আর কত দেরি

রওশন হক :

১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার পর নারী পরিচালিত সমিতির এক সভায় স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘কোনো জাতি কতটা উন্নত হয়েছে, তা বুঝতে হলে দেখতে হবে সেই জাতি নারীদের সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করছে।’ পুরুষদের স্বার্থে পরিচালিত বিধিবিধান, ধর্মীয় আচার আর আইন নারীদের সব সময় প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়। সমাজে নারীরা কখনো আপন ভাগ্য জয় করার সুযোগ তেমনভাবে পায় না। মনুসংহিতার তৃতীয় শ্লোকে উল্লেখ আছে, ‘পিতা রক্ষতি কৌমরে, ভর্তা রক্ষতি যৌবনে, রক্ষন্তি স্তবিরে পুত্র, ন স্ত্রী (শৈশবে রক্ষাকর্তা পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্র⎯স্ত্রী জাতির কোনো স্বাতন্ত্র্য নেই)। এভাবেই নারীরা পরনির্ভরশীলতার চারপাকে ঘুরপাক খায়। মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতি বৈদিক সনাতন ধর্মাবলম্বী অনুসারীদের অনুশাসনে ব্যবহৃত মুখ্য এক স্মৃতিগ্রন্থ।

কিছুদিন আগে মেয়ের নাসায় জয়েন নিয়ে বেশ আনন্দিত, গর্বিত ও আপ্লুত হয়ে খবরের কাগজে বুঁদ হয়ে ছিলাম। বেশি সময় মনে খুশি ধরে রাখতে পারলাম না। কারণ ঠিক সেই সময়টাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝালকাঠির একটা ভিডিও ঘুরে ঘুরে আসছিল। প্রথমে চোখ পড়লে মনে হয়েছিল, কোনো নাটকের কনে দেখার দৃশ্যায়ন। তা-ই যদি হতো, অনেক খুশি হতাম। মনে হতো নাটকের মাধ্যমে আদিম যুগের ছেলেপক্ষের কনে দেখার নিয়মের প্রতিবাদস্বরূপ নাটকের অংশবিশেষ। কিন্তু তা নয়, সেখানে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই, এক কন্যাদায়গ্রস্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত সুন্দরী মেয়েকে বরপক্ষের আত্মীয়স্বজন বিয়ের জন্য দেখতে এসেছেন। মধ্যবিত্ত পরিবার বলছি এই কারণে, ভিডিওতে মেয়ের পরিবারের সদস্যদের দেখা যাচ্ছে। টিন আর কাঠের তৈরি বেড়ার ঘর। মেয়েটির শাড়ি ছাড়া বাদবাকি স্বজনদের সাধারণ সুতির শাড়ি ও লুঙ্গির ওপর শার্ট পরা দেখতে পেয়েছি, যা কিনা আমাদের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের ছবি ধারণ করে।

তারা একে একে নানা রকম প্রশ্ন করছেন আর মেয়েটি উত্তর দিচ্ছে। একপর্যায়ে তার অনার্সের রেজাল্ট কেমন জানা হলো। এরপর কাগজে তার হাতের লেখা দেখা হলো। সে তার নাম-ঠিকানা লিখে সামনের টেবিলে রাখে। এতটুকু পর্যন্ত ঠিকই ছিল। এর পরের ঘটনা ছিল আমার কাছে অত্যন্ত অপমানজনক ও অসম্মানের। ভিডিওতে মেয়েটির হাত দুটো লম্বা করে ধরে আছেন বরপক্ষের মাঝবয়সী একজন পুরুষ। তিনি মেয়েটির হাত টিপতে থাকেন এবং টিপে টিপে হাতের রেখায় আঙুল থেকে তালুর রেখা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে শুরু করেন। মেয়েটি মনে হলো লজ্জায় হাত গুটিয়ে নিতে চাইলে বাধা না দিয়ে তার বাবা-মাসহ অন্য লোকজন বরপক্ষকে আরো ভালো করে হাতের রেখা দেখতে অনুরোধ করেন। মেয়েটি গুটিয়ে নেওয়া হাত আবারো এগিয়ে দেয় আর সেই লোকটি হাত ধরে দেখতে থাকে। এ যেন তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার চাইতেও জটিল কিছু। ভিডিওটি দেশে-বিদেশে লাখ লাখ মানুষ ভিউ করেছে এবং সবাই তার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। লাখো মানুষের কমেন্ট দেখে অনেকেই জানান, এখনো গ্রামে-গঞ্জে সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েদের এভাবেই হাতের রেখা পর্যবেক্ষণ করে তাদের বিয়ের কথা পাকাপাকি করা হয়। তাদের অন্যান্য রীতিনীতির মতো এটিও একটি রীতি।

সেদিনের ওসব দেখেশুনে আমার কষ্টে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। মন এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে মেয়েকে নিয়ে সকল খুশির ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। আমি কোথায় মেয়েকে নাসার বিজ্ঞানী তৈরি করার চেষ্টা করছি, সমানে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি! যে দেশের নারী প্রধানমন্ত্রী; বিরোধী দলের নেতা, স্পিকার, আর্মি অফিসার থেকে বিমান অফিসার, বিমানবালা থেকে পাইলট, রিকশা থেকে বাস এমনকি ট্রেনের ড্রাইভার পর্যন্ত নারী; সেই সমাজে এই যুগে এসেও যদি কোনো মেয়েকে হাতের রেখা দেখিয়ে বিয়ে করতে হয়, তাহলে বলতেই হয় কেন এ নারী জনম? আগেকার যুগে জন্মের পর মেয়ের মুখে লবণ দিয়ে মেরে ফেলা হতো বলে বইয়ে পড়েছি।

