মঈনুদ্দীন নাসের : বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে ভারতের সরকারি ও বেসরকারি মহল, মিডিয়া, চিন্তাবিদ ও গবেষক এবং ভারতীয় গণতান্ত্রিক ধ্বজাধারীরা এবার জোরে-সোরে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। একশ্রেণির তথাকথিত আওয়ামী লীগ সমর্থক নিজের আখের গোছানোর কাজে লিপ্ত লেখক ও সাংবাদিকরা যদিও
সাংবাদিকরা যদিও ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনকে সেক্যুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষতার এবং স্বাধীনতার সপক্ষের চেতনার পুনরুত্থান বলে অভিহিত করে সরকারি মহলের বাহবা নিতে চেয়েছেন, অন্যদিকে তাদের প্রিয় অন্যতম প্রতিবেশী ভারতের প্রচার মাধ্যম স্বদেশে ও বিদেশে বাংলাদেশে গণতন্ত্র টিকে থাকার বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের উলঙ্গ করে দিতে ছাড়েনি।
যেমন ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে ভারতের অন্যতম শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম দি হিন্দু পত্রিকায় পাক্ষিক ম্যাগাজিন ফ্রন্টলাইনে বাংলাদেশের ওপর দুটি পাশাপাশি আর্টিকেল ছাপা হয়। বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশি সাংবাদিকের একপেশে একটি রিপোর্ট ছাপানোর সাথে ফ্রন্ট লাইনের নিজস্ব সাংাদিক ঢাকা ঘুরে এসে যে রিপোর্ট দিয়েছেন তাও ছাপা হয়। ভারতীয় সাংবাদিকের লিখিত প্রতিবেদনে পরিষ্কার করে বলা হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট পরপর তিনবারের জন্য ক্ষমতায় গিয়েছে। কিন্তু একথা প্রতীয়মান করা কঠিন যে, বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র’ জাতীয় সংসদের ১১তম নির্বাচনের পর এর মেয়াদকাল পর্যন্ত টিকে থাকবে কিনা? কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পাঠানো রিপোর্টের কোথাও বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্পৃহার অন্যতম উপাদান যে সব সংস্কৃতির মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সর্বপ্রধান ছিল তার কোনো উল্লেখ নেই।
ফ্রন্টলাইনের সাংবাদিক আর কে রাধাকৃষ্ণ আরো লিখেন শাসকগোষ্ঠীর নেতৃত্বাধীন জোট প্রচার ও নির্বাচনের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল বলে দৃশ্যমান ছিল। সারাদেশে প্রধান বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তেমন কোনো প্রচার কাজ দেখা যায়নি। দেখা যায় বিরোধী প্রচারণা যাতে গতিবেগ না পায় সে জন্য ছিল সমন্বিত ও সুপরিকল্পিত প্রয়াস মাঠে ময়দানে। নির্বাচনের পূর্বে এবং নির্বাচনের দিনও মিডিয়ার ওপর ছিল প্রচ- নিষেধাজ্ঞা। কোনো কোনো বুথে ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে এবং এমনকি একটা সেন্টারে ১০০ ভাগ ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়। সম্ভবত নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব রিপোর্ট করতে বাংলাদেশ থেকে ফ্রন্টলাইনে সংবাদ প্রেরক সাহস পাননি। রাধাকৃষ্ণ লিখেন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী মাত্র ১২৩ ভোট পেয়েছেন। ভোটার টার্নটাউট তার এলাকার ৯৩ শতাংশ দেখানো হয়েছে। তিনি লিখেন বিএনপির অফিসে যেতে পথে পথে মোড়ে মোড়ে বাধা দিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তাকে আইডিকার্ড দেখাতে হয়েছে। তার গাড়ির নাম্বার টুকে রেখেছে এবং ড্রাইভারকে তিনি কোথায় যাচ্ছেন তা জিজ্ঞেস করেছেন। যদিও সে জায়গায় প্রতিবেদক আগেও গিয়েছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কো- চেয়ারম্যানের অফিসে যেতে তেমন কোনো বাধা পার হতে হয়নি।
তিনি হিন্দু পত্রিকা থেকে উল্লেখ করেছেন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৯৭ শতাংশ আসন পায়। আর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বলতে শুনেছেন, ‘এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলেছেন, বিরোধী দলকে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য ৫০-৬০ আসন দেয়া উচিত ছিল। এই রিপোর্টে শেখ হাসিনার হেফাজতের সাথে সখ্যতার বন্ধন মজবুতের প্রয়াসকেও কটাক্ষ করা হয়। ফ্রন্টলাইন যদিও বাংলাদেশ প্রতিনিধির রিপোর্টকে যথার্থ গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন, তারপরও তাদের নিজস্ব প্রতিবেদকের রিপোর্টে রোহিঙ্গা আশ্রয় দেয়ার প্রশংসা করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তথাপি তার মৌলবাদ ঘেঁষা রাজনৈতিক তৎপরতায় সমালোচনায় এবং একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় সন্দেহের বীজ রোপণ করে দেয়ার মধ্যে মিডিয়ায় অসন্তোষ ফুটে উঠেছে। এরপর সেখানে তার কোনো প্রতিবাদ ছাপা হয়নি। ভারত যদিও বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করার এবং ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তারপরও দেখা যায় ৮ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের যৌথ পরামর্শ কমিটির সভায় নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য ও কানেকটিভিটি বা আন্তদেশীয় সড়ক সংযোগ, উন্নয়ন অংশীদারিত্ব, পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এবং ভিসা ব্যবস্থা বা কনস্যুলার ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু তারপর দেখা যায় গত ৫ বছরে বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তারা ভারতে প্রশিক্ষণ ও পরবর্তী ছয় বছরে আরো ১৮০০ কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ছাড়া এমন কোনো সহযোগিতার ‘প্র¯্রবন’ ভারতের পক্ষ থেকে দেখা যায়নি। তারচেয়ে অনেক বেশি উৎসাহী দেখা গেছে চীনের ব্যাপারে ও চীনের বিষয়ে। প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রস্তাবিত ও অর্থায়নকৃত কানেকটিভিটির সাথে ভারতও যোগ দিতে পারেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। আবার বলেছেন, চীনের অর্থায়নে রেলওয়ে বাংলাদেশের ‘আখেরী স্টেশন’ দোহাজারী অতিক্রম করে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত পৌঁছবে। আর তাতে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের বিস্তৃতি নাফ নদী ডিঙিয়ে মিয়ানমার হয়ে হোচিমিন পর্যন্ত পৌঁছার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ তাতে যেভাবে নির্বাচনের ফলাফলকে ‘বাড়াবাড়ি’ মনে করছে সেভাবে ভারত চীনের সাথে বাংলাদেশের দহরম-মহরমকে বাড়াবাড়ি মনে করছে না তো?
তারপর গত ৭ জানুয়ারি ২০১৯ নির্বাচনের পরের সপ্তাহে আমেরিকার ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে ভারতীয় আমেরিকান লেখক সুমিত গাঙ্গুলী (যিনি আমেরিকার রাষ্ট্র্র বিজ্ঞান সার্কেলে একজন প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক) লিখেছেন, ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার সংবাদপত্রে মানুষ পূর্বদিন সাধারণ নির্বাচনের খবর দেখেছেন। চতুর্থবারের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেছেন, কিন্তু নির্বাচনকে বিরোধীরা ভোট ডাকাতির মাধ্যমে এক ‘ভুয়া’ নির্বাচনে পরিণত করা হয়েছে বলে সংবাপত্রে ও সংবাদ এজেন্সির খবরের প্রতি তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
সুমিত গাঙ্গুলী স্পষ্টতই মন্তব্য করেছেন, রুলিং পার্টি বা শাসক দল নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে মশকরা শুরু করেছে। তারা ইসলামী জঙ্গিদের পায়রবি করছে এবং দেশকে এক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করছে। সুমিত গাঙ্গুলী লিখেন, ‘নির্বাচনের পর দেশি-বিদেশি বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেন যে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু থেকে অনেক দূরে ছিল। তাদের এই অভিযোগ কিন্তু আওয়ামী লীগ নাকচ করে দেয়। বলা হয় তা নির্বাচনী ভুয়া প্রচারণা। তার পরিবর্তে আওয়ামী লীগ বলে নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য বিরোধী দল নিজেরাই দায়ী। শেখ হাসিনার সরকার বলে, এই ধরনের ব্যাপক সাড়া পাওয়ার কারণ হচ্ছে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের প্রধান নেতারা বলেন, বিরোধীরাই নির্বাচনী সন্ত্রাস করেছেন। কিন্তু সুমিত গাঙ্গুলী যিনি এখন ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়ারে অধিষ্ঠিত তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র গুটিয়ে যাচ্ছে। আর এই গণতন্ত্র গুটিয়ে যাওয়া প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়। যদিও বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতের প্রভাবে প্রভাবিত, এই দেশ জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ৮ম প্রধান দেশ। তাছাড়া বাংলাদেশ ইসলামিক দেশও বটে। এবং তা বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। ১৯৭১ সালে তা সেক্যুলার রিপাবলিকান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও ক্রমাগত তা ধর্মীয় প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে আর দেশের সামরিক ও বেসামরিক শাসকবৃন্দ ধর্মীয় উগ্রবাদীদের পিঠে হাত বুলিয়েছে তাদের সমর্থনের জন্য।
সুমিত গাঙ্গুলী বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোকে সামরিক শাসকদের ইসলামীকরণ নীতি, মৌলবাদী সংগঠন যেমন, জামাত উল মুজাহেদীন, হরকতুল জিহাদ আল ইসলামী, শাহাদাত ই আল হিকমা নামে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের উত্থানের কথা লিখেছে গত আওয়ামী শাসকের দশকে। এসব ধর্মীয় জঙ্গিদের ১৯৭১ সালের দালালদের কয়েকজনকে ফাঁসি কাষ্টে ঝুলানোর পরও এসব ধর্মীয় জঙ্গিরা সন্ত্রাস ভাবাপন্ন হয়েছে। সুমিত গাঙ্গুলী ২০১৬ সালের ঢাকায় হলি আর্টিজান বেকারিতে আক্রমণকে জামাতুল মুজাহেদীনের ওপর চাপিয়ে দেন। তিনি সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাস মান্নান ও তনয় মুজমদারকে বাংলাদেশি আমেরিকান ব্লগার অভিজিত রায়, ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস কারো খুনের বিচার কিংবা ন্যূনপক্ষে কাউকেও গ্রেফতার পর্যন্ত এ সরকার করেনি বলে দাবি করেন। তিনি মোদ্দা কথায় আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচন, সন্ত্রাস ও গুন্ডামীর প্রশ্রয় দান ইত্যাদিকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আধিপত্য নীতির কারণ বলে বর্ণনা করেন। আর এই নীতির কারণে দলটি এই ধরনের ধর্মীয় উগ্রবাদকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। আর তার পরিবর্তে ধর্মীয় মনোভাবের ভোটারদের কাছে টানতে বেশি উদ্যোগী হয়েছে।
তিনি লিখেন, নির্বাচনের প্রচারণার শেষ সপ্তাহেও বিরোধীদের হয়রানি করার কর্মকা- তুঙ্গে। তাছাড়াও অন্যান্য সরকারি কর্মকা-ের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় সরকার কর্তৃত্ববাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি নেত্রীকে জেলে পাঠিয়েছে অর্থ আত্মসাতের জন্য। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে তাকে অপসারণ বিএনপির জন্য উল্লেখযোগ্য অসুবিধাজনক। আর ঐক্যফ্রন্ট প্রচারে সরকারের অনুমোদন না পাওয়ায় নির্বাচনে সুবিধা করতে পারেনি।
রাষ্ট্রদূতের প্রতিবাদ
ফ্রন্টলাইন পত্রিকার প্রতিবেদনের কোনো প্রতিবাদ না পাওয়া গেলেও ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীন সুমিত গাঙ্গুলীর লেখার এক প্রতিবাদ দিয়েছেন। বলা হয় সুমিত গাঙ্গুলীর আর্টিকেল ভুল। তিনি বলেন, তার আর্টিকেল এক বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনের এক অযথার্থ ও অন্যায় বর্ণনা। যখন বলা হয় ধর্মীয় জঙ্গিবাদের নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের কোনো কৌশল নেই, তা ভুল। প্রতিবাদে বাংলাদেশে অপহরণের ব্যাপারেও এক বাক্য লেখা হয়। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দুর্নীতির কথা বলতে গিয়ে কানাডীয় মাউন্টেড পুলিশের খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এফিডেভিটের কথা বলা হয়। কিন্তু নির্বাচনের কারচুপির অভিযোগের ব্যাপারে তেমন কিছু বলা হয়নি।
ফরেন পলিসিতে যে সপ্তাহে সুমিত গাঙ্গুলীর প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে সে সপ্তাহের পূর্বের সপ্তাহে এই ম্যাগাজিনে শেখ হাসিনাকে বুদ্ধিমান রাষ্ট্রনায়কের একজনের মধ্যে ফেলেছে এ ম্যাগাজিন। কিন্তু পরের সপ্তাহে এই বর্ণনা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আওয়ামী লীগের শাসনে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে।
বাংলাদেশের নির্বাচনের পর সর্বপ্রথম নির্বাচনকে স্বীকৃতি দিয়েছে চীন। তারপর ভারত। কিন্তু ভারতপ্রেমী আওয়ামী লীগ নেতারা যারা আমেরিকায় বা বাংলাদেশে আছেন তা মানতে রাজি নয়। তারা ভারতের পক্ষে বলে চলছেন। কিন্তু ভারতের সাথে গণতান্ত্রিক বিশ্বের যে সখ্যতা, সে সখ্যতাকে ডিঙিয়ে কি আওয়ামী লীগ চীনের সাথে চলার নীতিকে ধরে এগুতে পারবে?