অসীম কে সাহাট
মনটা ভালো নেই। ভালো থাকা যায় না। ইউএস-বাংলা-২১১ দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন, পরম করুণাময়ের কাছে তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। যারা আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন, তাদের সবার দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। আমার লালিত স্বপ্ন থেকেই বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট (প্রকাশিত) পড়েই আজকের এই দুঃখজনক এপিসোড লিখতে বসেছি।
আকাশে ওড়ার স্বপ্ন সবাই দেখে। নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলার বুক চিড়ে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে বেড়ানোর অদম্য বাসনা সবার বুকেই থাকে। অথচ এ ভ্রমণ যে কতটা ঝুঁকিবহুল, তা ভাবলেই গা শিউড়ে উঠবে। যারা গেছেন, মর্তলোকে তারা আর কোনদিন ফিরবেন না। আর যারা বেঁচে আছেন, তারা এ জীবনে কতটা ভালো থাকবেন, আমি জানি না! তবুও আশা করি সবাই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক।
প্রায় ৮ বছর আগে আমি নিউইয়র্কের একটি পত্রিকায় একটি লেখা দিয়েছিলাম। সম্পাদক সাহেব লেখাটি ছেপে আমাকে কৃতার্থ করেছেন। আমার এশটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। শিরোনামটি ছিল- ‘বাজেট এয়ার : বাংলাদেশ ভেবে দেখতে পারে।’ নভো এয়ার, রিজেন্ট এয়ার, ইউএস বাংলা- আমি ভেবেছিলাম আমার স্বপ্ন পূরণের একটা অধ্যায় শেষ হলো, বাংলাদেশ আকাশ পরিবহনে এগিয়ে যাবে। প্রতিযোগিতামূলক সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই এয়ারলাইন্সগুলো, সে আশারই প্রতীক।
প্রসঙ্গে ফিরি, গত ১২ মার্চ, দুঃসংবাদটি শোনার পর বেদনায় মনটা ভারী হয়ে উঠল! প্রশ্নটা তখন থেকেই আমায় পেয়ে বসেছিল- কেন এমনটি হলো?
ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমার নামার সুযোগ হয়েছে দু’বার। ভৌগোলিক কারণে এর রানওয়েটি দু’টি পাহাড়ের মাঝখানে, পাহাড়গুলোর উচ্চতা ৭০০০ থেকে ৮০০০ ফুট হবে। খুব একটা লম্বা রানওয়ে নয়। হঠাৎ করেই দেখা যাবে রানওয়ের ভেতরেই গতি কমিয়ে ত্রিভুজ পজিশনে বিমানকে নামাতে হবে, অর্থাৎ টাচ ডাউনের পর খুব একটা লম্বা দৌড় দেয়া যাবে না। যা হিসাব-নিকাশ করার, তা আকাশেই করে নিতে হবে। এ অঙ্কে ভুল হবার কোনো জায়গা নেই! আমিও ভয় পেয়েছিলাম! কোথায় যাচ্ছি, চারপাশেইতো পাহাড়! হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ফাঁকা করিডোর! বিমান বেশ দ্রুততার সাথেই নামলো এবং ধপাশ করে মাটিতে আছড়ে পড়ে থেমে গেল! বেশ ব্যথা পেয়েছিলাম প্রচ- ঝাঁকুনিতে।
এ বিমানবন্দর উঠানামার জন্য ঝুঁকিবহুল। বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনো বৈমানিকই এখানে নামার সাহস দেখান না। ইউএস-বাংলা-২১১ কর্তৃপক্ষের ভাষ্যÑ তাদের বৈমানিক অত্যন্ত দক্ষ। যার রয়েছে ৫ হাজার মাইল ওড়ার অভিজ্ঞতা এবং তিনি একই বিমানে অন্তত ১০০ বার ত্রিভুবনে উঠানামা করেছেন।
তাহলে আমি ধরে নিচ্ছি, তিনি এ যাত্রাপথের প্রতিটি বাঁক, বাতাসের ঘূর্ণিপথ- সবই জানেন। আমার প্রশ্নটা ওখানেই। তিনি কি ভুল করতে পারেন না! ধরে নেই, তর্কের খাতিরে, এই ভুলগুলো তিনি করেছেন।
প্রথমত, তার সাথে যে শিক্ষানবিশ পাইলট ছিলেন, তাকে কন্ট্রোল দিয়েছিলেন। এই ঝুঁকিবহুল পথে যার চলার অভিজ্ঞতা শূন্য। অথবা কো-পাইলটের অনেক প্রশ্ন ছিল, যার উত্তর দিতে দিতে তিনি একটি ঝুঁকিবহুল পরিবেশে ঢুকে পড়েন, যার ফলশ্রুতি- জধহধিু-২০। কারণ তিনিই ইতোমধ্যে ২০-তে ল্যান্ডিং এপ্রোস করেছেন। আবার তিনি বলেছেনÑ আমি ডানে যাচ্ছি, অর্থ হলো তিনি ২০তে নামতে পারবেন না। আর ক্যাপ্টেন বলছেন, রানওয়ে দেখতে পাচ্ছেন না। আবার ১০ সেকেন্ড পরই বলছেন ‘রানওয়ে দেখছেন!’ এটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৃঢ়তার অভাব ছিল। এমনটিও হতে পারে- আকাশে থাকাকালীন সময়ে তিনি মারাত্মক প্রকৌশলগত সমস্যায় পড়েছিলেন। সে কারণে তিনি আর বিমানের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি! বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিমানটি আকাশেই প্রচ- ঝাঁকুনি খাচ্ছিল, এর কারণ হতে পারে, বাতাসের গতির কারণে, যাকে বলা হয় এয়ার টারবুলেন্স, বিমানের স্টাবিলাইজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। হয়তো সে কারণেই বৈমানিক বলেছিলেন, এটা সরাসরি টাওয়ারকে অগ্রাহ্য করা। তিনি এটা করতে পারেন না, যদি করেন, সেটা হবে তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, এয়ার পরিবহনে এটা চলে না।
স্যাটালাইট ছবি বলছে তিনি ২০ বা ০২ কোনো প্রান্তেই অবতরণ করেননি। তিনি অবতরণ করেছেন রানওয়ের মাঝখানে, এটা সরাসরি বৈমানিকের হিসেবের ভুল। ধরা যাক, তিনি ২০-তে নামতে গিয়ে ক্রাশ হলো। কন্ট্রোল বলছে- ২০ ক্লিয়ার টু ল্যান্ড, ২৭০ নর্থ- তিনি একনলেজ করলেন ২৬০ নর্থ। কি ব্যাপার তাহলে? তিনি কি অবসাদগ্রস্ত ছিলেন, বা তিনি কি জেনে গেছেন আসলে কী হতে যাচ্ছে! বৈমানিক যদি কন্ট্রোল টাওয়ার শুনে ক্রাশ করতেন, তবুও সান্ত¦না ছিল। কন্ট্রোলের ভুলে এত বড় সর্বনাশ হলো!
আরেকটা বিষয় হতে পারে- এ্যারো-ডাইনামিক ভুল হয়েছিল। যেখান থেকে তিনি আর বিমানকে ভাসিয়ে রাখতে পারেননি। আর সে কারণেই তিনি বলেছেনÑ ‘ও যধাব ঃড় মড়.’ এ অবস্থার বেগতিক হয়ে বিমান নামানো ছাড়া কোন পথ নেই। এমনও হতে পারে- বিমানটি ভুগছিল জ্বালানি স্বল্পতায়।
ড্যাশ-৮-এর পরিবহন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এর ডান পাশের ল্যান্ডিং গিয়ারে সমস্যা ছিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ বিমানটি ক্রাশ হওয়ার পিছনে অন্তত ডান পাশের ল্যান্ডিং গিয়ার সময়মতো অথবা সম্পূর্ণভাবে খুলেনি, ফলে অবতরণের পরই প্লেন ক্র্যাশ করেছে। একটি এয়ারলাইন্স ইতোমধ্যে তাদের ১২ প্লেন বহর থেকে বাদ দিয়েছে। আরও একটি প্লেনে আগুন ধরে যাওয়ায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে ড্যাস-৮ যাত্রা শুরু করে। এর প্রাক্কলিত দাম ৩২.২০ বিলিয়ন ডলার (প্রাপ্ত তথ্য মতে)। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১,২৪২টি ড্যাস-৮ বিমান নির্মিত হয়েছে।
২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ঈঙঘঞওঘঊঘঞঅখ ঈঙঘঘঊঈঞওঙঘ ঈখঙএঅঘ অওজ-ঋখএঐঞ ৩৪০৭ উড্ডয়নের ৭ মাইল দূরে আছড়ে পড়ে। সেবার মৃত্যু হয়েছিল ১২ জনের। স্কেন্ডেনেভিয়ান এয়ারলাইন্স ড্যাস-৮ ছ-৮০০ সিরিজের বিমান তাদের পরিবহন বহরে ব্যবহার বন্ধ রেখেছে। এটা গেল ইতিহাস। যারা ছাড়পত্র দেবার কর্তৃপক্ষ, তারাই ভালো বলতে পারবেন কেন দুর্ভাগ্যতাড়িত-ইঝ-২১১। কোনো অজানা ত্রুটি ছিল কি না, ডি-চেক হয়েছে কি না- হলে সৈয়দপুরে যে যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছিল, সেটা কোন মাত্রায়? সে ব্যাখ্যা তারাই দেবেন।
নেপাল-কাঠমান্ডুর কন্ট্রোল টাওয়ার আরো পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে পারতো। তাদের সীমাবদ্ধতা ছিল, এ দায়ভার তারা এড়াতে পারে না। তাদের উচিত ছিল ঋরৎস সিদ্ধান্ত দেয়া। কিন্তু সবাই জানে, যখন কন্ট্রোল বলছে ও ঝঅণ অএঅওঘ! তার অর্থ কী হলো- ক্যাপ্টেনকে আগে যে নির্দেশ দিয়েছিল, সেটা হয় তিনি শুনেননি, অথবা মানসিক-বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থায় তিনি ছিলেন না, কারণ তিনি জেনে গেছেন কী হতে যাচ্ছে!
আমার এ লেখার উদ্দেশ্য কাউকে বা কারো পেশাগত অভিজ্ঞতাকে ছোট করা নয়। কেবল আহ্বান, যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটল, তার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করা। আগে-পিছের ঘটনাগুলো নির্মোহভাবে গবেষণা করে সামনে এগোনো। তবে এইটুকু বলব, যারা চলে গেছেন তারা আর ফিরে আসবেন না, যারা বেঁচে আছেন তাদের আজীবন দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে ফিরবে। এ বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি অনুরোধ করছি- যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তার একটু সচেতন হবেন, মনে রাখবেন, এ কোন ছেলেখেলা নয়, জীবন-মরণের প্রশ্ন। তাই কাউকে দোষ দিয়ে লাভ হবে না, প্রশ্ন করতে হবে আপনার বিবেককেই- আপনি কি সঠিকভাবে আপনার দায়িত্ব পালন করছেন? আমরা ভবিষ্যতে আর এ ধরনের শোকাবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে চাই না।
-নিউইয়র্ক।