‘আমেরিকানরা ভালো নেই’-খুবই হতাশার কথা। আমেরিকা ৯০ দশক থেকে অর্থনৈতিক মন্দায় পতিত হলেও তা কাটিয়ে উঠতে শুরু করে ২০০৭ সালের শেষ দিক থেকে। এর ফলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও ফিরে আসতে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক পর্যায়ে চলে এসেছে। বেকারত্বের হার গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। তবু বলা হচ্ছে-আমেরিকানরা ভালো নেই। তারা আর্থিক সংকটে জর্জরিত।
মনে করা হয়, এ সংকটের জন্য দায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনব্যবস্থা। আর্থিক সুব্যবস্থার কথা প্রচার করে রিপাবলিকান দলীয় জনপ্রতিনিধি ও আইনসভার সদস্যমণ্ডলী মেডিকেইড, স্ন্যাপ, হাউজিং, আর্থিক সহযোগিতার মতো জনগণের বেশ কিছু সেফটি নেট সুবিধা প্রদান বাতিল করে দেওয়ার কর্মসূচি নিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য হইচই শুরু করে দিয়েছেন। এ রকম বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনভিত্তিক ‘দ্য আরবান ইনস্টিটিউট’ নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আমেরিকানদের প্রকৃত আর্থিক অবস্থার হালচাল তুলে ধরতে মাঠপর্যায়ে ৭ হাজার ৬০০ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকানের ওপর পর্যবেক্ষণ চালায় এবং সেই পর্যবেক্ষণের ফলাফল প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে আমেরিকার অর্থনীতির ভয়াবহ এক চিত্র উঠে এসেছে এবং মার্কিন জনসাধারণের যে আর্থিক দুর্গতি, তা-ও প্রকাশ পেয়েছে। ‘ভালো নেই আমেরিকানরা’-এ শিরোনামে ৩ কলামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে ঠিকানার ৭ সেপ্টেম্বর সংখ্যার প্রথম পাতায়। প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ আমেরিকান জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত। পরিবারের অপরিহার্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে তারা চোখে সরষে ফুল দেখছে। বিশ্ববাসীর চোখে আমেরিকা একটি ভূস্বর্গ এবং অতুলনীয় প্রাচুর্য ও বিত্ত-বৈভবের দেশ হলেও ওয়াশিংটনভিত্তিক ওই অলাভজনক সংস্থার জরিপ প্রতিবেদনে আজকের আমেরিকার এই হতাশাজনক চিত্র ফুটে ওঠে। অর্থনৈতিক সুস্থিতি ও তেজিভাব ফিরে আসার পরও জীবনধারণের জন্য প্রাত্যহিক খাবার, স্বাস্থ্য পরিষেবা, আবাসন, ইউটিলিটির মতো বিভিন্ন মৌলিক উপাদান ও নিত্যনৈমিত্তিক চাহিদা পূরণ করতে আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মানুষই রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। নিম্ন আয়ের কিংবা স্বাস্থ্য সমস্যাগ্রস্ত প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকানরা একেবারে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে।
উল্লেখ্য, আমেরিকা অভিবাসীর দেশ। অভিবাসী নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্পের নীতি যতই কঠোর ও অমানবিক হোক, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিনই হাজার হাজার ভাগ্যান্বেষী মানুষ বৈধ-অবৈধ পন্থায় আমেরিকার সীমান্তে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। অভিবাসী এই স্রোত সম্পূর্ণরূপে আমেরিকায় প্রবেশের সুযোগ না পেলেও যতটুকু ঢুকছে, তাতেই আমেরিকার নাজুক অবস্থাকে আরও নাজুক করে তুলছে।
প্রতিবেদনটিতে যে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে, তাতে আরও দেখা যায়, শুধু ৪০ শতাংশ নয়, সর্বস্তরের আমেরিকানরাই সামগ্রিক অর্থে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ভোগ করছেন। ওই যে কথায় আছে, নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না! তেমনি শরীরের একটি অংশে ক্ষত সৃষ্টি হলে সেই ক্ষতে সমগ্র দেহটিই জ্বলতে থাকে। আমেরিকার আজকের অবস্থা অনেকটা তেমনই। চাকরি কিংবা কাজ থাকলেও আমেরিকানদের জীবনযাত্রার ব্যয় সঠিকভাবে নির্বাহের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
বিশ্লেষকদের হিসাবমতে, যে পরিবার একজন প্রাপ্তবয়স্কের উপার্জনের ওপর নির্ভর করে, তাদের মধ্যে ৩০ ভাগের বেশি পরিবার অর্থনৈতিক দুর্ভোগের শিকার। এ রকম অবস্থায় অর্থনৈতিক গবেষকেরা বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিংবা বেকারত্ব হ্রাস-কোনোটাই আমেরিকানদের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২৩ জনের বেশি আমেরিকান বছরের কোনো না কোনো সময় পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনীয় গ্রাসের জোগান দিতে চরম বেকায়দায় পড়েছেন। মেডিকেল বিল পরিশোধে চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হয়েছেন ১৮ ভাগ উত্তরদাতা। চিকিৎসার অর্থ জোগাতে না পেরে ১৮ ভাগ উত্তরদাতা চিকিৎসকের কাছেই যাননি। ১৩ ভাগ উত্তরদাতা অনেক সময় ইউটিলিটি বিল পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছেন। ১০ ভাগ উত্তরদাতা সময়মতো হাউসরেন্ট বা মর্টগেজ দিতে পারেননি।
আমেরিকার এ রকম পরিস্থিতিতে স্বভাবতই একটি প্রশ্ন দেখা দেয়। আমেরিকার মতো দেশে নাগরিকদের এ হাল কেন? বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ, বিত্ত-বৈভব, প্রাচুর্যে ভরা এই দেশে মন্দার সময়েও তো আমেরিকানদের মধ্যে আজকের মতো অভাব ও হতাশা দেখা যায়নি! খাবার জোটে না আমেরিকানদের-এমন কথা স্মরণকালে শোনা গেছে বলে জানা যায় না। এ রকম কথা এ দেশের মানুষকে কখনো শুনতে হবে, সে কথা কেউ কোনো দিন ভেবেছে বলেও মনে হয় না! আমেরিকাকে যে এককথায় মাইটি ও ওয়েলদি কান্ট্রি বলা হয়, তা অবশ্যই এমনি এমনি বলা হয় না। এখন পর্যন্ত কথাটা বিশ্বব্যাপী বিশ্বাসও করা হয়। সেই ক্ষমতা তারা বিভিন্ন দেশে দেখিয়েও থাকে। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়াসহ আরও বহু দেশে অতীতে, নিকট অতীতে ও বর্তমান সময়েও অনেক দেশ স্মরণ করে সমীহ না জানালেও শিউরে ওঠে। যদিও আজকের চীন অতীতের রাশিয়ার জায়গা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। তা সত্ত্বেও খাদ্যাভাবে ভুগবে প্রায় ৪০ শতাংশ আমেরিকান। এ ছাড়া বাড়ি ভাড়া দেওয়া, চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর সামর্থ্য হারাবে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আমেরিকানÑভাবা যায় না! তাহলে এত শক্তি-সামর্থ্য সত্ত্বেও আমেরিকানদের এ অবস্থা কেন?
অন্য সব প্রশ্নের যেমন উত্তর আছে, এ প্রশ্নেরও অবশ্যই উত্তর আছে। খুব গভীরে গিয়ে যারা গবেষণা করেন, তারা নিশ্চয় এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করবেন। তবে সাধারণভাবে সাধারণ মানুষ মনে করে, আমেরিকার এই বিবর্ণ অবস্থার কারণ বর্তমান বাস্তবতার মধ্যেই নিহিত আছে। সেই বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে দেশ শাসনের একরকম নৈরাজ্য। শুরু থেকেই কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী ধরনের শাসন উপহার দেবেন আমেরিকানদের। তিনি যে সাধারণ মার্কিনদের জন্য প্রেসিডেন্ট হননি, বিশেষ করে এ দেশের উন্নয়নের মূল শক্তি ইমিগ্র্যান্টদের প্রেসিডেন্ট নন, তা প্রথমেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। ‘আমেরিকানরা ভালো নেই’-এ তারই ফল।
একটি দেশ, একটি দেশের মানুষ ভালো এমনি এমনি থাকে না। ভালো থাকে, যদি সেই দেশে থাকে সুশাসন। আবার সুশাসন কখনো আকাশ থেকে পড়ে না। সুশাসনের জন্য লাগে সুশাসক। সুশাসকও কেউ দাবি করলেই হয়ে যান না। সুশাসক হয়ে উঠতে হয় মেধা, প্রজ্ঞা, সততা ও দেশের মানুষের ভালোবাসা অর্জনের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা ধন-সম্পদ আর একগুঁয়েমি দিয়ে অর্জন করা যায় না। নাগরিকদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ না করার অঙ্গীকার লাগে। যে গুণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। সব নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা এবং বৈষম্যহীন আচরণে ন্যায়বিচার অপরিহার্য। এসব নিরঙ্কুশ করতে হলে গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতা লাগে। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, জনগণের প্রতি ভালোবাসা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নেই তো, দেশ ভালো নেই। দেশের মানুষ ভালো নেই।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে আমেরিকায় এ রকম এক অবস্থাই বিরাজ করছে বলে অভিজ্ঞজনেরা মনে করছেন। আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি কথা এবং হইচই হয় ইমিগ্রেশন নিয়ে। ইমিগ্র্যান্টদের দেশ মনে করা হয় আমেরিকাকে। পরিশ্রমের যত কাজ আছে, তা ইমিগ্র্যান্টরাই করে থাকে বলে সবাই মনে করে। এমনকি মেধার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজেও আমেরিকাকে বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেই ইমিগ্রেশন নীতি এখন অস্থিরতায় আক্রান্ত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইমিগ্রেশন নিয়ে কখন কী করে বসেন, তা নিয়ে আমেরিকার মানুষ সর্বক্ষণ একটা দুশ্চিন্তায় ভোগে। মি. ট্রাম্প কখন যে কী ঘোষণা দেন, তার কোনো ঠিক নেই! প্রশাসনেও একই অবস্থা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিজের সাজানো প্রশাসনের ওপরও তিনি আস্থা রাখতে পারেন না। তাই প্রশাসনে অস্থিরতা। প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধ লেগেই আছে প্রেসিডেন্টের। আদালতও মানতে পারেন না প্রেসিডেন্টের খামখেয়ালিতে ভরা সব সিদ্ধান্ত। অ্যাটর্নি জেনারেল তার কথায় চলতে পারেন না। একে পদত্যাগ করান, ওকে নিয়োগ দেন। এমনকি তার কাজকর্ম তার স্ত্রী-কন্যাও সমর্থন করতে পারেন না।
এ রকম পরিস্থিতিতে কখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, আর জনগণের ভেতরে এবং প্রশাসনেও সুস্থিতি আসে না। এ অবস্থায় জনগণ ভালো থাকে না। আমেরিকার জনগণকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে হলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিজের মধ্যে স্থিতি আনতে হবে। এমন পরিবেশ আনতে হবে, যাতে দেশের মানুষ অস্থিরতা ও আতঙ্কে না ভোগে। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে না পারলে একসময় দেখা যবে ৪০ শতাংশের সূচক আরও ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে।