আমি রাজাকার : যুদ্ধবিমুখ মুহম্মদ জাফর ইকবাল

এইচবি রিতা

রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার একটি কবিতায় লিখেছিলেন, “বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ।”
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১১ মে শুক্রবার যুগান্তর পত্রিকায় “আমি রাজাকার: একটি আলোকচিত্র” নামে একটি আর্টিক্যাল প্রকাশ করেন। আর্টিক্যালটি পড়লাম এবং খুবই হতাশ হলাম। ঘটনার সূত্র ধরে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে উল্টো পথে ঘটনা প্রবাহে ইন্দন যোগাতে তিনি যে দারুণ পটু সে কথা জানতাম। কিন্তু তিনি যে এতটা পটু তা জানতাম না।
কোটা আন্দোলনের সময় অনেক ছাত্র বুকের মধ্যে ” আমি রাজাকার” শব্দটি লিখে পথে নামায় তিনি দারুণভাবে হতাশ ও রাগান্বিত হয়েছেন। “আমি রাজাকার: একটি আলোকচিত্র” আর্টিক্যালটিতে তিনি লিখেছেন, “যখন দেখি একজন ছাত্র নিজের বুকে ‘আমি রাজাকার’ কথাটি লিখে গর্বভরে দাঁড়িয়ে আছে, আমি সেটি বিশ্বাস করতে পারিনি। মাথায় আগুন ধরে যাওয়া বলে একটা কথা আছে, এই কথাটির প্রকৃত অর্থ কী আমি ওই ছবিটি দেখে প্রথমবার সেটি অনুভব করেছি।”
তিনি বলেছেন, “কোটাবিরোধী আন্দোলন করে যে বাংলাদেশের মাটিতে নতুন রাজাকারের পুনর্জন্ম হয়েছে, এ দেশের তরুণরা নিজেদের রাজাকার হিসেবে পরিচয় দিয়ে গর্ব করতে শিখেছে, আমাদের সংবাদমাধ্যম সেই খবরটি আমাদের কেন জানাল না?”
জনাব জাফর ইকবাল দাবী করেন ছাত্ররা বুকের মধ্যে ‘আমি রাজাকার’ শব্দটা গর্বভরে লিখেছিলো। আসলেই কি তাই? ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা যে শব্দটি গর্ব করে নয় বরং চরম হতাশা ও ক্ষোভ থেকে শার্টের বুকে লিখে পথে নেমেছিল, সেই কথাটি জাফর ইকবালের মত একজন বিচক্ষণ ব্যক্তির না বুঝার কথা নয়। তাহলে তিনি কেন, কোন উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের এমন অপবাদ দিলেন? যে কথার প্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা এমন ন্যাক্কারজনক শ্লোগান বুকে ঝুলালো, জাফর সাহেব সেই বিষয়টি খুব কৌশলে এড়িয়ে গেলেন। কেন?
তিনি নিশ্চয়ই অবগত কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন নানান কটূক্তির শিকার হয়েছেন! তিনি জানেন কতটা রূঢ়তার সাথে সরকারি নিয়োগে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের তুলোধুনা করেছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। সংসদ অধিবেশনে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি যখন কোটা বিরোধী’ আন্দোলনকারীদের “রাজাকারের বাচ্চা” বলে অভিহিত করেন এবং মতলববাজ, জামায়াত-শিবির এজেন্টদের বিরুদ্ধে সামান্য শৈথিল্য দেখানো হবে না বলে হুমকি দেন, সংসদে আন্দোলনকারীদের ৮০ শতাংশ রাজাকারের বাচ্চা বলে অভিহিত করেন, তখন কোথায় ছিল জাফর সাহেবের চেতনা?
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম যখন বলেন, “কোটা বিরোধী” আন্দোলনের নেতারা “ছাত্র শিবির।” খাদ্যমন্ত্রী যখন বলেন, “কোটা বিরোধী’ আন্দোলনকারীরা পাকিস্তানীদের দোসর, কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে রাজাকারের সন্তানরা চাকরি ও প্রশাসনে আসতে চায়, রাজাকারের সন্তানরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অধিকার ছিনতাই করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছে, তখন কেন জাফর সাহেব প্রতিবাদ করেননি?
শুধু তাই নয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা রাজাকারের সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছেন শৈলকুপা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। ১৫ই এপ্রিল বিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে মুক্তিযোদ্ধাদের গণজমায়েত ও মিছিলে প্রধান অতিথি হয়ে যোগ দেয়া নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, “যেসব ছাত্র জামায়াত-শিবির, রাজাকারদের সন্তান, তাদের কি চাকরি দেওয়া উচিত?’ সমাবেশে ছয় দফা দাবিও তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে আছে-
# কোটা সংস্কারের নামে হত্যার গুজব ছড়িয়ে উস্কানি দিয়ে যারা অরাজকতা সৃষ্টি করেছে, তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
# জামায়াত-শিবির-রাজাকার সন্তানদের চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ করতে হবে।
# স্বাধীনতাবিরোধীরা যারা সরকারি চাকরিতে বহাল থেকে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত করছে ও মুক্তিযুদ্ধ এবং সরকারবিরোধী নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে, তাদের খুঁজে বের করে চাকরি হতে অপসারণ করতে হবে।
# যুদ্ধাপরাধীদের সব অস্থাবর-স্থাবর সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
#. ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে আন্দোলনের নামে যারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছে এবং বেসরকারি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে, স্পেশাল ট্রাইবুন্যাল গঠন করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
#. মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ক্ষুণœকারী ও মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষকারীদের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের হলোকাস্ট বা জেনোসাইড ডিনাইল লর আদলে আইন প্রণয়ন করে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
শিক্ষার্থীরা যে গর্ব করে নয় বরং অপমান, লজ্জা ও ক্ষোভের দরুন এমন শ্লোগান বুকে ঝুলিয়েছেন তা জাফর সাহেব বুঝতে না পারলেও ( ঘুমের ভান করে থাকা মানুষকে জাগানো অসম্ভব) জ্ঞানী বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে আমজনতা সকলেই বুঝতে পেরেছেন। আপনি পুকুরে ওজু করতে আসা মানুষের সৎ উদ্দেশ্যকে বানচাল করে বার বার যদি বলেন সে চুরি করে নোংরা হাত মুখ ধুতে এসেছে, তবে একসময় সে ক্ষিপ্ত হতে বাধ্য এবং “হ্যা! আমি চুরি করে এসেছি” বলাও অসম্ভব কিছু নয়। প্রত্যেকটি মানুষ নিজ নিজ স্বকীয়তায় ভিন্ন। আপনি যে কোন দুঃসময় হয়তো শান্ত মাথায় মোকাবেলা করতে পারেন। আপনার ধৈর্য অসীম। আবার অন্য কেউ হয়তো দুঃসময়ে আপনার মত বিচক্ষণতার পরিচয় দিবেনা। শিক্ষার্থীদের বুকে “আমি রাজাকার” লিখাটি দেখা কারো জন্য সুখকর কোন উপলদ্ধি নয়। কিন্তু এমন শ্লোগান আজ কেন তাদের বুকে, সেটার কারণ খতিয়ে দেখা একজন সচেতন ও বিচক্ষণ নাগরিকের দায়িত্ব যার পুরো উল্টোটা করে অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন জাফর সাহেব।
জাফর সাহেব তার আর্টিক্যালে লিখেছেন, “ঢাকা শহরের মানুষকে জিম্মি করে আন্দোলন করার জন্য আমি যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে সপ্তাহ দুয়েক আগে একটি লেখা লিখেছিলাম। সেই সময়ে আমার মেয়ে হাসপাতালে ছিল। তাই ঢাকাশহরকে জিম্মি করে ফেললে হাসপাতালে রোগীদের কী ধরনের কষ্ট হয় আমি নিজে সেটি জানতে পেরেছি।”
তার মানে, ঐ সময় তার মেয়ে হাসপাতালে ছিলো বলে তিনি ঢাকাবাসীর কষ্টটা বুঝছেন। তার মেয়ে হাসপাতালে না থাকলে তিনি বিষয়টি বুঝতেন না। যখন ঢাকা শাহবাগে মাসের পর পর মাস রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন চলছিলো, তখন তিনিও কিন্তু সেই আন্দোলনে ছিলেন! সে সময় ঐ এলাকায় মিডফোর্ড, বারডেমসহ ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তখন কেন তার চেনা জাগ্রত হয়নি?
জাফর সাহেব লিখেছেন, “তাড়া খাওয়া পশুর মতো দেশের নানা জায়গা ঘুরে শেষ পর্যন্ত ঢাকা এসে আশ্রয় নিয়েছি। তখন দেশের অন্য যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময় পাকিস্তান মিলিটারি যে কোনো মানুষকে অবলীলায় মেরে ফেলতে পারত। সেই হিসেবে ঢাকা শহর খানিকটা নিরাপদ।” জাফর ইকবাল যদি জন্মগ্রহন করেন ১৯৫২ সালে তবে ১৯৭১ সালে তার বয়স ১৯ বছর। যুবক হওয়া সত্ত্বেও যিনি যুদ্ধে যাননি, পালিয়ে বেড়িয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। সেই যুদ্ধবিমুখ জাফর ইকবাল যখন আজ আমাদের যুদ্ধের গল্প শোনান, আমাদের রাজাকারের সংজ্ঞা দেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে বিনোদন যোগায়।
মহানবী (সাঃ) কে নিয়ে ২০০৭ সালে প্রথম আলোর ম্যাগাজিন আলপিনে যে ব্যঙ্গচিত্র ছাপানো হয়েছিল, যেই ব্যঙ্গচিত্র ছাপানোর পর দেশে-বিদেশে প্রতিবাদ-আন্দোলনের ঝড় উঠেছিল, যেই কার্টুন ছাপানোর অপরাধে আলপিন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে প্রকাশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হয়েছিল, সেই ব্যঙ্গচিত্রটি যদি জাফর সাহেবের কাছে “অত্যন্ত নিরীহ কার্টুন” বলে বিবেচিত হয়, তবে বুঝুন তিনি কত বড় জ্ঞানপাপী!
আসলে তারা মুখে বলে ছাত্ররা সৃজনশীল হোক কিন্তু বাস্তবে তারা চান বর্তমান প্রজন্ম যেন অন্ধের মত তাদের গোলামী করে। তারা যা বলবে তাই মুখ দিয়ে টিয়া পাখির মত আওড়াবে।
এ দেশের কোটি কোটি বেকার তরুণ সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী নয়। এরা সবাই স্বাধীনতা বিরোধী নয়। এরা জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, এ ধারণাও সত্য নয়। এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মনে-প্রাণে ধারণ করে। এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করেই নিজ অধিকার আদায়ে আন্দোলন করছে। এ সত্যকে মানতে হবে।-নিউইয়র্ক।