আশা-নিরাশার নির্বাচন ১৮ সেপ্টেম্বর

বাংলাদেশ সোসাইটি : মামলা-কাউন্টার মামলা

ঠিকানা রিপোর্ট : অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা, চলমান মামলা এবং কাউন্টার মামলায় চরম অনিশ্চয়তার পরও আশা-নিরাশার দোলাচলে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর রোববার নিউইয়র্কে প্রবাসীদের আমব্রেলা সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত নির্বাচন। এদিন নিউইয়র্ক সিটির পাঁচটি কেন্দ্রে সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলবে। মোট ২৭ হাজার ৫০০ জন সদস্য তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার কথা।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারের নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পড়বে, তা বলা যাচ্ছে না। কারণ, বারবার ভোট পিছিয়ে যাওয়ার কারণে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ কমেছে। অনেক ভোটার করোনার কারণে নিউইয়র্ক সিটি ছেড়ে গেছেন অন্য এলাকায়। কোনো কোনো ভোটার স্টেটও ছেড়ে চলে গেছেন।
এদিকে পাঁচটি কেন্দ্রের মধ্যে প্রধান ভোটকেন্দ্র কুইন্সের গুলশান টেরেস। বাকি চারটি ভোটকেন্দ্র হচ্ছে জ্যামাইকার ইকরা সেন্টার, ব্রুকলিনের পিএস-১৭৯ স্কুল, ওজোন পার্কের দেশি সেন্টার এবং ব্রঙ্কসের গোল্ডেন প্যালেস। এই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হবে। নির্বাচন কমিশন আশা করছে, নির্বাচন শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফল পাওয়া যাবে। এই নির্বাচন সফলভাবে হলে এবং নতুন কমিটি ঘোষণা করা সম্ভব হলে আবার সচল হবে বাংলাদেশ সোসাইটি। এতে বদলে যাবে সোসাইটির বর্তমান দুরাবস্থাও। কমিউনিটির জন্য আবার বৃহৎ পরিসরে কাজ শুরু করবে নতুন কমিটি। কিন্তু মামলা-কাউন্টার মামলা পরোক্ষ হুমকি নির্বাচন অনুষ্ঠানে। ফলে যতক্ষণ না ভোটগ্রহণ শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে জোরালোভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
২০২৩-২৪ মেয়াদের নির্বাচনে দুটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্যানেল দুটি হচ্ছে রব-রুহুল ও নয়ন-আলী পরিষদ। দুটি প্যানেল ও সভাপতি পদে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ কার্যকরী পরিষদের ১৯টি পদে ৩৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনে রব-রুহুল প্যানেল থেকে বৃহত্তর নোয়াখালী সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুর রব মিয়া সভাপতি এবং সোসাইটির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন সিদ্দিকী পুনরায় একই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়া নয়ন-আলী প্যানেল থেকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাজী আশরাফ হোসেন নয়ন সভাপতি পদে ও সোসাইটির বর্তমান কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়া সভাপতি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন। এদিকে রব-রুহুল প্যানেল থেকে ১৯টি পদে ১৯ জন প্রার্থী থাকলেও নয়ন-আলী প্যানেলের প্রার্থী ১৭ জন।
এর আগে নির্বাচন কমিশন এই প্যানেলের দুজন কার্যকরী সদস্যের প্রার্থিতা বাতিল করে। ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে মনোনয়নপত্র পূরণ নিয়ে নয়ন-আলী প্যানেলের দুজন সদস্য প্রার্থীর মনোনয়ন নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বাতিলের পর সৃষ্টি হয় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি। মামলা হয়। মামলা এবং করোনার কারণে এত দিন এই নির্বাচন স্থগিত ছিল। বর্তমানে সৃষ্ট জটিলতার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচন হতে যাওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, তাদের সমর্থক ও ভোটারদের মধ্যে এই নির্বাচনকে ঘিরে আগ্রহ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে। তবে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাল্টাপাল্টি আরো মামলার আশঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারছেন না কেউ।
এই নির্বাচনে যারা অংশ নিচ্ছেন, এর মধ্যে রব-রুহুল প্যানেলের প্রার্থীরা হলেন সভাপতি আবদুর রব মিয়া, সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন সিদ্দিকী, সিনিয়র সহসভাপতি মো. মহিউদ্দিন দেওয়ান, সহসভাপতি ফারুক চৌধুরী, সহ-সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ মো. নওশেদ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম ভূঁইয়া, সাংস্কৃতিক সম্পাদক ডা. শাহনাজ লিপি, জনসংযোগ ও প্রচার সম্পাদক রিজু মোহাম্মদ, সমাজকল্যাণ সম্পাদক মো. টিপু খান, সাহিত্য সম্পাদক ফয়সাল আহমদ, ক্রীড়া ও আপ্যায়ন সম্পাদক মাইনুল উদ্দিন মাহবুব, স্কুল ও শিক্ষা সম্পাদক প্রদীপ ভট্টাচার্য এবং কার্যকরী সদস্য মো. সাদী মিন্টু, ফারহানা চৌধুরী, শাহ মিজানুর রহমান, সিরাজদৌল্লাহ হক বাশার, মো. আখতার বাবুল ও সুশান্ত দত্ত।
আর নয়ন-আলী প্যানেলের প্রার্থীরা হচ্ছেন সভাপতি কাজী আশরাফ হোসেন নয়ন, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী, সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুর রহিম হাওলাদার, সহসভাপতি মো. রেজাউল করিম সগীর, সহ-সাধারণ সম্পাদক মিয়া মোহাম্মদ দুলাল, কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ জে খান ডিউক, সাংগঠনিক সম্পাদক আহসান হাবীব, সাংস্কৃতিক সম্পাদক মনিকা রায়, জনসংযোগ ও প্রচার সম্পাদক শেখ হায়দার আলী, সমাজকল্যাণ সম্পাদক আবুল কাশেম চৌধুরী, সাহিত্য সম্পাদক মোহাম্মদ হাসান জিলানী, ক্রীড়া ও আপ্যায়ন সম্পাদক মো. এইচ রশীদ রানা, স্কুল ও শিক্ষা সম্পাদক মো. সামাদ মিয়া জাকের এবং কার্যকরী সদস্য ছাইদুর খান ডিউক, মো. মাহমুদ আলম, মো. এ সিদ্দিকী ও আহসান উল্লাহ মামুন।
এদিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অ্যাডভোকেট জামাল আহমেদ জনি বলেন, সব ধরনের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে নির্বাচন করছি। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে সোসাইটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করছে। সবাই মিলে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারব বলে আমরা আশবাদী।
এদিকে নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, মামলার শঙ্কা তত বাড়ছে। অনেকেই ভোট হতে পারেননি, নতুন ভোটার হতে না পারা, আগের মামলা চলমান থাকায় ও নিষ্পত্তি না হওয়ায় এবং সাধারণ সভা না করে নির্বাচন আয়োজন, গঠনতন্ত্র ভঙ্গসহ বিভিন্ন কারণে নতুন করে মামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ফলে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে এখনো শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তবে নির্বাচন কমিশন যেকোনো মূল্যে ১৮ সেপ্টেম্বর রোববার ছুটির দিনে নির্বাচন করার পক্ষে কাজ করছে।
একটি সূত্র জানায়, মামলা হলেও অ্যাটর্নির পরামর্শে নির্বাচন করার পক্ষে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। এ ব্যাপারে অ্যাটর্নি নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত নতুন মামলা ঠেকিয়ে রাখার ব্যাপারে প্রস্তুত রয়েছেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার।
অ্যাডভাকেট জামাল আহমেদ জনি ছাড়াও কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ এ হাকিম মিয়া, মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, কাওসারুজ্জামান কয়েস, মো. রুহুল আমিন সরকার ও খোকন মোশাররফ।
নির্বাচন ঠেকাতে ওসমান চৌধুরীর প্রস্তুতি, পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে সোসাইটি : বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচন যাতে ১৮ সেপ্টেম্বর না হয়, সে জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন সোসাইটির সাবেক নেতা ওসমান চৌধুরী। তিনি নির্বাচনের দুই-তিন দিন আগে বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনের ওপর আদালতে নিষেধাজ্ঞা চাইবেন। নির্বাচনে অনিয়ম, গঠনতন্ত্র না মেনে নির্বাচন করার অভিযোগ এনে নির্বাচনের ওপর স্থগিতাদেশ চাইবেন বলে তিনি জানান।
এদিকে ওসমান চৌধুরী মামলা করলেও নির্বাচন যাতে বন্ধ না হয়, সে জন্য পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাহী পরিষদ ও ট্রাস্টি বোর্ড। এ জন্য তারা আইনজীবী প্রস্তুত রেখেছেন। সোসাইটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুর রহিম হাওলাদার বলেন, কমিশন ও আমরা নির্বাচনের জন্য সব রকমের প্রস্তুতি নিয়েছি। ওসমান চৌধুরী মামলা করে নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করতে পারেন, সে জন্য নির্বাচনের চার দিন আগে থেকে আদালতে আমাদের আইনজীবী থাকবেন। তিনি সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেবেন। তিনি বলেন, আদালতে ওসমান চৌধুরী নিষেধাজ্ঞা চাইলে জবাবে আমরা সঙ্গে সঙ্গে আবেদন করে নির্বাচন স্থগিত না করার আবেদন জানাব। আশা করা যায়, আদালত আমাদের বিষয়টি শুনবেন এবং বিষয়টি বিবেচনা করবেন। কেবল ওসমান চৌধুরী নন, যে কেউ মামলা করলেই আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এবার যাতে মামলার কারণে কোনোভাবেই নির্বাচন স্থগিত না হয়, সেই প্রস্তুতি আমাদের আছে।
আব্দুর রহিম হাওলাদার আরো বলেন, আমরা ওসমান চৌধুরীকে ১০ সেপ্টেম্বর সোসাইটির অফিসে এসে কথা বলার জন্য ডেকেছিলাম। কিন্তু তিনি আসেননি। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, তিনি অসুস্থ, তাই আসতে পারবেন না। তবে তিনি ভার্চুয়ালি বৈঠক করতে চান কিন্তু আমরা এতে সম্মত হইনি। আমরা তাকে চিঠি দিয়ে বলেছি, আপনি সুস্থ হয়ে আমাদের জানাবেন, আমরা দ্রুতই আপনার সঙ্গে বৈঠকে বসব। তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রমাণ চেয়েছি। তিনি প্রমাণ দিতে পারলে সেটা বিবেচনা করা হবে। সরাসরি না বসলে আলোচনা হবে না। নথিপত্র না দিলে এর বিকল্প হবে না। তিনি না আসায় ১০ সেপ্টেম্বর বৈঠক হয়নি। আমরা আশা করছি, নির্বাচনের আগেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং আমাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করবেন।
প্রতি দুই বছর পর বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচন হয়। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৬ সালে। পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালে। ওই বছর মামলার কারণে ও পরে করোনা মহামারির কারণে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। এর প্রায় তিন বছর পর ১৪ নভেম্বর রোববার বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। ওই সময়েও নিষেধাজ্ঞার কারণে নির্বাচন হয়নি। এখন প্রায় চার বছর পর ১৮ সেপ্টেম্বর নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এবার ২০১৮ সালের নির্বাচনের তালিকা দিয়েই ভোট হচ্ছে। মামলার কারণে সোসাইটির আর্থিক লোকসান যেমন হয়েছে, তেমনি ইমেজ সংকটও দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক কর্মকর্তা ওসমান চৌধুরী এবং একটি ল’ ফার্ম পৃথক মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত তারা মামলা করবেন কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (১৩ সেপ্টেম্বর) নির্বাচন নিয়ে কোনো বাধা আসেনি।