঠক-দর্শকরা বলছেন- দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, নিত্যপণ্যের দাম, গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটের তথ্য খুব কম থাকছে আমার লেখা ও কথায়। কারণ আমি ভেতরে-ভেতরে আওয়ামী লীগ করি। তাই সরকারের জন্য ক্ষতি হবে এমন তথ্য দিতে বড় বখিলি করছি। বিচার, বোধ, বিবেচনার কী দৌরাত্মের মধ্যে আছি! এই বুঝবানদের পাল কি কম ভারি? আশেক-মাশেক কম তাদের?
না, একদম না। ফুটপাত-রাজপথ থেকে বেহেস্তের বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ পর্যন্ত কতো যে ছা-পোনা তাদের! ওই পালভুক্ত হতে না পারায় জামায়াতি সিল খাওয়ার রেকর্ডও আছে আমার। ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে লিখতে বরাবরই সতর্ক-সাবধানী আমি। দক্ষিণপন্থীদের সমানে রাজাকার, আলবদর, আলশামস গালমন্দ করে নিজেকে সস্তা দরের প্রগতিশীল সাজি না। সোজা পথের মর্দে-মদন হওয়ার বাতিকে ভুগি না। আমার এ বৈশিষ্ট্য নাকি ধর্মাশ্রয়ী নমুনা। এর ঠিক বিপরীতে ট্র্যাজেডির সিকোয়েন্সে জামায়াত এবং কয়েকটি ইসলামপন্থীদের দেয়া ‘বাম’ গালমন্দ হজম করতে হয়। এ অভিজ্ঞতায়ও ঋদ্ধ হতে হয় আরেক দলের কাছে। যারা জামায়াত-বিএনপির মধু-মাখন খেয়ে এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়েও কড়া-চড়া আওয়ামী লীগার। কী যে ভাব, সঙ্গে ভঙ্গিও। কখনো কখনো ভাবের চেয়ে ভঙ্গি আরো বেশি। চেতনা কী শান দেয়া! লেখা ও কথায় দু’চারটা তথ্য-সাবুদ দেয়ার অপরাধে কী যে গা জ্বালা এ হজরতদের! দরকার মতো এই এদের কাছ থেকে কেবল ‘বাম’ নয়, ‘নাস্তিক-বেনামাজি’ সম্বোধনও পেয়েছি। আবার ‘মান্দাতা-আনস্মার্ট-প্রগতিহীন’ মূল্যায়নেও ছাড় পাইনি বাম প্রগতির বন্ধুদের কাছ থেকে। যাদের সঙ্গে ছাত্রজীবনে ছিল চিত্তের অলিখিত কাবিননামা। তারা ছাড় দেবেনই বা কেন? এ ছাড়া, আমি যে গতির সাথে এগুতে পারছি না, তা তো নিজেও জানি? সেই যোগ্যতা বা রুচিজ্ঞান নেই তা কি বুঝি না?
এই প্রগতির সোল এজেন্টদেরও কি ছাড় দিচ্ছেন রাজনৈতিক দোস্তরা? বিএনপির ওপর সরকারের নিপীড়নের মিউমিউ প্রতিবাদ করে কী ছিদ্দতেই না পড়েছেন সিপিবির বন্ধুরা! সরকার এখন তাদেরকে বিএনপির দালাল তো বানাচ্ছেই, রাজাকারের কাতারেও নিচ্ছে। সিপিবিকে আওয়ামী লীগের বি টিম বলা অনেক পুরনো ব্যাপার। আবার চীনা বামদের বিএনপি-ঘেঁষা বলা হয়। বিএনপি গঠনে এই বামদের কতো মেন্নতই না ছিল! চীনা বামেরা আবার আওয়ামী লীগের টিমভুক্তও হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর চামড়া-কল্লা নেয়ার বীরবিক্রমরা আবার নৌকার গুলুই ধরতেও সময় লাগেনি। এটাই বাস্তবতা। জামাত-বামাত, ডান-বাম, জাতীয়তাবাদী-বাকশালী সনাক্তের সমীকরণ এ জায়গায় এসেই ঠেকেছে। যে সমীকরণে জামাতের হাত থেকে মুক্তির নামে ফোকলা করে দেয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংককে। টুকটাক ভাগে-যোগে কোনো গোলমাল হয়েছে? এরা বড়ই বরেণ্য ঘরে-বাইরে, সমাজে। শ^শুর বাড়িতেও। এটাই সম্পদের সুষম বণ্টন? এই সৌন্দর্য্যকে থুক্কু মেরে জোরদার কোনো প্রতিবাদ আছে কোথাও?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন, ঢাকা।