বাহারুল আলম :
সাম্প্রতিককালে মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন শত শত মানুষের অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ঘটনা মিডিয়াসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতারা বিষয়টি নিয়ে তেমন কিছু না বললেও রিপাবলিকান মহল ও এর সমর্থক মিডিয়া এহেন অবৈধ অনুপ্রবেশকে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বিরাট হুমকি হিসেবে বর্ণনা করে এটিকে একটি গুরুতর সংকট বলে উল্লেখ করেছে। তারা বাইডেন তথা ডেমোক্র্যাটদের নীতিকে এই সংকটের জন্য দায়ী করেন। অভিবাসনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের (Migrant) যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অবাধ প্রবাহ বন্ধ করার জন্য বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন।
ভবিষ্যতে এসব অভিবাসীকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভোটিং ব্লক হিসেবে ব্যবহার করা হবে বিবেচনা করে, তারা (ডেমোক্র্যাট) বিষয়টি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করছেন না বলে রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। এ বিষয়ে উভয় দলের অবস্থান সম্পর্কে জনৈক মার্কিন পর্যবেক্ষণের মন্তব্য হলো : ‘Republicans want you to be scared of immigrants, and Democrats want you to be scared of Republicans.’
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, গত দুই বছরে কমবেশি চার মিলিয়ন মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে। প্রাপ্ত তথ্যে প্রকাশ, সেন্ট্রাল, সাউথ ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, যেমন পেরু, নিকারাগুয়া, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া ইত্যাদি ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, হাইতি, বাংলাদেশ, চীনসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের নাগরিকেরা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ এহেন প্রবেশের ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটলেও বর্তমানে সে প্রবাহ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। যদিও এ নিয়ে এখনো মহলবিশেষের অপপ্রচারের কোনো কমতি নেই। তারা বিষয়টিকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থহাসিলের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাইছে। ট্রাম্পের আমলে জারিকৃত টাইটেল ৪২ নীতির মেয়াদ গত ১১ মে শেষ হলে অবৈধভাবে প্রবেশের ঘটনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ওই নীতিতে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়প্রার্থী মানুষকে তাদের আশ্রয় প্রার্থনার আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মেক্সিকোতে অবস্থানের বিধান চালু করা হয়েছিল। বর্তমান প্রশাসনের আমলে ১১ মের পর থেকে এ নিয়ম উঠে গেলে তারা যুক্তরাষ্ট্রে থেকেই তাদের আবেদনের ফলাফল জানতে সক্ষম হবেন। এই সুযোগ নেওয়ার জন্য বহু মানুষ তড়িঘড়ি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষজন মেক্সিকোতে এসে চার-পাঁচ দিন ধরে দেড়-দুই হাজার মাইলের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন। যাত্রাপথে ও নদী পার হতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়।
প্রধানত মেক্সিকো সীমান্তের রিওগ্রান্ড নদী উপত্যকার নিকটবর্তী মেক্সিকোর শহর ডেলরিও, এলপাসো, ঈগলপাস, ব্রাউন্সভিল ও অরিজোনার টুসান শহর এলাকায় অভিবাসীদের ব্যাপক সমাগম লক্ষ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের পর মার্কিন বর্ডার পেট্রলের লোকজন অভিবাসীদের নাম-পরিচয় লিখে ইমিগ্রেশন কোর্টে হাজিরার তারিখ জানিয়ে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে স্থান দেন। অনেকে অবশ্য প্রহরীদের নজর এড়িয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানকারী অভিবাসীদের অনেককে পরে টেক্সাস ও অন্যান্য রাজ্য সরকার বাসে উঠিয়ে অভিবাসীদের জন্য নিরাপদ ও অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন শহরে (Sanctuary City) পাঠিয়ে দেয়। এসব শহরের মধ্যে নিউইয়র্ক, শিকাগো, ওয়াশিংটন ডিসি, ডেনভার ও হিউস্টন অন্যতম। ডেমোক্র্যাট মেয়রদের দ্বারা শাসিত এসব শহর অভিবাসীদের স্বাগত জানিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ও হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে। তৎকালীন মেয়র এডকচ ১৯৮০’র দশকে নিউইয়র্ককে Sanctuary City হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাদের আশ্রয়দান ও হয়রানিবিহীনভাবে চলাফেরার অধিকার নিশ্চিত করেন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, নিউইয়র্কে এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার অভিবাসী এসেছেন। এত বিপুল সংখ্যক ব্যক্তির আশ্রয় ও ভরণপোষণ বাবদ নিউইয়র্ক সিটিকে প্রতিদিন পাঁচ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। এ বাবদ বিপুল অঙ্কের অর্থ জোগানের জন্য মেয়র এরিক অ্যাডামস রাজ্য ও ফেডারেল সরকারের সহায়তা কামনা করেছেন। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে এক বিলিয়ন ডলার সহায়তা দানের আশ্বাস দিয়েছে। মেয়র ফেডারেল সরকারের কাছে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। মেয়রের মতে, ফেডারেল সরকারের অনুসৃত নীতির কারণে যেহেতু এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, সে কারণে তাদের আশ্রয়দান ও ভরণপোষণের দায়দায়িত্ব তারা এড়িয়ে যেতে পারে না।
নিজ দেশ ছেড়ে কেউ সহজে দেশান্তরি হতে চান না। দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রতিহিংসা থেকে মুক্তি এবং নিজেদের ও সন্তানদের জন্য উন্নত জীবনের সন্ধানে মানুষ অন্য দেশে যেতে বাধ্য হয়।
কয়েক দিন আগে ১৯৯৬ সালে নির্মিত পর্তুগিজ চলচ্চিত্র ‘Cinco Dias, Cinco Noites’ দেখার সুযোগ হয়েছিল। সিনেমাটির বাংলা অর্থ হলো ‘পাঁচ দিন, পাঁচ রাত’। পর্তুগালে স্বৈরশাসন চলাকালে বহু মানুষকে জেলবন্দী করা হয়। পর্তুগিজ কমিউনিস্ট পার্টির তরুণ কর্মী আন্দ্রে তার সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে জেলবন্দী হন। কিছুদিন জেলে থাকার পর তিনি জেল থেকে পালাতে সক্ষম হন। এ সময় তার কয়েকজন সহকর্মী তাকে জানান, দেশে থাকা তার জন্য নিরাপদ হবে না। এ জন্য তারা তাকে স্পেনে চলে যেতে পরামর্শ দেন। লাম্বাকা নামের এক কুখ্যাত মানব পাচারকারীর সহায়তায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আন্দ্রে স্পেনে পাড়ি জমাতে সক্ষম হন।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করছি। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার অবস্থানকালে তাইয়েবা নামের এক আফগান মহিলা আইনজীবী ও তার স্বামী আলী মার্কিন সমর্থক হিসেবে কাজ করেন। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান ক্ষমতায় এলে তারা তাইয়েবা ও তার স্বামীকে হত্যার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে আসার জন্য তারা রিফিউজি কর্মসূচির আওতায় আবেদন করেন। কিন্তু সে আবেদনে সাড়া না পেয়ে নিজেদের জীবন বাঁচাতে তারা তাদের একমাত্র শিশুসন্তানকে নিয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে সম্প্রতি মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে সক্ষম হন। এটা না হলে তাদের জীবন যে বিপন্ন হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারী অভিবাসীদের অনেকেও অনুরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি, সেটা বলা যাবে না। অভিবাসীদের বিষয়টিকে আইনের জটিল গ্যাঁড়াকলে না ফেলে বরং রক্ত-মাংসের মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ভালো হবে বলে মনে করি।
যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসীদের দেশ। শ্বেতাঙ্গ-অশ্বেতাঙ্গ বিপুলসংখ্যক অভিবাসীর মেধা ও শ্রমে গড়ে উঠেছে এই দেশের সমৃদ্ধি ও শ্রেষ্ঠত্ব। বৈচিত্র্যের মধ্যে নিহিত রয়েছে এ দেশের সৌন্দর্য ও বিরাটত্ব। কর্মী সংকটের এ সময়ে অভিবাসীদের প্রতি বিরূপ আচরণ না করে তারা যাতে দেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা তথা অবদান রাখতে পারে, সেদিকে গুরুত্ব দিলে তা সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে মনে করি।
অভিবাসীদের আগমনের কারণে মহলবিশেষের Border is dissolved and the US civilization is under threat জাতীয় অপপ্রচার বন্ধ হওয়া উচিত বলে অনেকেই মনে করেন। নতুন আসা অভিবাসীরা যাতে তাদের জীবন-জীবিকা সুন্দরভাবে নির্বাহ করতে পারেন, সে লক্ষ্যে বিদ্যমান ইমিগ্রেশন নীতির প্রয়োজনীয় সংস্কারপূর্বক একটি পূর্ণাঙ্গ (ঈড়সঢ়ৎবযবহংরাব ওসসরমৎধঃরড়হ চড়ষরপু) নীতি প্রণয়ন সময়ের দাবি বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। এ লক্ষ্যে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
লেখক : কলামিস্ট।