একবার মনে হলো সেই মনে হয় ভালো ছিল। আজকাল কিছু মানুষ কথায় কথায় হিজাব আর বোরকার দোষ খুঁজে পায়। হিজাবের আড়ালে কুসংস্কৃতি দেখি। তাহলে হাতের লেখা এবং রেখা দেখাকে কই বলা যাবে? এই অবস্থায় কার দোষ দেব? মেয়েটি তো সনাতন ধর্মের। কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবার হাত দেখিয়ে হোক বা অন্য কিছু, তারা মেয়ে বিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। পড়ালেখা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে চাকরি হয় না। সে ক্ষেত্রে মেয়ের পরিবারকে দোষ দেওয়া যায় কি? যায় না। সব সময়ই আমরা গলা উঁচিয়ে নারী স্বাধীনতা চাই। কিসের স্বাধীনতা? কীভাবে আসবে তা, সেসব নিয়ে আলোচনা শুধু গোলটেবিলেই। মাঝেমধ্যে অবস্থা বুঝে বেছে বেছে সুবিধামতো আমরা মেয়েদের ইস্যু নিয়ে প্রতিবাদ করি। মেয়েরাও যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। তারাও যেন টায়ার্ড না হলে এখনো এই সমাজে কোরবানির হাটে পশু তোলার মতো করে বিয়ের জন্য মানুষ তোলা হয়েছে। হাটে যেমন গরুর দাঁত দেখা হয়, টিপ দিয়ে দেখা হয়, তেমনি করে মেয়েটির হাত টিপে দেখা হচ্ছে। মেয়েটি অশিক্ষিত নয় কিন্তু অবাক হলাম মেয়েটি এবং তার পরিবারও এটি মেনে নিচ্ছে। সরকার দাবি করে, সমাজব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। শুধু উন্নয়ন। এই তার নমুনা? বিশ্ব সৃষ্টিতে নারী আর পুরুষের সমান হস্তক্ষেপ আছে। ‘নারী’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন :

‘বিশ্বে যা কিছু মহান/ সৃষ্টি চির কল্যাণকর / অর্ধেক তার করিয়াছে নারী/ অর্ধেক তার নর।’ অপরদিকে ‘মানসী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী/ পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি/ আপন অন্তর হতে।’ বেগম রোকেয়া মতিচূর গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহলে এখনো কেন এতটা বৈষম্য।’

মানবদরদি লেখক রাজেন্দ্রলাল মিত্র ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের প্রচণ্ড উত্তাপের মধ্যেও নারীসমাজের অধিকারের জন্য কলম ধরেছিলেন। ১৮৫৯ সালে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পদ্মিনী’ উপন্যাসে স্ত্রী-স্বাধীনতার যৌক্তিকতার কথা লিখেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে ১৮৬২ সালে নারীর শৌর্য-বীর্যের প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করেছিলেন। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডটঋ) ‘দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ রিপোর্ট ২০১৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন মতে, জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণে এগিয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সুযোগ, শিক্ষায় অর্জন এবং স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৭তম, শিক্ষায় ১১১তম। বলা হয়, জেন্ডার বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম এগিয়ে যাওয়া দেশ। বিশেষ করে, প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি সেকেন্ডারি শিক্ষায়ও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১২২তম। তবে বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো সাফল্য দেখা যায় রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বলা হয়, গত ২১ বছর ধরেই বাংলাদেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে নারী। তবে নারীদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা বা কোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তা হওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে।

কথা হলো বিয়ের জন্য হাতের রেখা পর্যবেক্ষণ যদি জরুরি হয়ে থাকে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনেই জেন্ডার সমতা অর্জন করা জরুরি। সেসব দেশই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে পারবে, যেসব দেশে নারী-পুরুষ মিলিয়ে সব মেধাবীই অর্থনীতিতে অবদান রাখার সমান সুযোগ পাবে। এ পরিপ্রেক্ষিত থেকে আমাদের দেশে নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলোকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করে দেখা দরকার। আমাদের সমাজে যেটা দরকার মেয়েমানুষ থেকে মানুষ হওয়া, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নয়, সামনের সারিতে উঠে আসা। মনে করানোর এই সংকল্প; নারীকে খাঁচাবন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে এই প্রস্তাব। পরিবারে নারীর উন্নতি না হলে পরিবারের উন্নতি হবে না। পরিবারের উন্নতি ব্যতিরেকে সমাজের উন্নতি কিছুতেই সম্ভব নয়; সমাজের উন্নতি বিনা জাতির উন্নতি অসম্ভব। যারা ভূমির চাইতে নারীর হাট বেশি বিস্তৃত করতে চান, তারা সাবধান! লাভ-জেহাদিদের ছোবল থেকে নারীকে বাঁচতে সহায়তা করুন; তাদের শারীরিক প্রশিক্ষণ দিতে বাবা-মা সহায়তা করুন। সর্বত্র কন্যার মানসিক শক্তি বাড়াতে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক-অধ্যাপকরা এগিয়ে আসুন। ঘর থেকে সমাজ নারীবান্ধব করে গড়ে তুলি।