রোমিনা লোদী (জয়িতা) :
দিন নেই, রাত নেই, কেন আপনি আমার কথা ভাবেন? আমার দিকে চেয়ে থাকেন? একটু পরপর নতুন কিছু দেখার আশায় জেগে ওঠেন? নতুন কিছু দেখলে, নতুন কিছু জানলে মনটা পুলকিত হয়। ভাবতে থাকেন, আমি না থাকলে আপনার জীবনটা কেমন শূন্য লাগত। কেমন রংহীন ধূসর হতো আপনার নিত্যদিন। এই যে এখন আমার সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে কোথা দিয়ে আপনার প্রহরগুলো কেটে যায়, টেরই পান না। আপনার জীবনে আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তি, যা প্রতিনিয়ত আপনাকে প্রভাবিত করি, সজ্ঞানে বা অজান্তে।
ভাবছেন তো, আমি কি?…
দুই বছর আগে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ সংখ্যায় আপনাদের বলেছিলাম আমার আত্মকথা। লেখাটির নাম ছিল, ‘বলুন তো আমি কি?’
মনে পড়ছে কি? আগস্ট মাসে আমার জন্ম। জন্মের শুরু থেকেই আমি নীল আর সাদা রঙে রঞ্জিত। এই তো আপনার মনে পড়েছে। আমি আর কেউ নই, আপনাদের অতি পরিচিত, প্রাণের বন্ধু ‘ফেসবুক’।
দুই বছর পর আজ আবার বলতে এসেছি, আমার কিছু কথা। এত দিনে আমার বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আমার প্যারেন্ট কোম্পানির নতুন নামকরণ হয়েছে, মেটা। যদিও আমি সারা দুনিয়ার কাছে সেই পুরোনো নামেই বেশি পরিচিতÑফেসবুক।
যত দিন যাচ্ছে, এই মানবকুল যেন আরো বেশি যান্ত্রিক, আরো বেশি অস্থিরচিত্তের হয়ে পড়ছে। সময় নেই, সময় নেই…একদম সময় নেই। ফেসবুক দেখেই যদি সবার খোঁজখবর নিয়ে ফেলা যায়, তাহলে আর কষ্ট করে ফোন করা, দেখা করা বা বাড়িতে যাওয়ার প্রয়োজন কী? …এমন চিন্তাধারায় তারা বিশ্বাসী।
আমার জন্ম হয়েছিল সারা বিশ্বের দূরদূরান্তে থাকা মানুষগুলোর নেটওয়ার্কিংয়ের জন্য। বিভিন্ন টাইম জোনে বিভক্ত হওয়া পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মে আনার জন্য, যেন দূরে থেকেও তারা হতে পারে কাছের মানুষ। কিন্তু দেখুন, কী হয়েছেÑহয়েছে তার উল্টোটা। আমার বদৌলতে আজ তারা কাছে থেকেও দূরের মানুষ।
হাতে থাকা মুঠোফোনের মাধ্যমে ফেসবুকে গিয়ে, ড্রইংরুমের সোফায় পাশাপাশি বসে থেকে ভাই, বোন একে অন্যের ভিডিওতে লাইক দেয়, কমেন্ট করে। বেডরুমে বিছানায় পাশাপাশি শোয়া স্বামী-স্ত্রী ফেসবুকে তাদের একে অন্যের ছবিতে লাভ দেয়, একে অন্যের পোস্টে প্রেম নিবেদন করে। দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রেস্তোরাঁয় মুখোমুখি বসে একে অন্যের পোস্টে কমেন্ট দেয়, তা-ও খোলামনে সামনাসামনি বলে না। আমি খালি দেখি আর হাসি।
আরো দেখে হাসি পায়, তাড়াহুড়ো করে স্ক্রল করতে গিয়ে মানুষগুলো এতই হারিয়ে যায় যে অন্যের দেওয়া পোস্টগুলো ভালো করে না পড়েই কমেন্ট দেওয়া শুরু করে দেয়। এই যেমন কোনো হাসি হাসি মুখের দম্পতির ছবি দেখলে ভালো করে না পড়েই অ্যানিভার্সারির উইশ। অথবা কারোর অসুস্থতার খবর পুরোটা না পড়েই, তার জন্য মৃত্যু-পরবর্তী জান্নাত লাভের দোয়া। হয়তো ব্যক্তিটি এখনো বেঁচে আছেন এবং সুস্থ হয়ে পরের সপ্তাহে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান।
কেউ কেউ আবার কৌতূহলী হয়ে যেকোনো একটা বিষয়ে পোস্ট করে দেখেন, তার ফেসবুক বন্ধুদের কাছ থেকে কী ধরনের সাড়া মেলে। কয়টা লাইক, কয়টা লাভ আর কমেন্ট মেলে। কজন শেয়ার করে তার পোস্ট। আজব এই দুনিয়া আপনাদের। সবার মনোযোগ পাওয়ার এত চেষ্টা। নিজের ঢাকঢোল পেটানোর এত চেষ্টা। নিজের মতো করে সময় কাটান না ভাই। নিজের জীবনের সবকিছু কি সবাইকে জানাতে হবে?
এবার আপনাদের সঙ্গে মজার একটা তথ্য শেয়ার করি। সবাই তো আমাকে নিজের প্রিয় বন্ধু মনে করেন, প্রিয় বন্ধুর মতো ব্যবহার করেন। কিন্তু আপনি জানেন কি, আপনি কোন ফেসবুক ব্যবহারকারী দলের মধ্যে পড়েন?
আমেরিকার ইউটাহ স্টেটের এক ইউনিভার্সিটির রিসার্চ টিম গবেষণা করে আবিষ্কার করেছে, সারা পৃথিবীতে মোট চার ধরনের ফেসবুক ব্যবহারকারী আছে। প্রথম দল হলো রিলেশনশিপ বিল্ডার অর্থাৎ এই দল ফেসবুকিংয়ের মাধ্যমে সত্যি সত্যি পৃথিবীর ভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা চেনা-অচেনা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে চায়। ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের সামাজিকতার পরিধি বাড়াতে চায়।
দ্বিতীয় দল হলো সেলফি আর্টিস্ট। তারা সর্বদাই নিজেদের ছবি, ভিডিও, গল্প, কাহিনি, লাইভ শো পোস্ট করতে থাকে এবং বন্ধুদের লাইক, লাভ, কমেন্টের অপেক্ষায় বসে থাকে। কজনের কাছ থেকে তা এল এবং তার মোট সংখ্যা কত, এর ওপরই নির্ভর করে এসব সেলফি লাভারদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি ও নিজের সম্পর্কে আস্থা অর্জন।
তৃতীয় দল হলো এমন সব মানুষ, যারা ফেসবুকের মাধ্যমে মনুষ্য সমাজে নানাবিধ সংবাদ, তথ্য, চিত্র ও বার্তা প্রদানের চেষ্টা করে এবং এর মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নের চেষ্টা করে। এরা নিজেদের প্রোফাইল বা ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক বাড়ানোর চাইতে সারা দুনিয়ায় কী হচ্ছে, সেটা সবাইকে জানাতেই বিশেষ আগ্রহী।
সর্বশেষ দলটি হলো নীরব দর্শক-শ্রোতা কিন্তু পুরোমাত্রায় কৌতূহলী বন্ধুদের দল। এরা নীরবে সবার সব পোস্ট দেখে, পড়ে, পুরোমাত্রায় অবগাহন করে কিন্তু ভুলেও কোনো রকম লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার করে না। প্রত্যেকের জীবনে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সে সম্পর্কে এরা ওয়াকিবহাল কিন্তু এদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউ ওয়াকিবহাল নয়।
আপনি যে দলেই পড়েন না কেন, আমার সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা আজীবন চলতেই থাকবে এবং আমি হব আপনার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। ফেসবুক ভালোবাসে না এই যুগে এমন কি কেউ আছে?
লেখক : কলামিস্ট ও ব্লগার, টেক্সাস।