আমি জানি খাঁচাবন্দী পাখি কেন গায় গান

শরীফা খন্দকার : ‘গ্লোবাল রেনেসাঁ ওম্যান’ ও আমেরিকান সংস্কৃতির অগ্রদূত হিসেবে খ্যাত প্রয়াত ড. মায়া এঞ্জেলুর ছিলো বহুমুখী প্রতিভা। তাঁর অসংখ্য গুণাবলীর বর্ণনা করতে গেলে বৈষ্ণব পদকর্তার ভাষায় বলতে হয় একই অঙ্গে কতো রূপ! সাহিত্যিক, নৃত্যশিল্পী, নাট্যকর্মী, সিভিল রাইট্স এক্টিভিস্ট, শিক্ষক, সাংবাদিক, সমাজ সংস্কারক, মেমোরিস্ট, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র প্রযোজক, নির্মাতা, অভিনেত্রী ও ইতিহাসবিদসহ আরো অনেক বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায় তাঁকে। অন্তহীন লেখালেখির মধ্যে তাঁর ‘বেস্ট সেলার’ গ্রন্থই ছিলো ৩০টি। ৬টি ভাষায় মাস্টার্স এবং কথা বলার অদ্ভ‚ৎ দক্ষতা ছিলো তাঁর। ২০০০ সালে পেয়েছিলেন সর্বোচ্চ সিভিলিয়ন এ্যাওয়ার্ড ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব আর্টস।’ ২০০৮ সালে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছিলো ‘লিঙ্কন মেডেলে’। এই বছরই তিনটি ‘গ্রামী পুরস্কার’ পেয়েছিলেন। ২০১১ সালে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ দিয়ে আমেরিকার ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা সম্মানিত করেছিলেন এঞ্জেলুকে। তার কবিতা ‘গিভ মি এ কুল   ড্রিংক অফ ওয়াটার’; ‘ফোর আই ডাই’ ও ফিল্ম ‘ডাউন ইন দ্যা ডেল্টা’ মনোনীত হয়েছিলো পুলিৎজার পুরস্কারে। ৫০টি অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রিতে তাঁকে ভ‚ষিত করা হয়েছিলো। নর্থ ক্যারোলিনার ওয়েক ফরেস্ট ইউনিভর্সিটির আমেরিকান স্টাডিজের রেনল্ড প্রফেসরের আজীবন পদ দিয়ে তাঁকে করা হয়েছিলো সম্মানিত। বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে চলতি শতকের এক দশকের বেশি সময় মায়া এঞ্জেলু আমেরিকান আকাশে ছিলেন দুর্লভ নক্ষত্রের প্রজ্জ্বলিত আলো।

কিন্তু সবার উপরে তিনি ছিলেন একজন কবি। সংবাদ সংস্থা ‘এপি’র সঙ্গে ২০১৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে মায়া সে কথাই জানিয়েছিলেনÑ ‘আমি একজন কবি। সাউন্ড ইন ল্যাঙ্গুয়েজ ও মিউজিক ইন ল্যাঙ্গুয়েজ আমার প্রেম ও ভালোবাসা।’

একদা কবিতা তাঁর শৈশবের অন্ধকার খাঁচায় প্রবেশ করেছিলো আচমকা ও অনাহুত-মায়ার জীবনের বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের চৌদিক ঘিরে ছিলো সেই তন্ময়তা। নৃত্য ছিলো তাঁর প্যাশন এবং আলোকিত জগতের প্রবেশদ্বার। কিন্তু তাকেও তিনি একাকার করে নিয়েছেন কবিতার সঙ্গে।

এ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের কাছেই ২০০৮ সালে পূর্ববর্তী এক সাক্ষাৎকারে রাশিয়ান নৃত্যশিল্পী, পরবর্তীকালে আমেরিকান-অভিবাসী, ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যালে ডান্সার মিখাইল ব্যারিনিস্কভকে উল্লেখ করে ব্যক্ত করেছিলেন ‘যদি তুমি মিখাইলের কোনো নাচ দেখো, তবে উপলব্ধি করবে শরীরের রেখাচিত্রগুলো তিনি কিভাবে ফুটিয়ে তোলেন এক একটি মুদ্রার নান্দনিকতায়। তেমনি করে একজন কবি তার কলমের রৈখিক চিত্রের মধ্যে দিয়ে একইভাবে সাজিয়ে তোলেন কবিতার হৃদয়নন্দন পঙ্ক্তিমালা!’

