বদরুদ্দীন উমর
বাংলাদেশের ‘পরম বন্ধু’ ভারত সরকার এখন আসাম থেকে বাংলাদেশি খেদাও নীতি যেভাবে নির্ধারণ করেছে এবং তা কার্যকর করার জন্য হুংকার ছাড়ছে তার থেকেই বোঝা যায়, এই চরম সাম্প্রদায়িক শক্তির আসল চরিত্র কী।
বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে গলা ধরাধরি করে অনেক ‘উন্নয়ন’ কীর্তি করছে; কিন্তু এসব ‘উন্নয়ন’ কীর্তির ক্ষেত্রে ভারতের লাভই যে অনেক বেশি, এমনকি এসবে বাংলাদেশের লোকসান এতে সন্দেহ নেই। তাদের এই ‘উন্নয়ন’ সহযোগিতার সঙ্গে সমান্তরালভাবে বাংলাদেশের প্রতি ভারত সরকারের সাধারণ নীতি বিবেচনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে জয়পুরে নিজেদের এক দলীয় সভায় কর্মীদের উদ্দেশ করে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ প্রথমে বলেন, তারা আগামীতে প্রতিটি নির্বাচনে জয়লাভ করবেন। এরপর তিনি এনআরসি বা ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন কার্ড সম্পর্কে কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে গিয়ে বলেন, ‘তোমরা যত পার এটাকে আক্রমণ কর; কিন্তু বিজেপির ভাবনা হল, আমরা একজন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীকেও এ দেশে থাকতে দেব না। তাদেরকে বাছাই করে এক এক করে আমরা বহিষ্কার করব।
এভাবে বাছাই করার পর আমরা তাদের তালিকা তৈরি করব যাতে তাদেরকে চিহ্নিত করা যায়’ (উধরষু ঝঃধৎ,১১.০৯.২০১৮)। এরপর কংগ্রেসকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘শত শত সন্ত্রাসী দেশে ঢুকছে এবং বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করছে।
এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে তোমাদের সময়’ (উধরষু ঝঃধৎ,১১.০৯.২০১৮)। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও যা বলেন তা হল, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৬ সালে ঈরঃরুবহ অসবহফসবহঃ ইরষষ এনেছেন যাতে আমরা ঠিক করেছি যে, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে যেসব হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ ও জৈন এসেছেন তারা অনুপ্রবেশকারী নন, তারা হলেন আশ্রয়প্রার্থী, আমাদের ভাই, এবং আমরা তাদেরকে নাগরিকত্ব প্রদান করব’ (উধরষু ঝঃধৎ,১১.০৯.২০১৮)। এর থেকে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িকতা আর কী হতে পারে? এই বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক ও বাংলাদেশবিরোধীরাই নাকি এখন বাংলাদেশের পরম বন্ধু তাদের হাত ধরেই নাকি বাংলাদেশ উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করছে
২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় আসাম সফরে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, তারা ক্ষমতায় এলে আসাম থেকে সব ‘বাংলাদেশিকে’ বহিষ্কার করবেন। এখন তারা তাদের সেই নির্বাচনী অঙ্গীকার পালনের উদ্দেশ্যেই এনআরসির ব্যবস্থা করেছেন এবং বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে আসাম থেকে মুসলমানদের বহিষ্কারের কথা বলে হিন্দু ভোট নিজেদের বাক্সে ফেলার চেষ্টা করছেন।
এ বিষয়ে আলোচনার আগে অমিত শাহ পরবর্তী নির্বাচনে তাদের সুনিশ্চিত বিজয় সম্পর্কে যা বলেছেন সে বিষয়ে কিছু বলা দরকার। তিনি বলেছেন, আগামীতে প্রতিটি নির্বাচনেই তারা জয়লাভ করবেন।
কোনো ভিত্তিতে তিনি এসব কথা বলেন যা ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়? সম্প্রতি বিহার, উত্তর প্রবেশ, রাজস্থান ইত্যাদি রাজ্যে যেসব নির্বাচন হয়েছে তাতে বিজেপির প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন।
উত্তর প্রদেশ ও বিহারে তারা কোনো আসনেই জয়লাভ করেনি। উত্তর প্রদেশ হচ্ছে ভারতের সব থেকে বড় রাজ্য। এই রাজ্যে কী হবে সেটা অনেকাংশে সমগ্র ফলাফলের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে বিজেপির জয়জয়কার হয়েছিল। আগে যেখানে এই অবস্থা ছিল এখন সেখানে তাদের চরম দুরবস্থা।
বিহারের অবস্থাও প্রায় একই রকম। গুজরাটে তাদের পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব হলেও আগের অবস্থা তাদের আর নেই। বিরোধীরা সেখানে তাদের শক্তি ও জনপ্রিয়তা অনেকখানি ফিরিয়ে এনেছে। দেশের অন্যান্য রাজ্যেও বিজেপি যে খুব ভালো অবস্থায় আছে এমন নয়। কাজেই আগামী নির্বাচনে বিজেপি প্রতিটি এলাকায় জয়লাভ করবে, এটা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কী? এই ধাপ্পাবাজির প্রয়োজন তাদের হয়েছে, কারণ পরপর অনেকগুলো নির্বাচনে তাদের পরাজয় তাদের কর্মীদের মধ্যেও হতাশার সঞ্চার করেছে।
লক্ষ করার বিষয় যে, ভারত সরকার ও ভারতের সরকারি দল এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গ সাম্প্রদায়িক দলগুলো আসামের মুসলমানদের বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার যে চক্রান্ত করছে, খোলাখুলিভাবে হুমকি দিচ্ছে, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কোনো বক্তব্য বা প্রতিবাদ নেই। বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থী এসেছে। এর ফলে অনেক রকম সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় ভারত থেকে যদি ৪০ লাখ মুসলমানকে বাংলাদেশি হিসেবে ‘চিহ্নিত’ করে এদিকে ঠেলে দেয়া হয় তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে এটা অনুমান করা কঠিন নয়। কিন্তু এই ভয়ংকর সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সরকারের নীরবতা আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর। ভারত সরকারের এই শত্রুতামূলক আচরণ এ দেশকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিলেও বাংলাদেশ কেন ‘একতরফা বন্ধুর’ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ পর্যন্ত করছে না, এর জবাবদিহি জনগণ অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের কাছে চাইতে পারে।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙালি বসতকারীরা সেখানে ব্রিটিশ আমলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করে এসেছেন। তাদের বিরুদ্ধে ত্রিশের দশকে আসামের কংগ্রেস নেতা ও পরে আসামের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলুই এক ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আসামে বড় আন্দোলন হয়েছিল। এসব লোকের কাছে নিজেদের নাগরিকত্বের প্রমাণ বলে কিছু নেই। তাদের নাগরিকত্বের পরিচয় বংশপরম্পরায়। আসামে তাদের বসবাসের মধ্যে এনআরসি চালু করার জন্য ভারত সরকার যে জরিপ করেছে তাতে সাড়ে তিন কোটি লোকের দরখাস্তের মধ্যে ৪০ লাখ লোকের দরখাস্ত বাতিল হয়েছে। এরাই হল সেই ৪০ লাখ লোক।
এ দিকে বিজেপি সভাপতি ঘোষণা করেছেন, এই ‘বাড়তি’ লোকেরা হলো বাংলাদেশি মুসলমান এবং তাদেরকে ভারত থেকে বহিষ্কার করা হবে। এই লোকেরা বহিষ্কৃত হয়ে কোথায় যাবে? নিশ্চয় ‘বন্ধু দেশ’ বাংলাদেশে এই হল বাস্তব পরিস্থিতি। কিন্তু এই ভয়ংকর সম্ভাবনার প্রতি কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বাংলাদেশ সরকার এখন ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের গীত গাইতেই ব্যস্ত রয়েছে। এটা শুধু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে একটা বিপজ্জনক ব্যাপার নয়, বাংলাদেশের মান-সম্মানের প্রশ্নও এর সঙ্গে জড়িত।
যে মুসলমানরা আসামে তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে পারেনি বলে অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা আসামে গিয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। পরে কিছু লোক সেখানে গেলেও তাদের সংখ্যা সামান্য। তা ছাড়া গত কিছুদিন থেকে বাংলাদেশিদের পক্ষে আসামে যাওয়া অসম্ভব কাঁটাতারের সীমান্ত বেড়া এবং সীমান্ত পাহারার কারণে। ৪০ লাখ বাংলাদেশি ১৯৭১ সালের পর আসামে গেছে বলে বিজেপি সরকার দাবি করছে। কিন্তু কেন তারা আসামে যাবে? ব্রিটিশ আমলে আসাম ভারতের অনেক প্রদেশের থেকে উন্নত ছিল। কিন্তু দেশভাগের পর আসাম দ্রুতগতিতে তার পূর্ব অবস্থা হারিয়ে তুলনায় অনুন্নত হয়েছে। ভারতের মূল ভূখ-ের সঙ্গে যাতায়াতের অসুবিধার জন্য সেখানে বিশেষ কোনো পুঁজি বিনিয়োগ হয়নি। আসামের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা ভালো, যদিও বাংলাদেশ অনেক সংকটের মধ্যে আছে। এই অবস্থায় অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশিদের জন্য অপেক্ষাকৃত একটা অনুন্নত অঞ্চলে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই এবং তারা যায়ওনি। কিন্তু এসব যুক্তি বিজেপির কাছে গ্রাহ্য নয়। কারণ সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া তাদের আর কোনো পুঁজি নেই এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে হিন্দু ভোট আকর্ষণ করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। ইসরাইল ও মিয়ানমার ছাড়া ভারতই এখন হচ্ছে একটা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, যারা খোলাখুলিভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে তাদের নীতি হিসেবে ঘোষণা করে।
বর্তমান ভারত সরকার আজ যেভাবে এক দিকে বাংলাদেশের ওপর চড়াও হয়ে সবরকম সুবিধা আদায় করছে এবং অন্য দিকে বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে কিছুই না দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত করছে, এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয়। কাজেই ভারতের জনগণের সঙ্গে নয়, ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হিসাব করে নির্ধারণ খুব জরুরি হয়েছে। দেশের জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থই শুধু নয়, দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মান-সম্মান রক্ষার বিষয়টিও এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল