আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস : সাংবিধানিক অঙ্গিকার ও আজকের বাস্তবতা

আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস ৪ জুলাই। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই। ২৪২ বছর আগের কথা। সব মানুষই স্বাধীনতা প্রিয়। ব্যক্তি হিসেবে সকল শৃঙ্খল থেকে মানুষ মুক্তি চায়। চলাফেরা, কথাবার্তা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি কোনো কিছুর বন্ধন নিয়ে চলতে নারাজ স্বাধীনচেতা মানুষ। সমাজ, রাষ্ট্র, পরদেশ কারও অধীনতা মানুষ মানে না। মানুষের আজন্ম আকাক্সক্ষা মুক্তি। সেই আকাক্সক্ষার প্রতিফলন আমেরিকায় স্বাধীনতা। তবে অবশ্যই গোলাপ বিছানো পথে এই স্বাধীনতা আসেনি।
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে- অনেক প্রাচীন কথা। তার চেয়েও প্রাচীন মানব সমাজের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা। আজকের সভ্য সমাজে স্বাধীনতা ভোগের সঙ্গে দায়িত্ব কর্তব্যের অনেক শর্ত যুক্ত হলেও মানুষ এক সময় অবাধ স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা নিয়েই নিজের গোত্রের, নিজের সমাজের, স্বাধীনতা চেয়েছে। শক্তির বিনিময়ে সেই স্বাধীনতা ভোগের চেষ্টা করেছে। অন্যের স্বাধীনতাকে কেয়ার করেনি। আধুনিক সভ্যযুগের স্বাধীনতার সংজ্ঞা পাল্টে গেছে।
এখন অন্যের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা জানিয়েই নিজের স্বাধীনতা ভোগ করতে হয়। তিন দার্শনিক হব্স, লক, রুশোর সোস্যাল কন্ট্রাক্ট থিওরি প্রবর্তনের পর থেকেই মানুষ পারস্পরিক স্বাধীনতা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যকে পালনীয় জ্ঞান করে আসছে। তাদের সামাজিক চুক্তি তত্ত্বের ভিন্নতা আছে। তবে ৩ জনের তত্ত্বেরই মূলকথা সামাজিক বন্ধন এবং সমাজে শান্তির সঙ্গে বসবাসের জন্য সমাজকে সুসংবদ্ধ করার, সুশৃঙ্খল পথে চলার জন্য নিয়ম-কানুন মেনে চলার শর্তের কথা বলা হয়েছে। শান্তি ও সভ্যতার কথা এবং বাসযোগ্য বিশ্বের ধারণা বুঝি হব্্স, লক, রুশোর সোস্যাল কন্ট্রাক্ট থিওরি থেকেই আমরা পেয়েছি। আজকের স্বাধীনতার অর্থ পরিষ্কার। অন্যের স্বাধীনতকে না মেনে নিজের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ করা যায় না। নিজের স্বাধীনতার আনন্দ পরিপূর্ণভাবে ভোগ করা যায় না। তা সত্ত্বেও কারও অধীনতা থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টা কখনও কোথাও সহজ হয়নি। কেননা স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা যেমন মনুষের মধ্যে রয়েছে, তেমনি মানুষকে শিকল পরিয়ে রাখার আনন্দও এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে প্রবল। তাইতো স্বাধীনতাকামী মানুষদের চিরদিনই দখলদার, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে, সৌভাগ্যের বরপুত্র দু-একটি দেশ ব্যতিরেকে। দু-চারটি হাতে গোনা দেশ টেবিলে বসে আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের সৌভাগ্য অর্জন করেছে। এর বাইরে সব দেশকেই স্বাধীনতার জন্য কমবেশি লড়াই করতে হয়েছে। ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। রক্ত ঝরাতে হয়েছে। জীবনও দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার প্রসঙ্গে ত্যাগ ও জীবনদানের প্রশ্নে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এখানে একটু তুলে ধরলে খুব বেশি অপ্রসাঙ্গিক হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল প্রায় ২৪ বছর পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে শাসিত হয়েছে। স্বাধীনতার আকাঙ্খা নিয়ে বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করে জীবন দিয়েও বাংলাদেশের মানুষ সেই ২৪ বছর ধরে পরাধীন জীবনযাপন করেছে এবং চরম শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্য ও তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর অমানবিক আচরণের শিকার হয়েছে। ২৪ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, নিপীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন লড়াই সংগ্রাম করেছে। জেল-জুলুম সয়েছে, জীবন দিয়েছে। অবশেষে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের জোয়াল হতে মুক্ত বাঙালিরা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সর্বাত্মক লড়াই মুক্তিযুুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে এবং প্রায় ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করে।
আমেরিকাও লড়াই সংগ্রামের দীর্ঘপথ ধরে বহু ত্যাগ স্বীকার করে ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই স্বাধীনতা অর্জন করে। তার আগে ২ জুলাই কনটিনেন্টাল কংগ্রেস স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। ২ দিন পর ৪ জুলাই সে সময় আমেরিকার মূল ১৩টি উপনিবেশ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমেরিকার হয়েছে। অনেক লড়াই সংগ্রাম এবং জীবনদানের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা সেই থেকে ৪ জুলাই উদযাপিত হয়ে আসছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে সবচেয়ে বড় ছুটির দিন ৪ জুলাই। সারাদেশের মানুষ ভিন্ন আমেজে, উচ্ছ্বাস আনন্দে উদযাপন করে নিজেদের স্বাধীনতা দিবস। স¥রণ করে ২৪২ বছরের আগে স্বাধীনতা অর্জনের সেই ঐতিহাসিক দিনটি। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ত্যাগী নির্ভীক সাহসী নেতাদের। লড়াকু মানুষদের।
এবারও স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে আমেরিকানরা আনন্দে মেতে উঠবে। মিলিয়ন ডলারের আতশবাজি পুড়বে। দোকানপাট, কাজকর্ম বন্ধ রেখে দল বেঁধে আনন্দ উপভোগ করবে ঘরে এবং বাইরে। বারবিকিউ পার্টি হবে পার্কে পার্কে। ভালো ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া হবে। এত কিছুর পরও এবার আমেরিকানদের ভিন্ন এক প্রেক্ষিতে উদযাপন করতে হবে স্বাধীনতা দিবস। আনন্দের পাশাপাশি একটি শ্রেণির কাছে স্বাধীনতা দিবস আসবে বিষাদ আর আতঙ্কের মধ্যে। সাম্য মৈত্রী আর স্বাধীনতার যে বাণী নিয়ে আমেরিকা উপনিবেশবাদের কবল থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তা যেন আজ অনেকটাই ফিকে। অর্জন করেছিল ক্ষমতা প্রদর্শনের অহঙ্কার আর বিশ্ব শাসনের গর্ব। বিশ্বের দুস্থ দুর্বল, আশ্রয়হীন মানুষকে আশ্রয়দানের আর স্বপ্নহীন মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর অঙ্গিকার নিয়ে আমেরিকার যে মহান সংবিধান একদা রচিত হয়েছিল সেই সংবিধান আজ লঙ্ঘিত। ক্ষত বিক্ষত।
আমেরিকায় স্ট্যাচু অব লিবার্টির পাদদেশে একদা আফ্রিকা থেকে শ্রমিক এসে পিঠে চাবুকের কষাঘাত সয়ে সয়ে এই আমেরিকাকে তিলোত্তমা হিসেবে গড়ে তুলেছিল এবং তাদের সেই কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ এই দেশকে অভিবাসীর দেশ বলে সংবিধানে অধিকার স্বীকৃত হলেও আজ তা এক ঝটকায় উড়িয়ে দেয়ার ভয়ঙ্কর প্রবণতা আমেরিকার মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্রাম্পের নৈরাজ্যকর আচরণে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের মানুষই নয়, বিশ্বের সব মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি যেন আমেরিকার সংবিধানে স্বীকৃত মানুষের সব অধিকার, ইমিগ্র্যান্টদের ইতিহাসকে অস্বীকার করে নতুন এক আমেরিকার আবাদ করতে চাচ্ছেন। আজ তাই মানুষ ট্রাম্পের পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট যারা মেধা দিয়ে, প্রজ্ঞা দিয়ে, সাহস দিয়ে জীবন দিয়ে ট্রাম্পদের মতো মানুষদের ইমিগ্র্যান্ট পিতা-মাতার জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে এদেশে ভাগ্য গড়ার অপার সুযোগ সৃষ্টি করে গেছেন, ট্রাম্পের মতো দু-চারজন অকৃতজ্ঞ মানুষ ব্যতীত সব ইমিগ্র্যান্ট গভীর কৃতজ্ঞতায় তাদের স্মরণ করছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আজ আমেরিকার সকল মূল্যবোধ, সকল বিশ্বাস, আদর্শ-অঙ্গিকার ধুলায় মিশিয়ে দিতে চাইছেন। তিনি আজ আমেরিকাকে ইমিগ্র্যান্টমুক্ত করতে চাইছেন চরম নিষ্ঠুরতায়। যাদের পূর্ব পুরুষদের হাতে নির্মিত হয়েছে ক্ষমতাধর আমেরিকা। আজ তিনি বিতাড়ণ করছে ইমিগ্র্যান্টদের। নিত্যনতুন আদেশ জারি করে, নিত্যনতুন ইমিগ্র্যান্ট বিরোধী পরিকল্পনা দিয়ে কখনও নির্বাহী আদেশে, কখনও আদালতের সহযোগিতায় অভিবাসী দলনের ব্যবস্থা করছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিষ্ঠুরতা থেকে শিশু-কিশোররা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। বাবা-মায়ের কোল থেকে তাদের কেড়ে নিয়ে বন্দি শিবিরে রাখা হচ্ছে। পিতা-মাতাকে বিতাড়িত করা হচ্ছে গ্রেট নেশন এবং অভিবাসীর দেশ, স্বপ্নপূরণ ও আশ্রয় লাভের দেশ আমেরিকা থেকে। যারা এই দেশের জন্ম দিয়েছেন, যারা ট্রাম্পের পূর্ব পুরুষদের আশ্রয় দিয়ে ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, ট্রাম্পের আচরণে সেই সব মহান নেতা জর্জ ওয়াশিংটন, জর্জ এডামস, থমাস জেফারসন, জেমস মেডিসন, এন্ড্রু জ্যাকসন, আব্রাহাম লিংকনদের চোখও সম্ভবত বিস্ময়ে কপালে ঠেকেছে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে শক্তিধরদের দম্ভ এবং অহঙ্কার ঠিক থাকলেও আমেরিকার মহত্ব গুণ আজ নিঃশেষিত। মানবাধিকারের গর্ব আজ চূর্ণ। ৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসটি উদযাপন তখনই সার্থক হবে যদি আমেরিকা তার মূল চেতনায় ফিরে আসতে পারে। নইলে জাকজমক, চাকচিক্য সবই থাকবে, মানবিক দিক থেকে আমেরিকা দরিদ্র থেকে যাবে। আমরা আশা করবো আমেরিকার সেই অবস্থা না হোক। আমেরিকা তার মূল চেতনা এবং সংবিধানের মূল ধারায় ফিরে আসবে দুনিয়ার আশাহত বঞ্চিত এবং স্বপ্নহীন মানুষদের প্রত্যাশা ও স্বপ্নের আশ্রয়স্থল হয়ে।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আমেরিকার সকল নাগরিক, বৈধ-অবৈধ সকল স্তরের মানুষ এবং ঠিকানার পাঠক, পৃষ্ঠপোষক, লেখক, শুভানুধ্যায়ী সকলকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।