মায়া এঞ্জেলুকে রাজকবির মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে দেখেছিলাম আমার আমেরিকা বাসের প্রথম অধ্যায়ে, ১৯৯৩ সালে। টিভি পর্দায়, ভ‚মন্ডলের অগণিত দর্শকের সঙ্গে। আরকানসাস রাজ্যের গবর্নর ও নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তার সরকারের প্রথম টার্মের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ড. মায়াকে একটি কবিতা রচনা ও পাঠ করতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ওই বর্ণবহুল অনুষ্ঠানে সেই কবিতা ‘অন দ্যা পালস অব দ্যা মর্নিং’ অতলান্তিকের ক‚ল ছাপিয়ে প্লাবিত করেছিলো সমগ্র দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের মন। তিনি সেদিন যে বিশাল কবিতাটি পাঠ করেছিলেন, বাংলায় তার তিনটি চরণÑ

‘এখানে এসে দাঁড়াও পশ্চাতে

কিন্তু খুঁজো না কোন স্বর্গ আমার ছায়ায়

লুকিয়ে থাকার কোনো স্থান আমিতো রাখিনি।’

এই অসামান্য কবিতা নিয়ে সেদিন এক টিভি আলোচক বলেছিলেনÑ এটি এমন এক কবিতা, যা নাড়া দিয়েছে আত্মায়, উদ্দীপ্ত করেছে দেহ, মনকে দিয়েছে উড়িয়ে এবং হৃদয় পেয়েছে রোগমুক্তির আনন্দ! একক কবিতা হিসেবে ‘পালস অন দ্যা মর্নিং’ দু’বছরব্যাপী ছিলো বেস্ট সেলার। ছোট পর্দায় এই উপস্থিতির আগে ও পরে আমরা তাঁকে অনেকবার দেখেছি। ১৯৭৭ সালে এলেক্স হেইলির ল্যান্ডমার্ক টেলিভিশন সিরিজ ‘রুট্স’-এ অভিনয় করে আপামর বিশ্ববাসীর হৃদয়কে যন্ত্রণা-বিমুগ্ধ করে পেয়েছিলেন এমি এ্যাওয়ার্ড।

মিসৌরী রাজ্যের সেন্ট লুইসে ১৯২৮ সালে ৪ এপ্রিল জন্ম নিয়েছিলো এক কালো মেয়েÑ মার্গারেট এনি জনসন। এক বছরের বড় ভাইটি তাকে ডাকতো মায়া বলে। পিতামাতার বিচ্ছেদের সূত্রে অবুঝ বয়সেই মার্গারেটকে গ্রহণ করতে হয়েছিলো এক রকম বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো যাযাবর জীবন! পিতা তিন বছর বয়েসেই চার বছর বয়সী ভাইসহ তাঁকে চাপিয়ে দিয়েি লো দরিদ্র রাজ্য আরকানসাসগামী একটি ট্রেনে! সেখানে কালো মানুষের বসতি স্ট্যাম্পে থাকতেন তাদের দাদি। পাঁচ বছর ওখানে কাটানোর দিনগুলোতে ছিলো বৈষম্যের নানা পীড়ন ও অত্যাচার। এক শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির সঙ্গে সমস্যার কারণে ভাই-বোন ফিরতে বাধ্য হয়েছিলো মায়ের কাছে। পরবর্তীতে মায়া তাঁর মা’কে বর্ণনা করেছেÑ ‘রংধনুর ছিটকেপড়া রং’ বলে।

প্রফেশনাল গ্যাম্বøার মা ঐ সময় বসবাস করতো তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। মায়ার ভাষায় ‘বাদামি ভালুক।’ মাত্র আট বছর বয়েসেই সেই ভালুকের লাম্পট্টের শিকার হয়ে ভাইকে নিয়ে আবার ফিওে যায় স্ট্যাম্পে। একটি জেনারেল স্টোরের মালিক দাদি গভীর স্নেহ-ভালবাসার সঙ্গে মায়াকে শেখাতে চাইলেন লেখাপড়া। অথচ পোড় খাওয়া মেয়ের বিদ্যা লাভে অরুচি! গুহাবাসী হয়ে নিজেকে মার্গারেট তখন চেনে কুদর্শনা ও জড় জিহŸার একজন হিসেবে। সে সময় স্ট্যাম্পের কোন শিশুই জানতো না সাদা মানুষেরা দেখতে কেমন! কিন্তু সে তাদের দেখেছে, নয়ন মনোহর সেই সব বালিকার স্বর্ণকেশ আর সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ, তার অলৌকিক কল্পনা বিলাস।

বার্থা ফ্লাওয়ার নামে এক অভিজাত কৃষ্ণাঙ্গী এই সময়েই মার্গারেট এনিকে আমন্ত্রণ করেছিলেন চা, কুকিজে ও কবিতায়। বার্থার কণ্ঠেই জীবনে তিনি প্রথম অবাক বিস্ময়ে শ্রবণ করেছিলেন কবিতা আবৃত্তিÑ ‘এ টেল অব টু সিটিস।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরে কবিতার আবির্ভাবে বলেছিলেনÑ ‘কেমনে পশিল গুহার আঁধাওে প্রভাত পাখির গান।’ কিন্তু যে মেয়ে কোনদিন কবিতা নামে এমন প্রাণমন আকুল করা শব্দ ও ছন্দের যুগলবন্দী শ্রবণ করেনি, তাঁর অনুভ‚তিতে কবিতা যেনো এক অচেনা ‘জাদু কাঠির স্পর্শ‘!

কালো বালিকাটি শুরু করা লেখাপড়ার সঙ্গে শেক্সপিয়ার ও নানা কবিকে কণ্ঠে তুলে মত্ত হয়ে উঠলো অসাধারণ আবৃত্তিতে। স্কুলের লাইব্রেরিতে যতো বই ছিলো, হোক না দুর্বোধ্য, সব শেষ করলো অজানা তৃষ্ণায়। স্ট্যাম্পের স্কুলে পড়ার সময় সে মেয়ে নয় বছর বয়সে রচনা করলো কবিতা। সেখানে অষ্টম শ্রেণির স্কুল শেষ হলে ভাইকে নিয়ে ভর্তি হলো মায়ের তদানীন্তন বসবাসস্থল সানফ্রান্সিস্কোর জর্জ ওয়াশিংটন হাই স্কুলে। শিল্পকলার অনুরাগী ও পারদর্শী হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়া লেবার স্কুল থেকে নৃত্য ও নাটকের ওপর একটি স্কলারশিপ এলো। কিন্তু অর্থকষ্ট দাঁড়ালো দুর্লঙ্ঘ বাধা হয়ে। ১৪ বছর বয়সে হাই স্কুল ড্রপ আউট মেয়েটি হলো প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান নারী কেবলকার কন্ডাক্টর! এরই মধ্যে পঞ্চদশী কৃষ্ণবর্ণা কিশোরী ক্লাসমেটের সঙ্গে সাময়িক সম্পর্কের পরিণতিতে ১৬ বছর বয়েসে জন্ম দিলো পুত্রসন্তান স্লাইড বেইলি জনসনকে, মা ডাকলো ‘গাই’ নামে। গাইয়ের জন্মের পর পর হাই স্কুল গ্র্যাজুয়েট হতে পারলেও শিশুসন্তান ও নিজের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য শুরু হলো বেঁচে থাকার মর্মান্তিক লড়াই। তারপর থেকেই চলার অমসৃণ পথ ক্রমশ মোড় নিতে থাকলো কঠিন থেকে কঠিনতর বাঁকে!

হাই স্কুল পাস হয়েও তৎকালীন কালো সমাজভুক্ত মার্গারেটকে বেছে নিতে হলো রাঁধুনি, ওয়েট্রেস ও স্ট্রিপ ক্লাবের ডান্সার ইত্যাদি নানা পেশা। একসময় শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গাড়ি মেকানিকের দোকানে দু’হাত দিয়ে গাড়ির রং তোলার কাজও করতে হলো। এমন সময়টাতেই পুরুষশাসিত সমাজ ও বর্ণবাদ তাকে সমগোত্রীয় আর দশটি মেয়ের মতোই হতে বাধ্য করলো পতিতাবৃত্তি অবলম্বনে। এর সঙ্গে যোগ হলো ড্রাগ আসক্তি! এতোসব কিছুই ঘটেছে তার বিশ বছর বয়স হবার আগেই। কিন্তু কৈশর উত্তীর্ণ সন্তানবতী একাকী মেয়ে পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হয়েও তার বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য থেকে কখনও দূরে সরে যায়নি। অভাবনীয় দুঃসাহসে একসময় পা ফেললো শক্ত মাটিতে। শিল্প ও সাহিত্যেও প্রতি গভীর অনুরাগ তাকে জীবনের এসব ট্রমা অতিক্রম করে সহায়তা করেছিলো সরোবরের নীল জলে পদ্মের মতো ফুটে উঠতে! একটি কবিতায় লিখেছিলেনÑ

You may write me down in history
With your bitter, twisted lies,
You may tread me in the very dirt
But still, like dust, I’ll rise.

‘আই নো হোয়াই দ্যা কেইজ্ড বার্ড সিঙ্গস’ নামক সাড়া জাগানো গ্রন্থের পড়তে পড়তে রয়েছে তার বাল্য, কৈশর ও প্রথম যৌবনের আত্মকথা।’ তিন বছর বয়সী মার্গারেটের আরকানসাস যাত্রা দিয়ে শুরু। ৭ম খণ্ডে রচিত বইটিতে অত্যন্ত দুঃসাহসের সঙ্গে তিনি বিবৃত করেছেন মার্গারেটের সেইসব সময়গুলো। আর এক মঞ্চ নাটকেÑ ‘ডাউন ইন দ্যা ডেল্টা’য় এক ড্রাগ এডিক্টেড কালো মেয়ের জীবনে ফেরার গল্প বলেছেন।

মায়া এঞ্জেলুর মৃত্যুর পর তার একমাত্র সন্তান গাই বলেছেন ‘আমার মায়ের জীবন ছিলো একজন শিক্ষকের। একজন মানবাধিকার কর্মীর এবং সর্বোপরি একজন মানুষের।’ সে ছিল তার মায়ের একমাত্র সন্তান।  মা দেশে বা বিদেশে তার যাবতীয় কর্মসম্পাদনে সন্তানকে রেখেছেন একেবারেই কাছে। তবে গর্ভে ধারণ না করলেও আর এক সন্তান তিনি পেয়েছিলেন, বিখ্যাত টক্ শো হোস্ট কুইন অপরাহ উইনফ্রেকে। তিনি জীবন ও মরণে পাশে ছিলেন তার এই মা ও মেন্টরের। মায়ার ৪০তম জন্মদিনটিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পরম আপনজন সহযোদ্ধা মার্টিন লুথার কিং প্রয়াণ করেছিলেন বলে এরপর থেকে তিনি আর নিজের জন্মদিন কোনোদিন পালন করেননি। তিনি ও কিংয়ের স্ত্রী শুধু ফুল পাঠিয়েছেন পরস্পরকে। অপরাহ উইনফ্রে ১৯৯৮ সালে মায়ার ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে পালন করেছিলেন সাত দিনব্যাপী বিশাল এক রিভার ক্রুজের। আবার এই অপরা তার মৃত্যুতে মায়ার ১৮ রুমের বাড়ির রান্নঘরে বসে যাবতীয় আয়োজন করেছেন তার শেষকৃত্যের। অপরা বলেছেন মায়ার যতোটুকু দেয়ার ছিলো, তিনি তা পরিপূর্ণ করে দিয়েছে।

পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে একজন পারফরমার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেছিলেন মায়া। ঋজু ও দীর্ঘ দেহ, অপূর্ব ভরাট কণ্ঠস্বর, আপাদমস্তক যার শিল্পমণ্ডিত, সেই মেয়ে জীবনের পথ খুঁজে পেয়েছিলো নিউইয়র্কে নৃত্যশিল্প শিক্ষা করতে এসে। পোর্জি ও বেস নামে একটি ভ্রাম্যমাণ প্রযোজনায় অংশ নিতে শুরু করলেন। এটা নিয়ে ঘোরা হলো ২২টি দেশ। এরপর নিউ ইয়র্কের পৃথিবীখ্যাত নাট্যমঞ্চ অফ ব্রডওয়ে প্রোডাকশন ‘ক্যালিপসো হিট ওয়েভে’ অংশ নিলেন। সদস্য হলেন হারলেম রাইটার গিল্ডের। পুরনো এক কাহিনির ভিত্তিতে রচিত ‘পার্পল অনিয়ন’ নামের গণজাগরণমূলক ক্যাবারেতে অংশ নিতে ফিরেন সানফ্রান্সিসকো।

১৯৬০ সালে তিনি চলে গেলেন মিসরের কায়রো। সেখানে তিনি ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘আরব অবজারভার’-এর এডিটর হিসেবে নিযুক্ত হলেন। পরের বছর আবার চলে গেলেন ঘানায়, ঘানায়নিয়ান নিউজে কাজ করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেন। ঘানায় বসবাসকালীন সময়ে নেলসন ম্যান্ডেলা হয়ে উঠেছিলেন আজীবনের বন্ধু। সেখানে ঘানা ইউনিভার্সিটিতে কাজ করার সময় পরিচয় হলো ম্যালকম এক্সের সঙ্গে। তার সঙ্গে কাজ শুরু করে ফিরে এলেন দেশে। তখন ৬০-এর দশকে আমেরিকা হয়ে উঠেছে উত্তাল।

বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকটি আমেরিকানরইতিহাসে যুগপৎ অগ্নিগর্ভ ও রক্তাক্ত অধ্যায়। দেশব্যাপী চলছে কালো মানুষের অধিকার দাবি করা রক্তক্ষয়ী সিভিল রাইট মুভমেন্ট। ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বলে ড. মার্টিন লুথার কিং-ই তখন আমেরিকার পর্বত ও সমুদ্র মথিত করে শোনাচ্ছেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাম্যের বাণী। জন এফ কেনেডি, ম্যালকম এক্স, রবার্ট কেনেডি ও মার্টিন লুথার কিং নিহত হলেন এক সিরিজ হত্যাকাÐে। এ সময় আমেরিকা যুদ্ধ করছে ভিয়েতনামে। তার ফলশ্রæতিতে সমরাঙ্গণ থেকে দেশে আসছে অসংখ সৈনিকের মরদেহ। পুলিশী নির্যাতনের মুখে প্রতিদিন হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে লড়াইয়ের ময়দানে। বিশ্বখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করলে, তার টাইটেল কেড়ে নিয়ে পোরা হলো জেলে। এমন দশকের শেষ বছরে মায়া এঞ্জেলু যখন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন সিভিল রাইট এক্টিভিস্ট হিসেবে, তখন লেখা হয় ‘কেইজড্ বার্ড’-এর দুঃসাহসী আত্মজীবনী।

প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক জেমস বল্ডুইন মায়াকে তার আশ্চর্য জীবনকাহিনী নিয়ে লিখতে যুগিয়েছিলেন উৎসাহ-উদ্দীপনা। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি আরো বলেছিলেনÑ আত্মজীবনী নিয়ে সাহিত্য রচনা করা প্রায় দুঃসাধ্য। মায়ার উত্তর ছিলোÑ ‘আমি চেষ্টা করবো, কিন্তু সেটি কীভাবে সম্পন্ন হবে, আমি জানি না!’ তার পরেরটুকু এখন ইতিহাস!

৭ খণ্ডে লেখা ২০ শতকের এক কালো মেয়ের আত্মকাহিনী চাবুকের মতো ছুঁয়ে গিয়েছিলো পৃথিবীর সমস্ত বিবেককে। ১৯৭০ সালে ন্যাশনাল বুক এ্যাওয়ার্ড পাওয়া এই গ্রন্থটি দীর্ঘ সময়ব্যাপী ছিলো বেস্ট সেলার। এমনকি রচনাকালের দু’দশক পরেও ‘আমি জানি খাঁচাবন্দী পাখি কেন গায় গান’ বেস্ট সেলার তালিকার শীর্ষে পেয়েছিলো স্থান !

-নিউ ইয়র্ক।