আমেরিকার গল্প ও জ্যাকসন হাইটস

লিয়াকত হোসেন

আমেরিকার গল্পের শুরু Esta নিয়ে।
এর আগে কয়েকবার আমেরিকা গিয়েছি ভিসা বা এস্টার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু এবার যাত্রার আগেই জানতে পেলাম এস্টার কথা। অন লাইনে এস্টা নামে একটি ফরম ফিলআপ করতে হবে; না হলে ইমিগ্রেশান আমেরিকার মাটিতে প্রবেশ করতে দেবে না। এস্টা অর্থৎ ইলেকট্রনিক সিস্টেম ফর ট্র্যাভেল অথরাইজেশান। দুর্বল দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালের বারই জানুয়ারি হতে এস্টা প্রবর্তন করা হয়। এস্টা একটি অনুমোদিত ব্যবস্থাপত্র। ভিসার সঙ্গে এস্টার কোন সর্ম্পক নেই। তবে এই ব্যবস্থা পত্রের জন্য অন লাইনে বিশেষ মূল্য পরিশোধ করতে হয়। কয়েকজনের কাছে জানার চেষ্টা করেও বিশেষ মূল্যের বিষয়টি সঠিকভাবে জানতে পারিনি। যাহোক ধীরে ধীরে আমেরিকা ভ্রমণের সময় ঘনিয়ে এলো। ফিন এয়ারে টিকেট করা ছিলো। প্রায় প্রতি সপ্তাহে এয়ার লাইন্স হতে মেইল আসতে লাগলো। মেইলের ভাষ্য, তোমার যাত্রার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি, এস্টা পূরণ করা না থাকলে করে নাও। মেইলের সঙ্গে এয়ার লাইন্স এস্টার জন্য একটি লিংক ও পাঠালেন।
তথ্যানুযায়ী আমেরিকার বিভিন্ন এয়ারর্পোট দিয়ে প্রতিদিন এক মিলিয়ন যাত্রী বিভিন্ন দেশ হতে আমেরিকায় প্রবেশ করেন। সে এক বিশাল ব্যাপার। আমেরিকান হোল্যান্ড সিকিউরিটি ২০০৯ সালে বিভিন্ন দেশের যাত্রীদের ক্যাটাগরী বিন্যাশ করে। এই বিন্যাশে মাত্র ৩৮টি দেশকে বিশেষ মর্যাদায় Visa Waiver Program এ ফেলা হয়। এই ৩৮টি দেশের কোন ভিসা লাগবেনা এবং ৯০ দিন পর্যন্ত আমেরিকায় অবস্থান করতে পারবে। বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ৩৮টি দেশের মধ্যে সুইডেনও একটি। তবে অন্য দেশ গুলোর ক্ষেত্রে পাসপোর্টের ভেলিডিটির ছয় মাস পূর্বে আমেরিকা ত্যাগ করতে হয়; কিন্তু সুইডেনের ক্ষেত্রে ছয় মাসের ব্যারিয়ারটি নেই। তবে সব দেশের জন্য এস্টা বাধ্যতামূলক এবং এস্টার ভেলিডিটি ২ বছর।
আমেরিকা যাওয়ার দুসপ্তাহ আগে এয়ার লাইন্স পাঠানো লিংকে এস্টা করার জন্য অন লাইনে যেতে হল। নাম ঠিকানা পাসপোর্ট নাম্বার সহ ফরম ফিলআপ করার পর এস্টা প্রসেসে এজেন্সি ক্রেডিট কার্ডে চার্জ করলেন ৮৬ ডলার। পরদিন এজেন্সি হতে মেইল এলো পাসপোর্ট অনুযায়ী নাম ঠিকানাগুলো সঠিকভাবে লিখে জানানোর। সব চেক করে মেইল পাঠাতেই কিছুক্ষণের মধ্যে উত্তর এলো এস্টা অনুমোদিত হয়েছে, আমেরিকা যাত্রায় কোন বাধা নেই। মন খুশীতে ভরে উঠলো। তবে এস্টা ফরমটি প্রিন্ট আউট করে চেক করতে গিয়ে দেখি চার্জ উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ১৪ ডলার। তাহলে এজেন্সি ৭২ ডলার বেশি নিয়েছে! এটাকি ঠিক? ভাবতে ভাবতেই এজেন্সিকে মেইল পাঠালাম অসঙ্গতির বিষয়টি জানতে চেয়ে। মিনিট তিনেকের মধ্যেই এজেন্সি জানালো, তারা একটি বেসরকারী এজেন্সি তাই প্রসেস ফি একটু বেশি। এটাও এক ধরনের হাতিয়ে নেয়া। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির বিদেশ যাত্রীদের উপর বিশেষ নিয়ন্ত্রণ থাকলেও এস্টা এজেন্সির উপর নিয়ন্ত্রণ নেই।
ওয়েব সাইটে ঘুরতে ঘুরতেই অল এবাউট নিউইর্য়ক নামে একটি সুইডিশ ওয়েব সাইটের সন্ধান পেলাম। সেখানে বিস্তারিত জানতে পেলাম, বিভিন্ন বেসরকারী এজেন্সি এস্টা প্রসেস করে দিচ্ছে ঠিকই তবে কোন কোন এজেন্সি নিচ্ছে ৭২ ডলার কেউবা ৮৬, কেউবা ১১৪ ডলার। তবে এজেন্সির মাধ্যমে না যেয়ে যদি নিজেই তথ্য গুলো পূরণ করে পাঠান যায় তবে চার্জ লাগছে মাত্র ১৪ ডলার। তবে এই জন্য আছে আমেরিকান হোমল্যান্ড সিকিউরিটির নিজহ্য ওয়েব সাইট।
১৪ই মে নির্ধারিত সময়ে নিউইর্য়ক জেএফকে বিমান বন্দরে ফিন এয়ারের বিমান ল্যান্ড করার পর বেল্ট হতে লাগেজ সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশান ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেলাম। ডেস্কে যাবার আগেই একটি স্বয়ংকৃত মেশিনের কাছে যেতে হল। একজন সাহায্যকারী এগিয়ে এসে জানালেন স্বয়ংকৃত মেশিনে কিছু প্রসেস করতে হবে। তারপর মেশিন হতে প্রসবকৃত স্লিপ নিয়ে ইমিগ্রেশান ডেস্কে যেতে হবে। স্বয়ংকৃত মেশিনে পাসর্পোট স্ক্যান করা হলো, প্রথমে চার আঙ্গুল পরে বুড়ো আঙ্গুল সহ পাঁচ পাঁচ দশ আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হলো। স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরায় মুখ ও চোখের ছবি তোলার পর ও সবুজ বাতি জ্বলার পর স্বয়ংক্রিয় মেশিন একটি স্লিপ প্রসব করলেন। সেটি হাতে নিয়ে পাঁচ কদম দূরে ইমিগ্রেশন ডেস্কে গিয়ে দাঁড়ালাম। ডেস্কের ভেতরে বসা অফিসারটি স্লিপ আর পাসর্পোট হাতে নিয়ে এক নজর দেখে আবার পাসর্পোট স্ক্যান ও দশ আঙ্গুলের ছাপ, চোখ ও মুখের ছবি তুলে পাসপোর্টে সীল দিলেন। ক্ষুব্ধ মনের ভেতর একটি প্রশ্ন জেগে উঠলো, একই কাজ দুবার করা হলো কেন? তাহলেতো সুইডিশ এয়ারপোর্টগুলোয় শুধু আমেরিকান যাত্রীদের জন্য এই অবমাননাকর নিয়মটি চালু করা যেতে পারে!
জেএফকের আট নাম্বার র্টামিনাল থেকে বের হতেই টিনা এগিয়ে এলো। সেজ আপার বড় মেয়ে টিনা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট করছে। সে ওর গাড়িতে আমাদের নিয়ে ছুটে চললো ফিলাডেলফিয়ায়। নিউইর্য়ক হতে ফিলাডেলফিয়ার দূরত্ব ১৫১ কিলোমিটার, যেতে লাগে প্রায় পৌনে দুঘন্টা। সেজো আপা-দুলাভাই থাকেন ফিলাডেলফিয়ায়, ওখানেই আমাদের যাত্রা। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, আমেরিকার হাইওয়ে গুলো সুইডেনের মতো দুধারে নিয়ন লাইটের ব্যবস্থা নেই। আলো আধাঁরে ছুটে চলেছে টিনার টয়োটা ফোর হুইল। ফিলাডেলফিয়া পৌঁছার দুদিন পরই রোজা শুরু হলো। তবে এ’জন্য কোন অসুবিধে হয়নি আর রোজাও সুইডেনের মতো র্দীঘ নয়। আমাদের আগমন উপলক্ষে আপা-দুলাভাই বিশাল এক পার্টির আয়োজন করলেন। আমেরিকায় অবস্থানরত প্রায় সব আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে র্দীঘ দিন পর সাক্ষাৎ ভালোই লাগলো। আর সময় ও সুযোগমত ফিলাডেলফিয়া ও নিউজার্সীতে আমেরিকা ও ব্রিটিশ যুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান গুলো দর্শন করে বেড়াতে সময় কাটাতে লাগলাম। ফিলাডেলফিয়া হতেই আমেরিকার স্বাধীনতার সূর্য উঠেছিলো। ব্রিটিশদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষয়ী যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজিত করে আমেরিকা স্বাধীনতা পেয়েছিলো সে প্রায় ১৭৭৫ সালের কথা।
আগেই প্রোগ্রাম ঠিক করা ছিলো যে স্টকহোম ফেরার পথে আমরা নিউ ইর্য়ক হয়ে ফিরবো। ফিলাডেলফিয়ায় বেশ কয়েকটি দিন আনন্দে কাটিয়ে চব্বিশ তারিখ রাত দশটায় নিউ ইর্য়ক এসে পৌঁছুলাম। সেজো আপার মেঝো মেয়ে টিসা সারাটা পথ ড্রাইভ করে নিয়ে এলো। টিসা খুব ভালো ড্রাইভ করে। নিউ জার্সিতে বিরাট জায়গা নিয়ে গাছগাছালিতে পূর্ণ ওর গোছানো বাড়িটি খুবই দৃষ্টিনন্দন। নিউ র্জাসিতে থাকে লিসা, ওর মেয়েটি দৌড়ে এসেই কোলে বসে যেতো। লিসার বাবা-মা এসেছেন বাংলাদেশ হতে। লিসার শ্বশুরবাড়িও ওর বাড়ির পাশেই। সবাইকে নিয়ে লিসা আর জো ভালই আছে।
নিউ ইর্য়কে এলাম টুসির বাসায়। সেজো আপার ছোট ও মিষ্টি মেয়ে টুসি। এক স্বনামধন্য ইন্সিউরেন্স কম্পানীতে তের বছর ধরে চাকরি করছে, নিউ ইর্য়কে বেশ বড় তিন রুমের এক এপার্টমেন্ট নিয়ে থাকে তবে ভাড়া নয়, কেনা। স্বামী হারসা ব্যবসায়ী। দুজনের সাজানো গোছানো ছোট সংসার। নিউ ইর্য়কে এর আগেও এসেছি, সেটা অনেকটা না আসার মতই। এবার টুসি ও হারসার একাগ্রতায় নিউ ইর্য়কের প্রসিদ্ধ স্থানগুলো দেখা হলো তার মধ্যে পয়েন্ট জিরো, সেন্ট্রাল পার্ক,টাইমস স্কোয়ার ও জ্যাকসান হাইট।
জ্যাকসান হাইট: জ্যাকসান হাইটের ইতিহাস খুব চমকপ্রদ। উনিশ শতকে জ্যাকসান হাইট এলাকাটি ছিলো বিস্তর প্রান্তর ও বিভিন্ন ফার্মে পূর্ণ। ১৯০৯ কুইন্সবরো কর্পোরেসান নামে একটি কোম্পানী ৩.৮ মিলিয়ন ডলারে বিস্তর এলাকাটি কিনে নিয়ে নিউ ইয়র্কের দক্ষিণে আমেরিকার মধ্যে সর্বপ্রথম গার্ডেন সিটি ও আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়। তৎকালীন ‘হান্টার পয়েন্ট’ কম্পানীর প্রেসিডেন্ট জন. সি জ্যাকসনের নামানুসারে এলাকাটির নাম হয় জ্যাকসান হাইট। ১৯১১ সালে প্রথম বিল্ডিং ও ১৯১৪ সালে প্রথম অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হয় জ্যাকসান হাইটে। ধীরে ধীরে লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে, বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষীরা এসে বসতি গড়ে তুলেন। ১৯৩০ সালে জ্যাকসান হাইটের লোকসখ্যা এসে দাড়ায় ৪৫ হাজারে। উনিশ শতকেই এশিয়বাসীদের আগমন। জ্যাকসান হাইট গড়ে তোলার পেছনে এডুর্য়াড ম্যাকডোগালের অবদান ব্যাপক, সত্তুর বছর বয়েসে এডুর্য়াডের মৃত্যুর পর তৎপুত্র হাল ধরেন। ১৯৯৩ সালে ডিস্ট্রিক হিসেবে স্বীকৃতি পায় জ্যাকসান হাইট। বর্তমানে জ্যাকসান হাইটে সত্তুরটি দেশের ১৬৭ টি বিভিন্ন ভাষাভাষীর বসবাস হলেও জ্যাকসান হাইট বলতে বাঙালি পাড়া বোঝায়।
নিউ ইর্য়কে পৌছার দুদিন পর জ্যাকসান হাইট দেখতে গেলাম।
রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। টুসি ও হারসা আমাদের পথপ্রর্দশক। জ্যাকসান হাইট লোকে লোকারণ্য। সত্যই এক বাঙালি পাড়া, নিউ ইর্য়কের ভেতর একটুকরো বাংলাদেশ। শাড়ি, সেলোয়ার কামিজ, লুঙ্গি, পায়জামা পরেই অনেকে চলাফেরা করছেন। প্রশস্ত রাস্তার ফুটপাতে তরিতরকারী শাকসবজির দোকান। দেশীয় আলতা সিঁদুর, চুড়ি, গামছার দোকান। রাস্তার দুধারে জুয়েলারী, পোশাক পরিচ্ছদ ও হোটেল রেস্তোরা। আমার পছন্দ লাউ দিয়ে চিংড়ি, সেজো আপা রাস্তায় দাঁড়িয়ে লাউয়ের দামদরে লেগে গেলেন। এদিক ও দিক তাকাতেই হঠাৎ করে দেখলাম কয়েকজনকে সঙ্গে করে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রক্তন গর্বনর জনাব আতিয়ার রহমান হেটে চলেছেন আমাদের পাশদিয়েই। মুক্তধারায় যাবার ইচ্ছে ছিলো, কয়েক জনকে প্রশ্ন করেও রাস্তার সন্ধান পেলাম না। যারা জানেন হয়তো তাদের প্রশ্ন করা হয়নি। জ্যাকসান হাইট দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে এলো, প্রিমিয়াম হোটেলের নামটি আগেই শুনেছিলাম, সেখানেই দেশীয় খাবারের ব্যাবস্থা হল।
প্রিমিয়াম হোটেলের সম্মুখ ভাগ খুব বড় নয় তবে ভেতরে লম্বা প্রচুর জায়গা। থরে থরে দেশীয় খাবার সাজানো, একদিকে ইফতারের সামগ্রী বিক্রয় হচ্ছে। আমরা সাতজনের একটি লম্বা টেবিলে গিয়ে বসলাম। তারপর বেছে বেছে মোরগ পোলাউ হতে শুরু করে মিষ্টান্ন পর্যন্ত যার যার পছন্দ মত খাবার টেবিলে এলো। সাত জনের উপযোগী প্রচুর উপাদেয় ও সুসসাদু খাবার। জ্যাকসান হাইট হতে বেশ কয়েকটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশ হয়, ‘ঠিকানার এক কপি কিনলাম প্রিমিয়াম হতেই, ১০৪ পৃষ্ঠার বেশ মোটা পত্রিকা। পত্রিকাটির গুরুত্ব বেশ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের দলীয় প্রধানরাও ‘ঠিকানা’য় প্রকাশিত সংবাদের গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
সুইডেন, স্টকহোম।