মারুফ খান :
নববর্ষ বা New Year’s day-এই শব্দগুলো নতুন বছরের আগমন এবং এ উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব-অনুষ্ঠানাদিকে ইঙ্গিত করে। এ উপলক্ষে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, হাসিঠাট্টা ও আনন্দ উপভোগ, সাজগোজ করে নারীদের অবাধ বিচরণ ও সৌন্দর্যের প্রদর্শনী, রাতে অভিজাত এলাকার ক্লাব ইত্যাদিতে মদ্যপান তথা নাচানাচি, পটকা ফোটানো-এই সবকিছু কতটা ইসলামসম্মত? বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মুসলিম যে আল্লাহতে বিশ্বাসী, সেই আল্লাহ কি মুসলিমদের এই সকল আচরণে আনন্দ-আপ্লুত হন, না ক্রোধান্বিত হন? নববর্ষকে সামনে রেখে এই নিবন্ধে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
ইসলাম ধর্মে উৎসবের রূপরেখা অনেকে উপলব্ধি না করলেও উৎসব সাধারণত একটি জাতির ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত হয়। উৎসবের উপলক্ষগুলো খোঁজ করলে পাওয়া যাবে উৎসব পালনকারী জাতির ধমনিতে প্রবাহিত ধর্মীয় অনুভূতি, সংস্কার ও ধ্যান-ধারণার ছোঁয়া। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন তাদের বিশ্বাসমতে, স্রষ্টার পুত্রের জন্মদিন।
মধ্যযুগে ইউরোপীয় দেশগুলোতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ উদ্্যাপিত হতো ২৫ মার্চ এবং তা পালনের উপলক্ষ ছিল এই যে, ওই দিন খ্রিষ্টীয় মতবাদ অনুযায়ী মাতা মেরির নিকট ঐশী বাণী প্রেরিত হয় এই মর্মে যে, মেরি ঈশ্বরের পুত্রের জন্ম দিতে যাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান
ক্যালেন্ডারের সূচনার পর রোমক ক্যাথলিক দেশগুলো পয়লা জানুয়ারি নববর্ষ উদ্্যাপন করা আরম্ভ করে। ঐতিহ্যগতভাবে এই দিনটি একটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবেই উদ্্যাপিত হতো। ইহুদিদের নববর্ষ ‘রোশ হাশানাহ’ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ইহুদিদের ধর্মীয় পবিত্র দিন ‘স্যাবাথ’ হিসেবে পালিত হয়। এমনিভাবে প্রায় সকল জাতির উৎসব-উপলক্ষের মাঝেই ধর্মীয় চিন্তাধারা খুঁজে পাওয়া যাবে।
আর এ জন্যই ইসলাম ধর্মে নবী মুহাম্মদ (সা.) পরিষ্কারভাবে মুসলিমদের উৎসবকে নির্ধারণ করেছেন। ফলে অন্যদের উৎসব মুসলিমদের সংস্কৃতিতে প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ঈদ রয়েছে, আর এটা আমাদের ঈদ।’ (বুখারি, মুসলিম)। এ ছাড়া উৎসব-সংক্রান্ত আরেকটি সহিহ হাদিস সুনানে আবু দাউদে আনাস ইবনে মালিক (রা.) দ্বারা বর্ণিত হয়েছে। এসব হাদিস থেকে দেখা যায়, ইসলাম আগমনের পর ইসলাম-বহির্ভূত সকল উৎসবকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে এবং নতুনভাবে উৎসবের জন্য দুটো দিনকে নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সাথে অমুসলিমদের অনুসরণে যাবতীয় উৎসব পালনের পথকে বন্ধ করা হয়েছে।
ইসলামের এই যে উৎসব ‘ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা’ এগুলো থেকে মুসলিম ও অমুসলিমদের উৎসবের মূলনীতিগত একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য স্পষ্ট হয় এবং এই বিষয়টি আমাদের খুব গুরুত্বসহকারে লক্ষ করা উচিত, যা হচ্ছে অমুসলিম, কাফির কিংবা মুশরিকদের উৎসবের দিনগুলো হচ্ছে তাদের জন্য উচ্ছৃঙ্খল আচরণের দিন। এ দিনে তারা নৈতিকতার সকল বাঁধ ভেঙে দিয়ে অশ্লীল কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় আর এই কর্মকাণ্ডের অবধারিত রূপ হচ্ছে মদ্যপান ও ব্যভিচার। এমনকি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বহু লোক তাদের পবিত্র বড়দিনেও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে মদ্যপ হয়ে ওঠে এবং পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিবছর এই রাত্রিতে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর কারণে কিছু লোক নিহত হয়।
অপরদিকে মুসলিমদের উৎসব হচ্ছে ইবাদতের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এই বিষয়টি বুঝতে হলে ইসলামের সার্বিকতাকে বুঝতে হবে। ইসলাম কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়, বরং তা মানুষের গোটা জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী বিন্যস্ত ও সজ্জিত করতে উদ্যোগী হয়। তাই একজন মুসলিমের জন্য জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইবাদত, যেমনটি কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা দিচ্ছেন : ‘আমি জিন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে সৃষ্টি করিনি।’ (৫১:৫৬)। সে জন্য মুসলিম জীবনের আনন্দ-উৎসব আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ ও অশ্লীলতায় নিহিত নয়, বরং তা নিহিত হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া আদেশ পালন করতে পারার মাঝে, কেননা মুসলিমের ভোগবিলাসের স্থান ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী নয়, বরং চিরস্থায়ী জান্নাত। তাই মুসলিম জীবনের প্রতিটি কাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে থাকবে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, তাদের ঈমান, আখিরাতের প্রতি তাদের অবিচল বিশ্বাস, আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা।
তাইতো দেখা যায়, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা এ দুটো উৎসবই নির্ধারণ করা হয়েছে ইসলামের দুটি স্তম্ভ পালন সম্পন্ন করার প্রাক্কালে। ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ সাওম পালনের পর পরই মুসলিমরা উদ্্যাপন করে ঈদুল ফিতর, কেননা এই দিনটি আল্লাহর আদেশ পালনের পর আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার ও ক্ষমার ঘোষণা পাওয়ার দিন বিধায় এটি সাওম পালনকারীর জন্য বাস্তবিকই উৎসবের দিন। এদিন এ জন্য উৎসবের নয় যে এ দিনে আল্লাহর দেওয়া আদেশ-নিষেধ কিছুটা শিথিল হতে পারে। বরং মুসলিমের জীবনে এমন একটি মুহূর্তও নেই, যে মুহূর্তে তার ওপর আল্লাহর আদেশ-নিষেধ শিথিলযোগ্য। তেমনিভাবে ঈদুল আজহা উদ্্যাপিত হয় ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ পালনের প্রাক্কালে। কেননা ৯ জিলহজ হচ্ছে ইয়াওমুল আরাফা। এ দিনটি আরাফাতের ময়দানে হাজিদের ক্ষমালাভের দিন, আর তাই ১০ জিলহজ হচ্ছে আনন্দের দিনÑঈদুল আজহা। এমনিভাবে মুসলিমদের উৎসবের এ দুটো দিন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে বেশি করে স্মরণ করার দিন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন এবং শরিয়তসম্মত বৈধ আনন্দ উপভোগের দিন; এই উৎসব মুসলিমদের ঈমানের চেতনার সাথে একই সূত্রে গাঁথা।
নতুন বছরের সাথে মানুষের কল্যাণের সম্পর্ক : নতুন বছর নতুন কল্যাণ বয়ে আনে, দূরীভূত হয় পুরোনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানিÑএ ধরনের কোনো তত্ত্ব ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়, বরং নতুন বছরের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ধারণা আদি যুগের প্রকৃতি-পূজারি মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার অবশিষ্টাংশ। ইসলামে এ ধরনের কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। বরং মুসলিমের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই পরম মূল্যবান হীরকখণ্ড, হয় সে এই মুহূর্তকে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করে আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করবে, নতুবা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে শাস্তির যোগ্য হয়ে উঠবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বছরের প্রথম দিনের কোনো বিশেষ তাৎপর্য নেই। আর তাই তো ইসলামে হিজরি নববর্ষ পালনেরও কোনো প্রকার নির্দেশ দেওয়া হয়নি। না কোরআনে এর কোনো নির্দেশ এসেছে, না হাদিসে এর প্রতি কোনো উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, না সাহাবিগণ এরূপ কোনো উপলক্ষ পালন করেছেন। এমনকি পয়লা মহররমকে নববর্ষের সূচনা হিসেবে গণনা করা শুরুই হয় নবীজির (সা.) মৃত্যুর বহু পরে, উমর ইবনুল খাত্তাবের (রা.) আমলে। এ থেকে বোঝা যায়, নববর্ষ ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা তাৎপর্যহীন, এর সাথে জীবনে কল্যাণ-অকল্যাণের গতিপ্রবাহের কোনো দূরতম সম্পর্কও নেই। আর সে ক্ষেত্রে ইংরেজি বা অন্য কোনো নববর্ষের কীই-বা তাৎপর্য থাকতে পারে ইসলামে?
কেউ যদি এই ধারণা পোষণ করে, নববর্ষের প্রারম্ভের সাথে কল্যাণের কোনো সম্পর্ক রয়েছে, তবে সে শিরকে লিপ্ত হলো। অর্থাৎ আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করল। যদি সে মনে করে যে আল্লাহ এই উপলক্ষের দ্বারা মানবজীবনে কল্যাণ বর্ষণ করেন, তবে সে ছোট শিরকে লিপ্ত হলো। আর কেউ যদি মনে করে যে নববর্ষের আগমনের এই ক্ষণটি নিজে থেকেই কোনো কল্যাণের অধিকারী, তবে সে বড় শিরকে লিপ্ত হলো, যা তাকে ইসলামের গণ্ডির বাইরে নিয়ে গেল। আর এই শিরক এমন অপরাধ, শিরকের ওপর কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে চিরতরে হারাম করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন : ‘নিশ্চয় যে কেউই আল্লাহর অংশীদার স্থির করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন, আর তার বাসস্থান হবে অগ্নি। এবং জালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।’ (কোরআন ৫:৭২)। নববর্ষ উদ্্যাপনের সাথে মঙ্গলময়তার এই ধারণার সম্পর্ক রয়েছে বলে কোনো কোনো সূত্রে দাবি করা হয়, যা কিনা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। মুসলিমদের এ ধরনের কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে ইসলামের যে মূলতত্ত্ব, সেই তাওহিদ বা একত্ববাদের ওপর পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
নববর্ষের অনুষ্ঠানাদি : শয়তানের পুরোনো কূটচালের নবায়ন
আমাদের সমাজে নববর্ষ যারা পালন করে, তারা কী ধরনের অনুষ্ঠান সেখানে পালন করে আর সেগুলো সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য কী? নববর্ষের অনুষ্ঠানাদির মধ্যে রয়েছে পটকা ফুটিয়ে বা আতশবাজি পুড়িয়ে রাত ১২টায় হই-হুল্লোড় করে পরিবেশ ও প্রতিবেশীর শান্তি বিনষ্ট করে নববর্ষকে স্বাগত জানানো, অহরহ ফানুস ওড়ানো, যা আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে দুর্ঘটনার সুযোগ তৈরি করে, ব্যান্ড সংগীত বা অন্যান্য গান-বাজনার ব্যবস্থা, সম্ভ্রান্ত পল্লির বাড়িতে বা ক্লাবে গান-বাজনা, মদ্যপান ও পান শেষে ব্যভিচারের আয়োজন ইত্যাদি। এ ছাড়া রেডিও-টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান ও পত্রপত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্র ও ‘রাশিফল’ প্রকাশ।
এবার এসব অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠিত মূল কর্মকাণ্ড এবং ইসলামে এগুলোর অবস্থান সম্পর্কে পর্যালোচনা করা যাক :
নতুন দিন তথা সূর্যকে স্বাগত জানানো : এ ধরনের কর্মকাণ্ড মূলত সূর্য-পূজারি ও প্রকৃতি-পূজারি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুকরণ মাত্র, যা আধুনিক মানুষের দৃষ্টিতে পুনরায় শোভনীয় হয়ে উঠেছে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজের অনেকেরই ধর্মের নাম শোনামাত্র গাত্রদাহ সৃষ্টি হলেও প্রকৃতি-পূজারি আদিম ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নকল করতে তাদের অন্তরে অসাধারণ পুলক অনুভূত হয়। সূর্য ও প্রকৃতির পূজা বহু প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন জাতির লোকেরা করে এসেছে। যেমন খ্রিষ্টপূর্ব চৌদ্দ শতকে মিসরীয় ‘অ্যাটোনিসম’ মতবাদে সূর্যের উপাসনা চলত। এমনিভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় এবং মেসো-আমেরিকান সংস্কৃতিতে সূর্য-পূজারিদের পাওয়া যাবে। খ্রিষ্টান সম্প্রদায় কর্তৃক পালিত যিশুখ্রিষ্টের তথাকথিত জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বরও মূলত এসেছে রোমক সৌর-পূজারিদের পৌত্তলিক ধর্ম থেকে, যিশুখ্রিষ্টের প্রকৃত জন্মতারিখ থেকে নয়। উনিশ শতকের উত্তর আমেরিকায় কিছু সম্প্রদায় গ্রীষ্মের প্রাক্কালে পালন করত সৌর-নৃত্য এবং এই উৎসব উপলে পৌত্তলিক প্রকৃতি-পূজারিরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পুনর্ঘোষণা দিত। মানুষের ভক্তি ও ভালোবাসাকে প্রকৃতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টির সাথে আবদ্ধ করে তাদেরকে শিরক বা অংশীদারিত্বে লিপ্ত করানো শয়তানের সুপ্রাচীন ‘ক্লাসিক্যাল ট্রিক’ বলা চলে। শয়তানের এই কূটচালের বর্ণনা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কোরআনে তুলে ধরেছেন : ‘আমি তাকে ও তার জাতিকে দেখেছি, তারা আল্লাহকে ছেড়ে সূর্যকে সিজদা করছে এবং শয়তান তাদের কার্যাবলিকে তাদের জন্য শোভনীয় করেছে।’ (কোরআন ২৭:২৪)
নারীকে জড়িয়ে বিভিন্ন অশ্লীলতা : নববর্ষের পার্টি বা উদ্্যাপন আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নারীর সহজলভ্যতা। নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারে অথবা ঢাকার গুলশান ক্লাবে-পশ্চিমে এবং তাদের অনুকরণে এখানেও ব্যাপারটা একটা অলিখিত প্রলোভন। নববর্ষের অনুষ্ঠানাদির মধ্যে সমাজবিধ্বংসী যে বিষয়গুলো পাওয়া যাবে, তার মাঝে অন্যতম হচ্ছে নারীকে জড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীলতা। নববর্ষের পার্টি বা উদ্্যাপন আয়োজনের সর্বত্রই সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী নারীকে পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশায় লিপ্ত দেখা যাবে। পৃথিবীতে আল্লাহ মানুষকে যেসব আকর্ষণীয় বস্তু দ্বারা পরীক্ষা করে থাকেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নারী। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি পুরুষের জন্য নারীর চেয়ে বড় কোনো ফিতনা রেখে যাচ্ছি না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ব্যভিচারের প্রতি আহ্বান জানানো শয়তানের ক্লাসিক্যাল ট্রিকগুলোর অপর একটি, যেটাকে কোরআনে ‘ফাহিশাহ’ শব্দের আওতায় আলোচনা করা হয়েছে, শয়তানের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন, ‘হে মানুষ! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র বস্তু আছে, তা থেকে তোমরা আহার করো আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তো তোমাদের নির্দেশ দেয় মন্দ ও অশ্লীল কাজ [ব্যভিচার, মদ্যপান, হত্যা ইত্যাদি] করতে এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন সব বিষয় বলতে, যা তোমরা জানো না।’ (২:১৬৮-১৬৯)।
এ ছাড়া যা কিছুই মানুষকে ব্যভিচারের দিকে প্রলুব্ধ ও উদ্যোগী করতে পারে, তার সবগুলোকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে কোরআনের নিম্নলিখিত আয়াতের দ্বারা : ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। অবশ্যই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পন্থা।’ (কোরআন ১৭:৩২)। ব্যভিচারকে উৎসাহিত করে এমন বিষয়, পরিবেশ, কথা ও কাজ এই আয়াত দ্বারা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
বিভিন্ন সাজে সজ্জিত পর্দাবিহীন নারীকে আকর্ষণীয়, প্রগতিশীল, আধুনিক ও অভিজাত বলে মনে হতে পারে, কেননা, শয়তান পাপ কাজকে মানুষের দৃষ্টিতে শোভনীয় করে তোলে। যেসব মুসলিম ব্যক্তির কাছে নারীর এই অবাধ সৌন্দর্য প্রদর্শনকে সুখকর বলে মনে হয়, তাদের উদ্দেশে বলছি, ছোট শিশুরা অনেক সময় আগুন স্পর্শ করতে চায়, কারণ আগুনের জ্যোতি ও রং তাদের কাছে আকর্ষণীয়। কিন্তু আগুনের মূল প্রকৃতি জানার পর কেউই আগুন ধরতে চাইবে না। তেমনি ব্যভিচারকে আকর্ষণীয় মনে হলেও পৃথিবীতে এর ধ্বংসাত্মক পরিণতি এবং আখিরাতে এর জন্য যে কঠিন শাস্তি পেতে হবে, সেটা স্মরণ করলে বিষয়টিকে আকর্ষণীয় মনে হবে না। এ ছাড়া এ ধরনের অনর্থক ও পাপপূর্ণ অনুষ্ঠান সম্পর্কে বহু সতর্কবাণী এসেছে কোরআনের অন্যান্য আয়াতে এবং আল্লাহর রাসুলের হাদিসে। যেসব মুসলিমের মধ্যে ইমান এখনো অবশিষ্ট রয়েছে, তাদের উচিত এসব কিছুকে সর্বাত্মকভাবে পরিত্যাগ করা।
মুসলিমদের করণীয় : ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে নববর্ষ-সংক্রান্ত যাবতীয় অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এ জন্য যে, এতে নিম্নলিখিত চারটি শ্রেণির ইসলামবিরোধী বিষয় রয়েছে :
১. শিরকপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি, চিন্তাধারা ও সংগীত
২. নগ্নতা, অশ্লীলতা, ব্যভিচারপূর্ণ অনুষ্ঠান
৩. গান, নৃত্য ও বাদ্যপূর্ণ অনুষ্ঠান
৪. সময় অপচয়কারী অনর্থক ও বাজে কথা এবং কাজ
এ অবস্থায় প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব হচ্ছে নিজে এগুলো থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকা এবং নিজ নিজ সাধ্য ও অবস্থান অনুযায়ী মুসলিম সমাজ থেকে এই প্রথা উচ্ছেদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো। এ প্রসঙ্গে আমাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া যেতে পারেÑ
ক) এ বিষয়ে দেশের শাসকগোষ্ঠীর দায়িত্ব হবে আইন প্রয়োগের দ্বারা নববর্ষের যাবতীয় অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।
খ) যেসব ব্যক্তি নিজ নিজ ক্ষেত্রে কিছুটা ক্ষমতার অধিকারী, তাদের কর্তব্য হবে অধীনদের এ কাজ থেকে বিরত রাখা। যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান এই নির্দেশ জারি করতে পারেন, তার প্রতিষ্ঠানে নববর্ষকে উপলক্ষ করে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান পালিত হবে না, নববর্ষ উপলক্ষে কেউ বিশেষ পোশাক পরতে পারবে না কিংবা শুভেচ্ছা বিনিময় করতে পারবে না।
গ) মসজিদের ইমামগণ এ বিষয়ে মুসল্লিদেরকে সচেতন করবেন ও বিরত থাকার উপদেশ দেবেন।
ঘ) পরিবারের প্রধান এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন যে তার পুত্র, কন্যা, স্ত্রী কিংবা অধীন অন্য কেউ যেন নববর্ষের কোনো অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়। (এটুকু ইনশা আল্লাহ চাইলে সবাই/অনেকেই করতে পারবেন)
ঙ) এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সহপাঠী, সহকর্মী ও পরিবারের মানুষকে উপদেশ দেবেন এবং নববর্ষ পালনের সাথে কোনোভাবে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবেন।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফিক দান করুন এবং কল্যাণ ও শান্তি বর্ষিত হোক রাসুলুল্লাহ (সা.), তাঁর পরিবার ও সাহাবিগণের ওপর।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট