রিমি রুম্মান :
প্রায় তিন দশক আগে ছাত্রাবস্থায় আমি যখন ভাগ্যান্বেষণে এই দূরদেশে আসি, তখন এখনকার মতো এত বাংলাদেশি ছিল না। চারদিকে শুধু ভিনদেশি মানুষের পদচারণ। চলতি পথে আচমকা বাদামি ত্বকের কোনো মানুষ দেখলে মনটা অজান্তেই আনন্দে নেচে উঠত। অচেনা মানুষ। চেনা নেই, জানা নেই। কখনো কথা হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। তবুও পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষটি বাংলাদেশি হতে পারে, এমন ভাবনা আমাকে যারপরনাই আনন্দিত করত। চোখমুখে একরকম দ্যুতি খেলে যেত। আমার বিশ্বাস, শেকড় ছেড়ে আসা সেই সময়কার প্রতিটি মানুষ এমন অনুভূতির মধ্য দিয়ে গিয়েছে। স্বদেশ ও স্বদেশির জন্য এমন হৃদয় হাহাকার করা সময়ে বাঙালি পত্রিকা হিসেবে ‘ঠিকানা’ হাতে পাওয়া ছিল অনেকটা খোলা আকাশের নিচে বুকভরে শ্বাস নেওয়ার মতো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সপ্তাহব্যাপী পড়তাম। অদ্ভুত এক গভীরতায় ডুবে যেতাম। স্মৃতির জানালা খুলে যেত। দেশে থাকতে আমার মফস্বল শহর চাঁদপুরে ঢাকা থেকে পত্রিকা এসে পৌঁছাতে দুপুর গড়াত। আমরা তিন ভাইবোন দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতাম। হকার মামা পত্রিকা দিয়ে গেলে কাড়াকাড়ি লেগে যেত, কার আগে কে পড়ব-এ নিয়ে। মনে পড়ে গেল সেই সব পেছনের কাল।
প্রবাসের রুদ্ধশ্বাস ছুটে চলা জীবনেও সেই অভ্যাসটি রয়ে গেছে। অর্থাৎ আমি ছিলাম বরাবরই একনিষ্ঠ পাঠক। পড়ার পাশাপাশি নিজেও লিখতাম। কী লিখতাম? আমার ফেলে আসা সময়, দেশ, স্বজন, বন্ধু, বাবা-মা নিয়ে লিখতাম। আসলে মানুষের গোটা জীবনটাই একটা স্মৃতিকাতরতা। এর ব্যাপ্তি অসীম।
ধীরে ধীরে আমার লেখার প্লট বদলে যেতে লাগল। আমার চারপাশের মানুষের জীবন-জীবিকা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা আমায় ছুঁয়ে যাচ্ছিল। দেখলাম, দেশ ছেড়ে আসা মানুষদের প্রায়ই অচিন্ত্যনীয় এক বেদনা গ্রাস করে রাখে। উন্নত দেশের জীবনযাত্রার মান, এত সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও বুকের গহিন কোণে অসীম বেদনা। আমি আমার কর্মস্থলের সহকর্মীদের পরিবার ছেড়ে দূরে থাকার বেদনার গল্পগুলো শুনতাম। কাজ শেষে উ™£ান্তের মতো নিউইয়র্কের নির্জন সড়কে উথালপাতাল হেঁটে বেড়ানোর কথা লিখতাম। লিখতাম, আত্মীয়-পরিজনহীন এই ভিনদেশে আমার দুর্দশা আর দীনতার কথা। কেমন করে অচেনা এই দেশটিতে অচেনা কিছু স্বদেশি মানুষ আমায় পথ চিনিয়েছিল, চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিল, সেই সব কথা। লিখলাম, বরিশালের বানারীপাড়া থেকে আসা অক্ষরজ্ঞানহীন পরিবারটির এই ভিনদেশে টিকে থাকার সংগ্রামী জীবনের কথা। আমার প্রতিবেশী আঙ্কেলের কথা, যিনি দেশে রেখে আসা আমার সমবয়সী কন্যার কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই চোখের জলে ভেসে যেতেন। এসব লিখে গিয়েছি ঘোরলাগা এক মানুষ হয়ে।
এই যে এত এত জীবনগল্প, ভাবনা, অনুভূতি লিখতাম পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, সেসব ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে জমিয়ে রাখতাম। রকমারি প্রসাধনী, জুয়েলারির পরিবর্তে ড্রয়ার পরিপূর্ণ হয়ে উঠত এই সকল সুখ-দুঃখ, সংগ্রাম ও আনন্দ-বেদনার স্রোতে আবর্তিত জীবনগল্পে। মাস, বছর গড়ালে একদিন পূর্ণ ড্রয়ার শূন্য করে সব ফেলে দিয়ে আসতাম ময়লার ঝুড়িতে। তখন জীবন এখনকার মতো প্রযুক্তিনির্ভর ছিল না। কম্পিউটার, বাংলা টাইপিং কিছুই হাতের নাগালে ছিল না। আমার ভেতরে প্রায়ই একটি হাহাকার জেগে ওঠে। ঠিকানার পথচলা তেত্রিশ বছর পার হয়ে চৌত্রিশে পড়ল, অথচ আমি আমার লেখাগুলো সেই সময়কার ‘ঠিকানা’র পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পারতাম। কেন পারিনি? কেমন করে কোথায়, কাকে লেখা পাঠাতে হবে, আমার জানা ছিল না। মানুষের ছোট্ট একটি জীবন। এক জীবনের সকল চাওয়াই তো আর পূর্ণ হয় না। কিছু কিছু অপূর্ণতা থেকেই যায়। এসব লেখা না পাঠাতে পারার বেদনা, অনেক অপূর্ণতার একটি হয়ে রইল। তবুও সান্ত্বনা যে অবশেষে ‘আমি ইহাকে পাইলাম’। ‘ঠিকানা’কে পাইলাম। লেখা পাঠালে সম্পাদক কখনো নিরাশ করেন না। ছাপেন। আমার লেখা ছড়িয়ে দেন অগণন পাঠকের মাঝে। এই দীর্ঘ পথচলায় ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’ ঐতিহ্য ও সুনামের সঙ্গে তার মান অক্ষুণ্ন রেখে চলেছে। আমি ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’র উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। পত্রিকাটির পথচলা দীর্ঘজীবী হোক।
লেখক : কথাশিল্পী, কুইন্স, নিউইয়র্ক।